মহামারি করোনার সময় ব্যাংক খাতে আমানতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও গত কয়েক মাস ধরে টানা কমছে। গত চার মাসে ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ৩.২১ শতাংশ।
এমন একসময় আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, যখন ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে নতুন ঋণের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যাংকাররা। তবে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে রেমিট্যান্সের পতনকে দায়ী করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার মধ্যে প্রবাসীরা তাঁদের পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যার বড় একটা অংশ সঞ্চয় হিসেবে ব্যাংকে ঢুকেছে। কারণ, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিয়তার কথা ভেবে তখন প্রবাসীরাও সঞ্চয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। শুধু প্রবাসীরাই নয়, করোনাকালে আয় কমার পরও অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে সঞ্চয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষ।
এ ছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগ থমকে থাকায় ব্যাংকে আমানতে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার পর থেকে রেমিট্যান্সের টানা পতন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আমানতের মুনাফায় (সুদ) সর্বনিম্ন সীমা আরোপের পর ব্যাংকগুলো কর্তৃক আমানত নিরুৎসাহ করায় আমানত প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সাধারণ ছুটি ও কয়েক দফার লকডাউনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। অনেকের রুটি-রুজির পথ বন্ধ হয়ে যায়। চাকরি হারিয়ে বেকার হন অনেকেই।
আবার কাজ থাকলেও বেতন কমে যাওয়া বা বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এতে ব্যাংক খাতে আমানত কমার আশঙ্কা থাকলেও রেমিট্যান্সের জাদুতে সেটি হয়নি। কারণ, করোনার মধ্যেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যার বড় অংশই আমানত হিসেবে ব্যাংকে আসে। এ ছাড়া করোনা সংক্রমণ ভীতিতে ব্যক্তি বিনিয়োগ থমকে যাওয়ার কারণেও আমানতে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু এখন আমানত কমছে, কারণ রেমিট্যান্সও কমে গেছে।
আর রেমিট্যান্স যে কমে যাবে সেটি আমি আগেই বলেছিলাম। এ ছাড়া আরেকটি কারণে আমানত কমছে, সেটি হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক আমানতের সর্বনিম্ন সুদ বেঁধে দেওয়ার কারণে। কারণ আমানতের সুদ বাড়ানোর নির্দেশনার পর কিছু ব্যাংক আমানত নিতে অনাগ্রহ দেখায়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে করোনা আঘাত আসার আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২.৮২ শতাংশ। সেই প্রবৃদ্ধি বাড়তে বাড়তে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৪.৪৭ শতাংশে ওঠে। কিন্তু এরপর থেকেই টানা কমছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ১১.২৬ শতাংশ। অর্থাৎ গত চার মাসের ব্যবধানে আমানতের প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩.২১ শতাংশ কমে গেছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক পতনই আমানতের প্রবৃদ্ধি কমার জন্য দায়ী। কারণ করোনাকালে রেমিট্যান্স ব্যাপক হারে বেড়েছিল। আর ঠিক যখন থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে শুরু করেছে, তখন থেকে আমানতের প্রবৃদ্ধিতেও নিম্নমুখী প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি।
এ ছাড়া সুদ কমার কারণেও আমানত নিরুৎসাহ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘করোনায় বিনিয়োগের গতি থমকে যাওয়ায় ব্যাংক খাতে প্রচুর তারল্য জমেছিল। এতে আমানতের সুদও কমে যায়। ফলে বিকল্প হিসেবে পুঁজিবাজার ও সঞ্চয়পত্রেও টাকা খাটিয়েছেন মানুষ। যার প্রভাব পড়েছে আমানতের প্রবৃদ্ধিতে।’ আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া ব্যাংক খাতে দীর্ঘমেয়াদে কোনো শঙ্কা তৈরি করবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া অবশ্যই শঙ্কার কারণ। আমরা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।’
২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও এই সুিবধা বহাল রাখা হয়েছে। রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়ার পর থেকে প্রতি মাসেই প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি অর্থ পাঠাতে শুরু করেন। এমনকি করোনা সংক্রমণের মধ্যেও তাঁদের এই অর্থ প্রেরণ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু এখন করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এর কারণ সব কিছু খুলে যাওয়ায় হুন্ডি আবার চাঙ্গা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুন মাস থেকে টানা কমছে রেমিট্যান্স।
ওই মাসে রেমিট্যান্স আসে ১৯৪ কোটি ডলার। আর সর্বশেষ নভেম্বর মাসে আসে মাত্র ১৫৫ কোটি ৬৭ লাখ ডলার, যা গত ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের মাস অক্টোবরে আসে ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে ১৭২ কোটি ৬৭ লাখ, আগস্টে ১৮১ কোটি ও জুলাইতে আসে ১৮৭ কোটি ১৪ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিট্যান্স আসে ৮৬০ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০.৯৭ শতাংশ কম।
এদিকে, সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় গত আগস্টে মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানতের মূল্যস্ফীতির নিচে সুদ দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে আগের তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য বলছে, ওই নির্দেশনার আগে ৩৮টি ব্যাংকের সুদের হার মূল্যস্ফীতির নিচে ছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব ব্যাংকের অনেকেই নির্দেশনা জারির পরই আমানতের সুদের হার বাড়িয়ে নির্ধারণ করে। আর দ্রুত মুনাফা অর্জনের মানসিকতাসম্পন্ন কিছু ব্যাংক সুদ না বাড়িয়ে আমানত নিরুৎসাহ করে আন্ত ব্যাংক কলমানি থেকে অপেক্ষাকৃত কম সুদে তহবিল সংগ্রহ করে ব্যবসা করতে থাকে। আর এসব ব্যাংকই এখন তারল্য সংকটে পড়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র।