রাজ্যের সব হিসাব কিতাব মাথায় থাকে, সবার প্রতি দায়িত্ববোধ সজাগ থাকে অথচ প্রিয় মানুষের জন্মতিথি স্মরণে থাকে না, পছন্দ-রুচি হাজির করেন না কিংবা ঘুরতে যাওয়ার সময় বের করতে পারেন না- এমন হলে সুখ তবে ঘরে ফিরবে না। বরং অসুখ আপনায় তাড়িয়ে বেড়াবে। সম্পর্ককে সময় না দিলে যে দূরত্ব তৈরি হবে তা ঘুচানোর কাজটা সহজ নয়। তাঁর সাথে সব কথা দু’মিনিটে ফুরিয়ে গেলে দশ গ্লাস দুঃখ পান করতেই হবে। যদি যত্ন না থাকে, শ্রদ্ধা না বাড়ে তবে সম্পর্কে সম্মান জন্মে না। জীবনের নাগপাশে সুখ-প্রশান্তি ঘোরাঘুরি করে বিদায় নিলো অথচ দেখা পেলেন না- সে আক্ষেপ আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। প্রিয় মানুষকে প্রাধান্য দিলে তবেই সম্পর্ক টেকসই হয়। শখের দেশে হাজির করলে তবেই অভিযোগ কমে। মান-অভিমান ভাঙানোর জেদ থাকলে তবেই মনকে মনের মনে পড়ে।
অনুপস্থিতির সময়টাতে জুড়ে থাকার যে ব্যাপারটা সেটুকুতেই প্রেম। প্রেম দেখানোর চেয়ে বোঝানো জরুরি। যে মানুষটা সবার মাঝে থেকেও সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য প্রত্যাশা করে সেই মানুষটিকে উপেক্ষা করলে- সম্পর্ক পারদ পাতলা হতে শুরু করে। অভিমান না ভাঙানোর মাঝে যে জমাট ব্যথা তা তাকেই ভোগায় যার অভিমান মনের মধ্যে ব্যথার পাহাড় গড়ে। দু’টো কথা শুনে যে আনন্দ পায়, একটু স্পর্শে যার কোলে রাজ্যের সুখ নামে তাকে অধিকার বঞ্চিত করা ঠিক নয়। এই জীবনটা সুখের জন্য সামনে বাড়ে। সেই প্রত্যাশা ও প্রশান্তির পথে যে হাল ধরে সে সুখের অন্যরকম মধূর সংজ্ঞা তৈরি করে। যে সুখী করতে জানে সে সুখী হয়। সুখ তাকে ঘিরে রাখে। সবার জন্য সবকিছুর করার মাঝে তৃপ্তি নিশ্চয়ই আছে তবে যার অধিকার সর্বাগ্রে সে যাতে তালিকার তলানিতে না পড়ে।
মান-অভিমান কিংবা অভাব-অনুযোগ জীবনের বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। তবে এসব ভাঙানোর এবং শখ পূরণ করার যে চেষ্টা এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য যে দায়িত্ববোধ- এসবই মানুষকে প্রিয় করে তোলে। প্রিয়জন যদি প্রয়োজনের রেখা অতিক্রম করে আপন হয় তবে এক মানুষেই একজীবন পূর্ণ হতে পারে। দু’টো হাত, ভরসার কাঁধ এবং বিশ্বস্ত হৃদয়ের চেয়ে প্রশান্তির আবাস দুনিয়া দু’টো নাই। পাখি এদিক-সেদিক উড়তে পারে, ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারে তবে বেলা শেষে যে নীড়ে ফিরতে হবে- সেখানে কেউ অপেক্ষা করুক, সেখানে দু’চামচ শান্তির জন্য রসদ থাকুক- সেই চেষ্টায় সর্বোচ্চ সময় রাখতে হবে। দু’জনে মুখোমুখি বসিবার, চোখে চোখ রাখিবার দুর্নিবার আকাক্সক্ষা একজীবনের সবটুকু সময় যেনো প্রফুল্লচিত্তেই থাকে। হাত ধরা মানুষটি যাতে কোন শ্রোতেই হারাতে না পারে।
দুঃখ যদি হাজির হয় তবে তা মোকাবেলায় যুগপৎ সংগ্রাম যাতে অবিরাম থাকে। যাকে বিশ্বাস করা যায় অনায়াসে তাকে নিয়ে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতেও ক্লান্তি নাই। যে রাখে ওয়াদা, যার কাছে জমা থাকে বিশ্বাস- সে প্রকৃত মানুষ হলে কোন বাঁধাই জীবনকে এলোমেলো করে দিতে পারে না। তবে কখনো যদি মানসিকতার দূরত্ব হয়, ভাঙনের ঢেউ খেলে এবং তাতে পাল দেয় লোভ তবে সে সম্পর্কের দেয়াল ইস্পাত-দৃঢ় হলেও টিকবে না। দেহের নাগালে থাকলেও মানুষ মেলে না! এই শরীরে মূল্য এবং প্রয়োজন ক্ষণিকের। অবিরাম থাকতে হয় মনে মন গেঁথে। অথচ অবিশ্বাসের পারদ চড়া হলে, সন্দেহ জীবনের দিকে তেড়ে এলে এবং প্রিয় মানুষকে উপেক্ষা-অবজ্ঞায় ঠেলে দিলে এই জীবনের রঙ-রস শুকিয়ে যাবে। যে সম্পর্কের সুভাষ নষ্ট হয়ে যায় সে সম্পর্কের টানটা মরে যায় আরম্ভিক প্রান্তে।
বাঁচার জন্য কেউ অপরিহার্য নয় তবে সুখে বাঁচার জন্য একজন বিশ্বস্ত মানুষের উপস্থিতি অনিবার্য। দুঃখের দিনে পাশে থাকলে, মন খারাপের দিনগুলোতে ভরসা দিলে, বিশ্বাসের হাত মাথায় রাখলে- সে জীবন উপভোগ্য হয়ে ওঠে। বিচ্ছেদের তীব্র ঢেউয়ের মাঝে একসাথে বাঁচার মাঝে, একাকাশে ওড়ার মাঝে এবং দিন-দুনিয়ায় ঘোরার মাঝে সর্ব সুখ লুকিয়ে থাকে। জমানো কথা যার কাছে অনায়াসে বলা যায়, যার পরশে বুকের ব্যথা হালকা হয় কিংবা যার ঘ্রাণে মন ভালো হয় যায়- সে বিশেষ কেউ। এই মানুষের জন্য একটা জীবন লগ্নি হলে দুঃখের অগ্নি স্পর্শ করতে পারে না। আরেকটু বাড়তি সুখের জন্য চেষ্টায় সচেষ্ট হলে সুখের বর্ষণে হৃদয় প্রশান্তিময় হবে। সব সুখে ভোগের মধ্যে থাকে না। কারো স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে, কারো ইচ্ছা পূর্ণ করে এবং কারো জীবনে সুখের ধূপগুড়ি ছড়িয়ে দিলে জীবন সুশোভিত আলোকের মঙ্গলে ছেয়ে যায়। প্রিয় মানুষ প্রিয়তর হয়ে উঠুক- সুদিনের প্রত্যাশায়।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইমেইল-raju69alive@gmail.com