“স্বপ্ন পূরণের জন্য তোমার সবগুলো সিঁড়ি দেখতে পাওয়ার দরকার নেই, শুধু প্রথম সিঁড়িটা দেখতে পেলেই হবে”-মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
প্রতিটি জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে কার্যকর এবং সম্ভাবনাময় একটা সিঁড়ি দরকার। যা দ্বারা প্রকৃত পক্ষেই জীবনকে পরিবর্তন করা সম্ভব।সমাজে আজ পর্যন্ত যারা ‘মানুষের মতো মানুষ’ হয়ে উঠেছেন, যত বেশি আলোকিত হয়ে উঠেছে এবং নিজেকে সৎ, দক্ষ ও যোগ্য মানুষ হিসেবে গঠন করেছে তাদের নেপথ্যে ‘স্বপ্ন’ পূরণের নেশা কাজ করেছে।সমাজে ‘মানুষের মতো মানুষ’ এবং ‘আলোকিত মানুষ’ হয়ে উঠতে হলে দৃঢ় প্রত্যাশার বিকল্প নেই।
প্রত্যাশা শব্দটি শুনলেই আশা শব্দটির কথা মনে আসে। আশা ও প্রত্যাশা শব্দ দুটি আপাতদৃষ্টিতে সাদৃশ্য মনে হলেও শব্দ দুটির মাঝে রয়েছে বেশ পার্থক্য। সাধারণত একটা মানুষের আশা ভাঙা হয়, কখনো প্রত্যাশা ভাঙা হয়না। এতে মানুষ আশাহত হয়, প্রত্যাশাহত হয় না। অনেক সময় আমরা কোন কথার জোর বাড়াতেও প্রত্যাশা শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। প্রত্যাশা হলো এমন একটি আশা যার সঙ্গে যুক্ত থাকে প্রত্যয়। অর্থাৎ প্রত্যয় + আশা। আর এটি এমন একটি রূপরেখা বা আগামীর নীলনক্সা যা অর্জন করা সম্ভব এবং অর্জন করা প্রয়োজন। কারণ প্রত্যাশাই জীবনের সকল অর্জনের কেন্দ্রবিন্দু। সেটা ভালো-মন্দ মিলিয়ে। আশা এমনই একটি শক্তি যা দুর্বলকে সাহস যোগায়। শত প্রতিকূলতার মাঝেও আশা মানুষকে সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখায়। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত বড় বড় বিজয় অর্জন হয়েছে, যত দুর্বল অত্যাচারীকে পরাজিত করেছেন, যত মানুষ শূণ্য হাতে শুরু করে বিশাল কিছু হয়েছেন এই সবকিছুর পেছনেই প্রত্যাশা একটি বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
যেমন-আমাদের ভাষা শহীদদের প্রেরণার উৎস ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যাশা। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা। কিংবা আব্রাহাম লিংকন /বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট হবার প্রত্যাশা। সুতরাং প্রত্যেকেরই প্রয়োজন দৃঢ় প্রত্যাশাশক্তি। এই শক্তিতেই এক জ্যাক মা হতদরিদ্র অবস্থা থেকে কোটিপতি হয়ে যান, এই প্রত্যাশাই টমাস আলভা এডিসনের মত ‘মেধাহীন শিশু’কে জগতের সেরা জিনিয়াস বানায়। ধীরুভাই আম্বানী হয়ে ওঠেন এশিয়ার সেরা ধনী। আমার জীবনকে পরিচালিতকরার জন্য আজও কয়েকটি উক্তি বারে বারে নাড়া দেয়। যেমন-
“যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণ আশা আছে-আর ওই জীবনে প্রাণসঞ্চার করবে যখন প্রত্যাশা তৈরী করবে’’।- আমজাদ হোসেন রাজীব
“দেখবার জন্য আমাদের চোখের যেমন আলোর প্রয়োজন, ঠিক তেমনী কোনো প্রত্যয় অর্জন করবার জন্য আমাদের ভাবনার প্রয়োজন”- নিকোলাস খালব্রাঁশ বলেন।
“পৃথিবীতে এমন কোনও হতাশা আসেনি যা প্রত্যাশা কে পরাজিত করতে পারে”- স্যার বার্ণার্ড উইলিয়ামস।
আপনার প্রত্যাশা কখনই পরাজিত হবে না যদি আপনি প্রত্যাশা বা লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত কাজটির সাথে লেগে থাকেন। বাধা আসলেও তা অতিক্রম করার প্রবল ইচ্ছা শক্তি ধারণ করে থাকেন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য শেষ পর্যন্ত অনমনীয়ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যান । কারণ প্রত্যাশার আলোকে আপনার জীবন পরিচালিত হলে, সফল হবেন আপনি, আলোকিত হবেন আপনি এবং আপনি আলোকিত হলে আপনার গ্রাম, আপনার জেলা, পুরো দেশ এমনকি গোটা পৃথিবী উপকৃত হবে।
একটি চমৎকার উক্তি আছে, ‘একটি আলোর কণা পেলে লক্ষ প্রদীপ জ¦লে, একটি মানুষ মানুষ হলে বিশ^ জগৎ টলে’। অর্থাৎ আপনি সফল হলে, আপনি আলোকিত হলে আপনার প্রভাবে অন্যরাও আলোকিত হবে। আপনি সৎ হলে, সাহসী হলে অন্যরাও আপনার দেখাদেখি সৎ ও সাহসী হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা পাবে। আপনার এলাকায় এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এভাবে সারাদেশ এমনকি সারা পৃথিবীতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। নিজের এমন ইতিবাচক প্রভাবের ছাপ পৃথিবীর বুকে কে না রাখতে চায়। কিন্তু সবাই কি এরকম সুপরিচিত, সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে? উত্তর যদি না হয়, তবে কেন পারে না?
যারা পারে না, তার কারণ, তারা বড়জোড় চেষ্টা করেন। চেষ্টা হলো, লক্ষ্য অর্জনে বাধাগ্রস্থ হলে যারা আর অগ্রসর হয় না। অগ্রসর হবার আগ্রহ থাকে না। নিস্তেজ হয়ে পড়ে। যেমন-চেষ্টা করে চৌদ্দতলায় ওঠা যেতে পারে। খুব চেষ্টা করে হয়তোবা পাহাড়ের উঠতে পারবেন। কিন্তু কোনভাবেই এভারেস্টে উঠতে পারবেন না। আপনি চৌদ্দতলায় ভবন কিংবা পাহাড়ের উপর উঠে এই পৃথিবীটাকে যতোটুকু দেখতে পাবেন, আর যদি এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন, তাহলে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি পৃথিবীটাকে দেখতে পাবেন। আপনি কোনটি চান? সিদ্ধান্ত কিন্তু আপনার। মনে রাখা জরুরী চেষ্টা দিয়ে এভারেস্টে জয় করা সম্ভব নয়। এভারেস্টে জয় করতে হলে চেষ্টার চেয়েও বেশি কিছু দরকার। এই বেশি কিছুটাই হলো প্রতিশ্রুতি। প্রতিশ্রুতি হলো বারুদের মতো যাকে একটি বার প্রজ¦লিত করলেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রত্যাশা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন নিজেদের কাছে। তাদের শক্তিশালি প্রতিশ্রুতিতেই নির্মিত আজকের বাংলাদেশ। দেখবেন সমাজে বেশিরভাগ মানুষ, যারা সফল হয়েছেন তারা শুধু চেষ্টাই করে না বরং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে কাজ করেন। সুতরাং সফল হতে গেলে এবং ব্যক্তিগত ও সমন্বিত প্রত্যাশা অর্জনে আপনাকে অবশ্যই নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। এই প্রতিশ্রুতি আপনার কাছে আপনি করবেন। মনে রাখবেন অনেক বড় প্রত্যাশা থাকার পরেও বেশিরভাগ মানুষ সফল হতে পারে না। তার বড় কারণ তাদের প্রতিশ্রুতির দূর্বলতা।
প্রতিশ্রুতি তখনই দূর্বল হয় যখন মনের মধ্যে কিছু চিন্তা, প্রতিশ্রুতির প্রতি অনিহা বা সফলতার মুখ না দেখা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। যেমন-আমার দ্বারা কিছুই হবে না! আমি আগে তো পারিনি, এখন কি পারবো! ও আমার থেকে গুণী, যোগ্য, মেধাবী! আজ থাক পরে করবো! আমার অর্থ নেই!
এমন আরও অপ্রাপ্য প্রশ্ন আমাদের গন্তব্যের সোজা পথ থেকে দিশেহারা করে অন্ধকারে চিরতরে ডুবিয়ে দেয়। নিজের ভালো নিজেকেই বুঝতে হবে। কারণ বর্তমান তরুণ সমাজ পথভ্রষ্ট হলে বাংলাদেশকে নিয়ে সকলের দেখা স্বপ্নও মুখ থুবরে লুটিয়ে যাবে মাটিতে।
সুতরাং সময় কম, সুস্থ্য সমাজ গঠন করতে ও মেধাবী এবং কর্মঠ তারুণ্যের উদ্দীপ্ত শক্তি পেতে যুবকদের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বপনের বিকল্প নেই। বিপথে ঝোঁকা থেকে রুঁখতেপ্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে।###
লেখক-উন্নয়ন কর্মী, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ