শিক্ষকদের নিয়োগ সংক্রান্ত ও নিবন্ধন বিষয়ে তথ্য চাওয়াই পদত্যাগ করেছেন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মটমুড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি বিএসসি শিক্ষক নাজমা খাতুন। গত মাসের প্রথম দিকে তিনি পদত্যাগ পত্রটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের কাছে প্রেরণ করেন। তবে এ সংক্রান্ত কোনো কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার।
এদিকে ওই শিক্ষকের নিয়োগ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যায়নি। তিনি সকলের অগোচরে কাগজপত্রাদি সরিয়েছেন বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক। সরকারি ভাবে নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য চাওয়ার মুহূর্তে শিক্ষকের পদত্যাগ করায় সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিস্ট ও সুধী মহলে। গুঞ্জন চলছে নানা মহলে। প্রধান শিক্ষকের সহযোগীতায় সংরক্ষিত সকল কাগজপত্র গায়েব করেছেন বলে অভিযোগ অনেকের।
বিদ্যালয় প্রধানের দেয়া তথ্যে জানাগেছে, তৎকালীন সময়ের বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও মটমুড়া ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান শিরাজুল ইসলামের কল্যাণে নিকট আত্নীয়তার সুবাদে ওই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক শাহেদ মেহরাজের স্ত্রী নাজমা খাতুন ২০১০ সালের ২৭ অক্টোবর সহকারি বিএসসি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। যোগদান করেন ২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর। এমপিও ভুক্তি হন ২০১০ সালের ১ নভেম্বর ।
বিদ্যালয়ের সহকারি বিএসসি শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে সব ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আসছেন নাজমা খাতুন। যার এমপিও ইন্ডেক্স নং ১০৫৩৩৩৬।
আপন চাচা শ্বশুর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং স্বামী শাহেদ মেহরাজ ওই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হওয়ায় শিক্ষক হিসেবে দাপটের সাথেই দায়িত্ব পালন করেন নাজমা খাতুন। ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) থেকে যুগ্ম সচিব ড.কাজি আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের নিয়োগ প্রাপ্ত সকল মাধ্যমিক শিক্ষকদের কাছ থেকে নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত সকল শিক্ষকদের তথ্য প্রদানের জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়কে নির্দেশ দেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস।
মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের নির্দেশনা জানার সাথে সাথে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে গাংনী উপজেলার মটমুড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি বিএসসি শিক্ষক নাজমা খাতুন পদত্যাগ পত্র জমা দেন প্রধান শিক্ষকের বরাবর। শুধু তাই নয় তার সমুদয় কাগজপত্র অফিস থেকে সরিয়ে ফেলেন বলে দাবি করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক । পদত্যাগের বিষয়টি জানাজানি হলে সন্দেহ ও গুঞ্জন শুরু হয় নানা মহলে।
এব্যাপারে শিক্ষক নাজমা খাতুনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পারিবারিক কারণ ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি পদত্যাগ করেছেন। এর বেশি কিছু নয়।
বিদ্যালয়ের সহকারি একজন শিক্ষক জানান, তিনি একজন ভাল শিক্ষক ছিলেন। তবে তার শারীরিক অসুস্থতার কথা কোনোদিন শোনেননি। স্বাচ্ছন্দের সাথেই তিনি শিক্ষকতা করতেন।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি দবির উদ্দিন মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, আমি পরপর চারবার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। তবে আমার দায়িত্বের পূর্বে তোফাজ্জেল হোসেন সভাপতির দায়িত্ব থাকা কালীন ওই শিক্ষিকার নিয়োগ হয়েছিল।
সুতরাং নাজমা খাতুনের নিয়োগের বিষয়ে বা সরকারি বিধি মোতাবেক নিয়োগ হয়েছে কিনা আমি কিছুই জানিনা।অফিস থেকে উক্ত শিক্ষকের নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল গায়েবের বিষয়ে তিনি বলেন, সকল কাগজপত্র সংরক্ষিত থাকে প্রধান শিক্ষকের হেফাজতে। আমার চেয়ে ভাল জানেন সাবেক সভাপতি।
পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন জানান, আমি দায়িত্বে থাকাকালীন ওই শিক্ষকের এমপিও ভুক্তি হয়। তার চাচা শ্বশুর শিরাজুল ইসলাম সভাপতি থাকাকালীন নিয়োগ দিয়েছিলেন তার পুত্রবধূ নাজমা খাতুনকে।
এব্যাপারে সাবেক সভাপতি শিরাজুল ইসলাম জানান, এবিষয়ে আমি কিছুই বলতে চাইনা, আমার চাচাতো ভাইয়ের ছেলের বউ নাজমা খাতুন। এনিয়ে লেখালেখি করার দরকার নাই। তাছাড়া কাগজ পত্র বিষয়ে জাচাই-বাছাই করার ক্ষমতা আমাদের নেই। সংশ্লিষ্ট দপ্তর যাচাই বাছাই করবে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাকের আলী মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় এক বছর হতে চলেছে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষকরা বাড়িতে বসেই বেতন পাচ্ছেন। এমুর্হূতে ক্লাস নেয়া বা স্কুলে উপস্থিত হওয়ার বিষয়েও কোনো তাগাদা নেই। বিদ্যালয় চলাকালীন তিনি সুস্থতার সাথেই বিদ্যালয়ে আসতেন। তবে শিক্ষকদের তথ্য চাওয়া মাত্রই তিনি পদত্যাগ করাই অনেকেইে সন্দেহ করছেন।
শিক্ষক নাজমা খাতুনের নিবন্ধন সার্টিফিকেট সম্পর্কে তথ্য জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানের জন্য এক সপ্তাহ সময় অপেক্ষা করতে বলেন। এক সপ্তাহ পরে তথ্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে অফিস থেকে তার কোনো কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছেনা বলে জানান প্রধান শিক্ষক।
আপনার বিদ্যালয়ের ফাইলপত্র আপনার অনুমোতি ছাড়া কাউকে প্রদান করা কিংবা কাগজপত্র হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন এবিষয়ে পরে কথা হবে। তবে উক্ত শিক্ষকের নিয়োগ সংক্রান্ত অনেক জটিলতা থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
গাংনী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মীর হাবিবুল বাসার মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, শিক্ষকের পদত্যাগের বিষয়টি আমি লোকমুখে শুনেছি। আজও আমার কাছে কোনো কাগজ আসেনি। এমুহূর্তে পদত্যাগ করাটা প্রশ্নবিদ্ধ মনে হচ্ছে। মানুষের মধ্যে সন্দেহ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
তবে আমরাও চাই যারা নিয়োগের সময় পরিচালনা কমিটির শুপারিশে এবং তথ্যগোপন রেখে বৈধকাগজপত্র না থাকলেও নিয়োগ পেয়ে সরকারি সুবিধা ভোগ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে যাচাই বাছাই করা জরুরী। ইতোমধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকের তথ্য হাতে পেয়েছি। তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।