ফের ভিক্ষার থালা নিয়ে পথে-প্রান্তরে নেমেছেন দেশীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’র মেকআপম্যান কাজী হারুন।
গত বছরের অক্টোবর মাসেও তিনি ভিক্ষার থালা হাতে ঘুরছেন এমন ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
বিষয়টি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে পড়ে। তিনি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই মেকাআপম্যানকে ডেকে নিয়ে ৫ লাখ টাকা অনুদান দেন।
এর পর সুপার শপ ‘স্বপ্ন’ এক বছরের জন্য প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা সমমানের গৃহস্থালি পণ্য দিয়ে তাকে সহযোগিতা করতে থাকে।
সেই ঘটনার এক বছর তিন মাস পার হয়েছে মাত্র। এরই মধ্যে ফের ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরতে দেখা গেল মেকআপম্যান হারুনকে।
কারণ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দরিদ্রতা তাকে গ্রাস করেছে। এ বিষয়ে হারুনের স্ত্রী মহুয়া আকতার জানান, সংসারের খরচ আর চিকিৎসা ব্যয়ে সেই পাঁচ লাখ টাকা শেষ হয়ে গেছে। স্বপ্ন থেকে দেয়া সেই সাহায্যও বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক মাস হয়। তাই পেট চালাতে আবারও বৃদ্ধ বয়সে মানুষের কাছে হাত পাততে হচ্ছে এই মেকআপ শিল্পীকে।
জানা গেছে, কাজী হারুন স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর এক বস্তিতে থাকেন। সংসার চালাতে স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। তিন বাড়িতে কাজ করে শুধু ঘর ভাড়াটা জোগাড় করতে পারেন স্ত্রী। এর পর খাবারের জোগান দিতে কাজী হারুন ভিক্ষা করেন পাড়ায় পাড়ায়।
কিন্তু কেন এই করুণ পরিণতি গুণী এ রূপকারিগরের?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শারীরিক অসুস্থতার কারণে কোনো ধরনের কাজ করতে পারেন না কাজী হারুন। অন্ন সংস্থানের পাশাপাশি চিকিৎসার খরচ জোগাতে তাকে আজ পথে নামতে হয়েছে।
এ বিষয়ে স্ত্রী মহুয়া আকতার জানিয়েছিলেন, বিয়ের পর থেকে আমাদের অবস্থা ভালোই ছিল। সংসারে অভাব ছিল না। কিন্তু ২০০৯ সালে সে ব্রেন স্ট্রোক করে। এর পর থেকেই দিন বদলে যায় আমাদের। জমানো টাকাপয়সা যা ছিল তা দিয়ে ওর চিকিৎসা করিয়েছি। সেটিও একসময় ফুরিয়ে যায়। শুরু হয় আমাদের কষ্টের দিন।
তিনি বলেন, স্ট্রোকের পর তার শরীরের ডান পাশ অকেজো হয়ে যায়। অসুস্থ হওয়ার কারণে আর কাজ করতে পারে না। সেই থেকে চলচ্চিত্রের কেউ এসে খবরও নেননি কখনও। উপায়ন্তুর না দেখে আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করা শুরু করি। তাতেও সংসার চলে না দেখে ২০১১ সাল থেকে সে ভিক্ষায় নামে।
অভাব-অনটনের গল্প এখানেই থেমে থাকেনি কাজী হারুনের। মেয়ের বিয়ের খরচ জোগাতে ২০১০ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার হিসেবে পাওয়া সোনার মেডেলটিও বিক্রি করে দেন তিনি।
ওই মেডেলে এক ভরি স্বর্ণ ছিল। মাত্র আট হাজার টাকায় সেটি বিক্রি করেছে। পিতলের কোনো দাম না থাকায় পুরস্কারটি বিক্রি করতে পারেনি।
অনেকের দ্বারে সেটি নিয়ে ঘুরেছেন। যদি কিছু টাকা দেয় কেউ। কিন্তু তাও জোটেনি কপালে। এর পর চাপা অভিমানে সেই পিতলের পুরস্কারটি ফেলে দেন হারুন।
এ মুহূর্তে জীবন ধারণ প্রসঙ্গে কাজী হারুনের স্ত্রী বলেন, ‘বস্তিতে দেড় হাজার টাকা দিয়ে একটি ছোট রুমে ভাড়া থাকি। তিনটি বাড়িতে কাজ করে ৫০০ করে ১৫০০ টাকা পাই আমি। সেটি দিয়ে সেই রুম ভাড়া দিই। আর ও ভিক্ষা করে দিনে ২০০-৩০০ টাকা পায়। সেই টাকা দিয়ে বাজার আর ওর ওষুধ কিনি। ও যেদিন অসুস্থ থাকে, সেদিন বেশি সমস্যা হয়। আমি ছাড়া তাকে দেখার কেউ নেই। কাজে গেলে বাসায় একা ফেলে রেখে যেতে হয়। তা ছাড়া সে বের না হলে খাবারও জোটে না, আয় বন্ধ।’ প্রসঙ্গত ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’র মতো ব্যবসাসফল এবং জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মেকআপম্যান ছিলেন কাজী হারুন। গুণি এ মেকআপম্যান ‘অন্য জীবন’, ‘শঙ্খমালা’, ‘গোলাপী এখন ঢাকা’, ‘জীবন সংসার’সহ শতাধিক চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ারে পেয়েছেন নানা স্বীকৃতিও। ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হৃদয় থেকে হৃদয়’ ছবিতে কাজের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
সুত্র-যুগান্তর