আজ ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পাট উৎপাদনেও দ্বিতীয়। এছাড়া ধান ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় এবং আলু আম উৎপাদনে সপ্তম। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শষ্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৃষি-দর্শনের আলোয় হাঁটছেন শেখ হাসিনা ।
গল্পটা শুরু বঙ্গবন্ধুর হাতে
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকেই সবুজ বিপ্লবের আহবান জানান বঙ্গবন্ধু। দিনটা ছিল ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে অনেকটা সামাজিক আন্দোলনের মত করে এই আহবান জানান তিনি। কৃষকদের সব বকেয়া খাজনার সুদ মাফ করে ভবিষ্যতে যে কোনো কৃষকের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফের ঘোষণা দেন।
রাষ্ট্রপতির ১৩৫ নম্বর আদেশের মাধ্যমে নদী কিংবা সাগরের মধ্যে জেগে ওঠা চরে, জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে দরিদ্র কৃষকদের দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একই সাথে খাস জমি প্রান্তিক অস্বচ্ছল কৃষকদের মধ্যে বণ্টনের উদ্যোগ নেন। পাকিস্তান সরকারের সময় দায়ের করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি দেন। কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির ২৭ নম্বর অধ্যাদেশ বলে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক’।
আবার শুরু করতে হলো
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৪ বছরের সামরিক শাসন এবং পাঁচ বছরের বিএনপি শাসনামলে কৃষি ব্যবস্থাপনা ছিল খুবই দুর্বল এবং বুলি সর্বস্ব প্রচার। এই খাত ভরে গিয়েছিল অপরিকল্পিত খাল খননের মত কিছু লোক দেখানো ছেলে খেলায়। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আসতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হলো ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। প্রথমবার সরকার গঠন করলেন শেখ হাসিনা। দেখলেন, দেশে খাদ্য ঘাটতি ৪০ লাখ মেট্রিক টন।
তিনি কাজ শুরু করলেন। প্রথমে কৃষিতে বাজেট বাড়ালেন। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরের বাজেটে শুধু কৃষি গবেষণার বরাদ্দ ছিল ১২ কোটি টাকা। সরকার ক্ষমতায় আসার বছরেই কৃষিখাতে বাজেটের এই বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে ছিল ঐতিহাসিক। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে, অর্থাৎ সরকার গঠনের পরের বছরই কৃষিখাতের বাজেট উন্নীত হয় ১০০ কোটি টাকায়, যা সম্পূর্ণ ব্যয় করা হয় কৃষি ও কৃষি সংক্রান্ত আইসিটি খাতে।
আরেকটি কালো অধ্যায়
বিএনপি জামাত জোট সরকারের সময়ে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পুনরায় দেশের কৃষিতে ধস নেমে আসে। আওয়ামী লীগ সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেখানে খাদ্য উদ্বৃত্ত রেখে যায়, সেখানে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয় । যে কারণে আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রয়োজনীয় সরকারি কর্মসূচি ও সীমাহীন দুর্নীতির জন্য কৃষকরা বিপদে পড়েন।
বিদ্যুৎক্ষেত্রে বিএনপি-জামাতের সীমাহীন দুর্নীতির জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। এতে সেচ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা থেকে লাখ লাখ বস্তা সার লুট করে তা দ্বিগুণ দামে খোলা বাজারে বিক্রি করতো বিএনপি-জামাতের কর্মীরা। যেকারণে সারের তীব্র সংকট তৈরি হয়। সারাদেশে বিদ্যুৎ ও সারের অভাবে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন কৃষকরা। আন্দোলনরত কৃষক-শ্রমিকের ওপর পুলিশি নির্যাতন নেমে আসে। কোনো কোনো জায়গায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন কৃষক।
২০০৪ সালের ২৩ মার্চ যশোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবিরাম লোডশেডিংয়ের কারণে কৃষক এবং পোল্ট্রি খামারিদের মধ্যে নাভিশ্বাস ওঠে। পোল্ট্রি ব্যবসা প্রায় লাটে ওঠে। গরমে খামারের বাচ্চা-বাচ্চা মুরগিগুলো মারা যেতে থাকে। লোডশেডিং ও লো-ভোল্টেজে তৃণমূলের শতশত সেচপাম্প বিকল হয়ে যায়।
২০০৬ সালের ৫ মার্চ খুলনার রূপসায় বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলনে নামে জনতা। এসময় জোট সন্ত্রাসীদের হামলায় কমপক্ষে ২০ জন আহত হন। ওই বছরই বিদ্যুৎ ও সার সংকটের প্রতিবাদে যশোর-মাগুরা ও যশোর-খুলনা সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করেন চাষিরা। নওগাঁয় বিদ্যুতের জন্য ৫ হাজারেরও বেশি কৃষক ঘেরাও করেন বিদ্যুৎ অফিস।
একই বছরে বিদ্যুতের দাবিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের কানসাটে আন্দোলনরত জনতার ওপর সরকারের পেটোয়া বাহিনীর অকস্মাৎ গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন সাতজন সাধারণ মানুষ। পাঁচ মাসের ওই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান ১৭ জন। আহত হন অন্তত ৬০০ মানুষ। এ ঘটনায় সারাদেশ ফুঁসে ওঠে।
২০০৮ থেকে কৃষিখাতের পুনর্জাগরণ
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় তখন দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৬ লাখ টন। প্রথম ক্যাবিনেট সভাতেই সারের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ৯০ টাকার ট্রিপল সুপার ফসফেটের দাম কেজি প্রতি ২২ টাকা ও ৭০ টাকার মিউরেট অব পটাসের দাম কেজি প্রতি ১৫ টাকায় নামিয়ে আনেন। ফলে সুষম সার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি দেয়া, সেচ সুবিধা বাড়ানো, সার বিতরণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ নানামুখী পদক্ষেপ নেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।
এর পরপরই কৃষি গবেষণায় অগ্রাধিকার দেয় সরকার। যার ফলে প্রতিটি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে ল্যাব উন্নয়নসহ নানামুখী গবেষণা পরিচালনা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল কৃষি তথা ‘ই-কৃষি’র প্রবর্তন করা হয়। এখন দেশে মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি), কৃষি কল সেন্টার-১৬১২৩, কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষি তথ্য বাতায়ন তৈরি করা হয়েছে। ফলে দেশের প্রান্তিক কৃষকসমাজ সহজেই কৃষিখাতের আধুনিকায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছেন।
শেখ হাসিনার সরকার কৃষককে মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দেওয়ায় ১ কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৪৮টি ব্যাংক হিসাব খোলা সম্ভব হয়েছে, যেখানে বর্তমান স্থিতি প্রায় ২৮২ কোটি টাকা। সরকার ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে প্রণোদনা চালু করেছে। অদ্যাবধি এ কর্মসূচির মাধ্যমে ৮২৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৩ কৃষক উপকৃত হয়েছেন।
আলোর পথে বাংলাদেশ
২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৮০০০ কোটি টাকা। করোনা সংকটের মুখে খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে ৯৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। বিএনপি আমলে যেখানে মোট ফসল উৎপাদন ছিল মাত্র ২ কোটি ৬১ লাখ টন। সেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমলে ২০২২ সালে মোট ফসল উৎপাদন হয় ৯ কোটি ১৯ লাখ ১৮ হাজার ৮০০ টন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন সবার আগে দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে কৃষি। কৃষকদের জীবনযাত্রার মানেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। লেখাপড়া শেষ করে বহু ছেলে মেয়ে কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে। কৃষিখাত হয়ে উঠছে দেশে কর্মসংস্থানের অন্যতম আশ্রয়।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।