২০২৪ সালের জুন মাসে আমার পৃথিবীর অন্যতম পর্যটন স্থান ভ্যানকুভার নগরীতে ভ্রমন করার সুযোগ হয়েছিল। আমরা জাহাজ নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার ইউসু বন্দর থেকে ভ্যানকুভার সমুদ্র বন্দরে গিয়েছিলাম বার্লি কারগো লোড করার জন্য। আমরা বন্দরে প্রায় এক সপ্তাহ ছিলাম। কার্গো লোডিং ধীরে হওয়ায় আমাদের সুযোগ হয়েছিল একাধিকবার ভ্যানকুভার সিটিতে ঘুরে বেড়ানোর।
আমি সে সময় ঐতিহ্যবাহী কানাডা প্যালেস, হোয়াইট লিফ পার্ক, ক্যাপিলানো সাস্পেনশন ব্রিজ, স্টেনলি পার্ক, বোট স্টেশন, ক্রিসেন্ট বিচ পার্ক, হোয়াইট রক বিচ সহ আরো কয়েকটি জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। আমাদের সাথে একজন বাংলাদেশী ড্রাইভার থাকাতে সবকিছু সহজ হয়েছিল।
এছাড়াও পোর্ট এ এসে জানতে পারি আমাদের মেরিন একাডেমীর দুইজন এক্স ক্যাডেট বন্দরটিতে পোর্ট ক্যাপ্টেন হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। উনারা আমার কয়েক বছর সিনিয়র ছিলেন। আমি পরবর্তীতে সিনিয়র স্যারদের সাথে যোগাযোগ করি এবং আমাদের জাহাজে আসার জন্য অনুরোধ করি। উনারা জাহাজে এসেছিলেন আমাদের সাথে দেখা করার জন্য। পরে আমরা একসাথেই বাইরে ঘুরতে যাই। দেশের বাইরে দুইজন এক্স ক্যাডেট একসাথে পেয়ে সত্যিই খুব ভালো লেগেছিল এবং সময়গুলো খুব ভালো কেটেছিল।
ভ্যানকুভার কানাডার পশ্চিম উপকূলে বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে অবস্থিত একটি ব্যস্ততম নগরী। মূল ভ্যানকুভার নগরীতে প্রায় ৭ লক্ষ অধিবাসী বসবাস করে। নগরীটি মেট্রো ভ্যানকুভার নামক আঞ্চলিক জেলার অন্তর্ভুক্ত যাতে প্রায় ২৬ লক্ষ লোকের বসবাস। এটি ব্রিটিশ কলাম্বিয়া তথা পশ্চিম কানাডার বৃহত্তম নগরী এবং কানাডার তৃতীয় বৃহত্তম নগরী।
শহরটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইন্ডিয়ান অধিবাসী রয়েছে। এছাড়াও কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশী দেখা যায়।
১৮৬০ এর দশকে এই এলাকায় বহু অভিবাসী এর আগমন ঘটলে ভ্যানকুভার শহরের পত্তন হয়। ভ্যানকুভারের আদি নাম ছিল গ্যাসটাউন। ১৮৮৬ সালে কানাডীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় রেল কোম্পানির সাথে এক যুক্তি অনুযায়ী শহরটির নাম বদলে ভ্যানকুভার রাখা হয়। ব্রিটিশ নাবিক ও ক্যাপ্টেন জর্জ ভ্যানকুভার এর নামে এই নামকরণ করা হয়। তিনি ১৮০০ শতকে এই অঞ্চলটিতে জরিপ চালান। নগরীটি একদিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশিয়া ও পূর্ব এশিয়া এবং অন্যদিকে পূর্ব কানাডা ও ইউরোপ এই দুই অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ায় একটি বাণিজ্যিক সংযোগী স্থলে পরিণত হয়। এছাড়াও পানামা খালের উদ্বোধনের পর ভ্যানকুভার বন্দরের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বেড়ে যায়। এটি বর্তমানে আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর এবং কানাডার বৃহত্তম এবং ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দর। এছাড়াও ভ্যানকুভারকে উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বৈচিত্রময় সমুদ্রবন্দর বলা হয়।
অরণ্য থেকে কাঠ আহরণ ভ্যানকুভারের বৃহত্তম শিল্পখাত। এছাড়াও এখানকার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পখাত হলো পর্যটন। দীর্ঘদিন থেকেই এটি দর্শনার্থীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল হিসাবে পরিচিত। ভ্যানকুভার শহরটি উত্তর আমেরিকার বৃহত্তম চলচ্চিত্র নির্মাণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। নিউ ইয়র্ক এবং লস এঞ্জেলেসের পরেই ভ্যানকুভার উত্তর আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম চলচ্চিত্র নির্মাণ কেন্দ্র। ভ্যানকুভারকে উত্তরের হলিউড নামেও ডাকা হয়।
ভ্যানকুভার নগরীটি ধারাবাহিকভাবে বসবাসযোগ্যতা ও উচ্চ জীবন যাত্রার মানের নিরিখে বিশ্বের সেরা পাঁচটি নগরীর মধ্যে রয়েছে। এটি কানাডার তথা বিশ্বের ব্যয়বহুল শহর গুলোর মধ্যে অন্যতম। আমরা বেড়ানোর সময়ই বুঝতে পারি শহরটিতে জীবন যাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। তবে আমার দেখা শহরগুলির মধ্যে এটিকে অন্যতম সুন্দর শহর বলে মনে হয়েছে। এ শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নজর কাড়ার মতই।
আমরা সে সময় ঘোরাঘুরির মাঝে পাকিস্তানি একটি রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়েছিলাম। শহরটিতে প্রচুর পাকিস্তানি এবং ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট রয়েছে। শহরটিতে বেশ বড় এবং দৃষ্টিনন্দন শপিং মল রয়েছে। আমরা সেই সময় ওয়ালমার্ট থেকে টুকটাক শপিংও করেছিলাম। আমরা শহরটিতে ঘুরতে ঘুরতে নেক্সাস লেন অর্থাৎ ইউএসএ এর কাছাকাছি পর্যন্ত গিয়েছিলাম। এই বর্ডার দিয়েই ইমিগ্রেশন,কাস্টম পাশ করে ইউএসএ তে যাওয়া যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা এই বর্ডার দিয়েই ইউএসএ এবং কানাডায় যাওয়া আসা করে।
ভ্যানকুভার শহরের প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই মনোরম। যেকোনো দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করবে এখানকার পরিবেশ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকেই এখানে বেড়াতে আসে প্রচুর দর্শনার্থী। সমুদ্র সৈকত, সবুজ অরণ্য,ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং নগরীটির নগর পরিকল্পনা সকল দর্শনার্থীকেই মুগ্ধ করে।
ভ্যানকুভার বিশ্বের অন্যতম সুন্দর শহর যা আকর্ষণীয় পর্বতমালা, ঝলকানি জল, রেইন ফরেস্ট এবং সবুজ অরণ্য দ্বারা পরিবেষ্টিত। সারা বছর জুড়েই দর্শনার্থীরা এখানে দুর্দান্ত লাইভ বিনোদন এবং আউটডোর অ্যাডভেঞ্চার এ অংশগ্রহণ করে থাকে।
লেখক: মাস্টার মেরিনার,(এ এফ এন আই) , এক্স ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি চট্টগ্রাম।