শ্রাবণের আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎস্ফূরণ। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর পৈশাচিক তাণ্ডবে সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলার বামন্দী এলাকার গ্রামগুলি প্রায় জনশূন্য, কেউ কেউ আবার এলাকায় অবস্থান করে গোপনে স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। গ্রাম থেকে নিরীহ মানুষকে ধরে এনে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। পচাগলালাশের দুর্গন্ধে আমঝুপি, মেহেরপুর কোর্ট বিল্ডিংং চত্বর, সাহারবাটীর টেপুখালির মাঠ, গোভীপুর গ্রামের বাতাস ভারি হয়েউঠেছে। তারপরও পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
মানসিক উত্তেজনায় আর সম্ভাব্য বিপদের পূর্বাভাস আঁচ করতে পেরে হারিসউদদীন এবং তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধা আবুল কাশেম বাড়ির ভেতর পায়চারি করছিলেন রাত জেগে। তখনও নির্ঘুম ছিল স্ত্রী ফাতেমা বেগম ও বড়ছেলে শামসুজ্জোহা। গভীর রাত, ১২ টার কাঁটা পার হয়েছে। মেহেরপুর জেলার গাংনী শহর থেকে ১৫ কিমি দূরে বামন্দী গ্রামে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের কয়েকটি ট্রাক। একটি একতলা বাড়ির সামনে ট্রাকগুলো থামে এবং কাল বিলম্ব না করে মুহূর্তের মধ্যে বাড়িটি ঘিরে ফেলে।
মুন্দা গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার মহিরের নেতৃত্বে হায়েনার দল ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতরে। হারিসউদদীন নিজের হাতে রক্ষিত বন্দুক দিয়ে শত্রুদের প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার স্ত্রী তাকে নিবৃত করেন। হারিসউদদীন ও তার আত্মীয় আবুল কাশেমকে পাকসেনারা চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে তুলে এনে ভাটপাড়া ক্যাম্পে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। স্বজনরা আজও তার লাশ খুঁজে পায়নি। তারিখটি ছিল ১৫ আগস্ট।
মেহেরপুরের গাংনীর এই বিদ্যোৎসাহী, সংস্কৃতিসেবী, দানবীর ও স্বাধীনতাযুদ্ধের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বের পরিবার আজও এই মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা ভোলেনি। হারিস উদ্দীনের জন্ম ১৯২১ সালে মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার বামন্দী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পিতা বদরুদ্দীন বদু ফরাজি ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও জোতদার। বামন্দী বাজারে তাদের বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। স্ত্রী ফাতেমা বেগমের বাবা ছমির উদ্দীন ছিলেন
মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির প্রভাবশালী জোতদার। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হন শিকারপুর হাইস্কুলে। উচ্চমাধ্যমিক পাসের আগেই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটে। পেশা ও জীবনব্রত হিসেবে বেছে নেন জনসেবা, রাজনীতি, খেলাধূলা ও সংস্কৃতিচর্চা। হারিসউদ্দীন ছিলেন গাংনী থানার মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ সংগঠক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি এলাকায় বিদ্যোৎসাহী, ক্রীড়া-সংগঠক ও সংস্কৃতিসেবী হিসেবে পরিচিত। বামন্দী-নিশিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বামুন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ‘বামুন্দী হাট’সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার ও ফুটবল মাঠের জন্য উদারহস্তে জমিদান করেছেন। তার উদ্যোগে এলাকায় সামাজিক- সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। আমৃত্যু ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণে সহায়তা করেছেন। ভাল ফুটবল খেলতেন। লোকজসংস্কৃতি ও খেলাধূলার উন্নয়নে অকাতরে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। শহীদ হারিস উদদীন ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত এক বিরলপ্রজ রাজনৈতিক- সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। শিক্ষাবিস্তার, জনকল্যাণ ও মুক্তিযুদ্ধে হারিস উদদীনের অবদান অসামান্য।
ছেষট্টির ৬-দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও অসহযোগ আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার সপক্ষে এলাকায় মিছিল মিটিং ও সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কুষ্টিয়ার দিক থেকে মেহেরপুর জেলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সম্ভাব্য আগমন ও আক্রমণ প্রতিরোধে খলিশাকুণ্ডির ব্রিজ প্রহরায় নিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ তদারকি করেছেন তিনি ও তার সহযোদ্ধা আবুল কাশেম।
গাংনী থানায় পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত বামন্দী এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তরুণদের স্বাধীনযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ ও ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণে সহায়তা করতেন। তিনি এলাকার তরুণ-যুবকও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কুষ্টিয়ার প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে গাংনী থানার বন্দুক মালিকদের নিয়ে বন্দুক বাহিনী গড়ে ওঠে। কিন্তু তাঁর বীরোচিত অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি মেলেনি আজও।
তবে রফিকুর রশীদের লেখা আগামী প্রকাশনীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: মেহেরপুর জেলা’ গ্রন্থে হাফিজউদদীনকে ‘ গাংনী থানার স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগণ্য ব্যক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের ‘মুক্তিসংগ্রামে মেহেরপুর’ এবং মূর্ধন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আবদুল্লাহ আল আমিনের ‘ ভাটপাড়া নীলকুঠি ও উনিশ শতকের বাংলাদেশ’ গ্রন্থে (ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) শিক্ষক হাফিজউদদীনকে শহীদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ড. মো. আবদুল হান্নান লেখা ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে বৃহত্তর কুষ্টিয়া’ বইয়েও শহীদ হারিসউদ্দীনের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শহীদ হাফিজউদদীন এবং একাত্তরের ১৫-আগস্টের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ভাটপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে, বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ চলছে।
হারিসউদদীনের স্ত্রী মারা গেছেন। তাদের আট ছেলেমেয়েদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা শামসুজ্জোহা, রেজাউল হক, শরিফুল ইসলাম, নূরজাহান, আনোয়ারা বেগম ও মনোয়ারা বেগম মারা গেছেন। নাতি ব্যবসায়ী হাসানুজ্জামান বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে এলাকায় নেতৃত্বদানের জন্য আমাদের দাদা শহীদ হয়েছেন। আমাদের বাড়িঘরে লুটতরাজ চালানো হয়েছে, অত্যাচার করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের পরিবার অনেক দুর্ভোগ সয়েছে। তারপরও আমাদের দাদা শহীদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ।