লোক সংস্কৃতির একটা প্রধান অঙ্গ লোকসাহিত্য। লোককাহিনী, লোকসংগীত, ভাওয়াইয়া, বিয়ের গীত, পালাগান, ছড়া, ধাঁধা ও প্রবাদ প্রবচন লোক সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। এগুলো মূলত অলিখিত সাহিত্য। পাড়াগায়ের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নরনারীর রস পিপাসা মিটানোর তাগিদেই এর সৃষ্টি। এগুলো মানুষের মুখে মুখে সৃষ্টি হয়েছে, মুখে মুখেই চলে এসেছে। এর রচয়িতারা চিরদিন লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে গেছে। আধুনিককালে এগুলোকে বইয়ের পাতায় বন্দি করা হলেও বহুকাল ধরে তা গ্রামের পথে ঘাটে নরনারীর মুখে মুখে বিচরণ করছে। মেহেরপুরের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত লোক কাহিনীগুলো মূলত সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্টি। এগুলোতে তত্ত্ব কথা বা শিক্ষনীয় কিছু নেই। বরং স্থূল হাস্যরসসহ আদিরস বিদ্যমান। বেশিরভাগ কাহিনী বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীন। রাজা-রানী, জ্বিন-ভূত, রাক্ষস-খোক্ষস, সিংহ-বকরী, বোকা-পাগল, এই ধরনের অতি পরিচিত কাহিনীগুলোই লোক সাহিত্যর ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। এমনই একটি লোকসাহিত্য হাপু গান। বর্তমান প্রজন্ম জানেন না বা শোনেননি হাপুগানের কথা।
মেহেরপুরের কুতুবপুর ইউনিয়নের বরকত আলী গ্রামে গ্রামে ‘হাপু গাবো পয়সা পাবো’ গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। বয়সের ভারে আর হাপু গেতে না পেরে ভিক্ষেবৃত্তিই তার জীবনজীবিকা। বর্তমানে মেহেরপুরের কোন গ্রামের কেউ আর হাপুগেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেনা। বিভিন্ন অঞ্চলে এই হাপু গান বিভিন্ন নামে পরিচিত। অঞ্চলভেদে এটি ‘হাপু’, ‘হাবু’ অথবা ‘হাফু’ নামে পরিচিত। তবে সর্বজনীনভাবে ‘হাপু’ নামটিই যথার্থ। ‘হা’ শব্দের অর্থ হা-অন্ন, বা হাহাকার এবং ‘পু’ শব্দের অর্থ পূরণ। অর্থাৎ প্রাকৃতিক সম্পদচূত্য মানুষ গান গেয়ে তাঁরা নিজেদের হাহাকার বা কষ্ট পূরণ করত, অর্থাৎ হৃতসর্বস্বের হাহাকারই এই হাপু গান।
সাধারণত দুইজন লোক একসঙ্গে এই গান গেয়ে থাকে। একজনের হাতে মদিরা বা গোপীযন্ত্র থাকে, আর একজনের হাতে ছোট একখানি লাঠি। লাঠিধারী লোকটি গান গায় এবং তার সঙ্গী লোকটি ধুয়া ধরে। মুখে শব্দ-সহ পিঠে লাঠির আঘাত করে ওই গান গাওয়ার রীতি। ধুয়া গাবার পদ্ধতিটি একটু অদ্ভুত। এক পদ করে গান গায়, আর মুখে একপ্রকার শব্দ করে নিজের পিঠেই লাঠি দিয়ে তাল ভাজে। অবিশ্রাম লাঠি চালনার ফলে অনেকের পিঠে কালশিরা দাগ পড়ে যায়। কতকটা নমস্কারের ভঙ্গিতে লাঠিটা হাত দিয়ে ধরে থাকে। হাপু গানের মধ্যে সমাজ জীবনের ছবি তুলে ধরে। একই সঙ্গে গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিকাঠামোর একটি প্রেক্ষাপট পাওয়া যায়। ওই লোকগান বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।
বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলাদেশের সঙ প্রসঙ্গ’ নামক বইয়ে বলা হয়েছে- বেদে/হাপু গানের নানান উদাহরণ পাওয়া যাবে। এই গানে তাল রাখতে ঘুঙুর, খঞ্জনি আর ডাবকি ব্যবহৃত হত। দ্রুত উচ্চারনের জন্য (যাকে আজকের ভাষায় র্যাপ বলে) গানের আগে মুখে এক ধরনের শ্বাস নেওয়ার ধরণটাই হাপু গানের নিজস্ব ধারা। মহিলা আর ছোটছোট ছেলেমেয়েরা বগল বাজিয়ে, হাত দিয়ে শরীরের নানান অঙ্গে আঘাত করে বিচিত্র শব্দ তুলে, নানান অঙ্গভঙ্গীকরে গান পরিবেশন করেন ।
চিরকালের মতই মধ্যবিত্ত বিশেষজ্ঞরা হাপুকে মোটাদাগের, অশ্লীল বা অশ্রাব্যসহ নানান ধরণের উচ্চসাংস্কৃতিক অভিধা দিয়েছেন। তবুও বলা যায় হাপুর তুলনা হাপুই। তথাকথিত অশিক্ষিত-অমার্জিত জনগণই দেশের সংস্কৃতির হকদার, রক্ষাকর্তা। যে সব মানুষ এধরনের সংস্কৃতিকে মোটাদাগের, অশ্লীল বা অশ্রাব্যবলে গালি পাড়ে, তারাই নিজের দেশের সম্পদের প্রতি অশ্রদ্ধাজ্ঞাপণ করছেন। মুখে এক অদ্ভুত রকম আওয়াজ করে, একটা লাঠির বাড়ি পিঠে মারতে মারতে গাওয়া গানই আমাদের হাপু গান। কয়েকটা হাপুগানের নমুনা
ক) জামাই এলো কামাই করে খেতে দিব কী?
হাত বাড়িয়ে দাও গামছা মুড়কি দি।
উড়কি ধানের মুড়কি দেব পাতে জল খেতে।
জ্যোষ্টি মাসে ছাতা দেব রোদে পথে যেত।
খ)হাপু রে হাপু
হাপু গেল মাঠে,
হাঁকে বাজার গেল।
আঁকুর গাছে পাকুর পাতা
রোদে ঝিলমিল করে গো,
বাবুদের আছে জোড়াকল
সে কলে পানি পাবো গো।
হাটে গেলাম বাজারে গেলাম
কিনে আনলাম আদা,
আদা খেয়ে হাঁদুর বাবা হাগে গাদা গাদা ।
গ) কটাতে কোটিতে ঝগড়া লেগেছে
কোটি কটাকে খুব মেরেছে,
এই শুনে কোটি আত্মহত্যা করেছে।
হাপু আতা পাতা লো,
হাপু সর্ষে পাতা লো,
হাপু আম খাবি জাম খাবি,
তেঁতুল খাবি লো,
তেঁতুল খেলে প্যাট গুলোবে ছেলে হবে না,
হাপু কাকে খেলে লো,
হাপু ক্যা ঝাড়নি লো,
হাপু বেদের মাকে লো
ই ডাঙাড়ে ঐ ডাঙাড়ে শালিক বস্যেছেঁ
বেদের মাকে বিয়া করতে পাল্কী আস্যেছেঁ
ঘ)বুড়াতে বুড়িতে লড়াই লাগ্যেঁছে
বুড়া কপালে বুড়ি পাদ্যেঁ দিয়েঁছে
হা ফুঃ কদম ফুঃ
ঙ) হাই লো বামুন দিদি
বাগদি ঠাকুরঝি
আমি কেলে গয়লার বেটার
ঠিয়ে কখন হাঁস্যেছি-
হাঁস্যেছি বেশ করেছি
তর বাপের কী
যখন ছিলাম ছ‘বছরের
তখন উঠে নাই গা
এখন আমি বছর তেরো
হব ছেলের মা
মাছ ধরতে গিলাম আমি
কুঁয়ে লুদির কুলে
দেখি এ্যাক মিনসে
রসির লাগর
ডাঁড়া ফেলছে চারে
জলে নেমে জাল ছাঁকি
আর মিনসে থাকে চেঁয়ে
ভাল কেনা তুই ঢ্যামনা মিনসে
থানা কেনা চেয়ে
তাকে দেখে উচএ যাব
নইক তেমন মেয়ে
মাছ ধরছি চিংড়ি চাঁদা
গচি মাগুর গাগর
কার্তিক মাসে মাছের রসে
বলবো কি বুন বলবো কিলো
আমার প্যাট হয়েঁছে ডাগর
খোসার দুম খোলাক দুম
কাঁথা চাপা দিঁয়ে মারব ঘুম।
একটা সময় হাপু গান গাইতেন বেদে, মালসহ ভ্রাম্যমান জীবন যাপন করা সম্প্রদায়। মেহেরপুরের আমঝুপি গ্রামের রফিকুল ইসলামের কাছে শুনেছিলাম হাপুর এই বাণি। এঁদের গানে আরও চমৎকৃত হওয়ার উপাদান রয়েছে।
এই গান কিছু গবেষকদের মতে বেদনা, দুঃখ ও হাহাকারের গান। কিন্তু কিছু গবেষকদের মতে হাবু গান মানুষের প্রতিবাদের গান। কারণ এর মধ্যে দুঃখ-বেদনার কথা থাকলেও, তার প্রতিবাদও আছে। সামাজিক সম্মান লাভ থেকে যারা বঞ্চিত , সেই সকল মানুষের এগুলো প্রতিবাদী গান। তাদের দুঃখ, কষ্ট, হাহাকার এইগুলি পূরণ করাই হল এই গানের মূল উপজীব্য। হাপু যে গায় সে নিজের পিঠে লাথি দিয়ে তাল ভাঁজে। অবিরাম পিঠে লাথি চালানোর ফলে পিঠে অনেক দাগ পড়ে যায়। কখনো কখনো কেটে যায়, কিন্তু সেই দুঃখ-কষ্ট তারা পরোয়া করে না। তারা মনে করে তাদের এই দুঃখ-কষ্ট সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের তুলনায় নগণ্য। হাবু গানের মধ্যে আছে সমাজ জীবনের বিভিন্ন অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক জীবনের ছবি। সেগুলো দেখার-বোঝার দৃষ্টিশক্তি, বোধবুদ্ধি আমরা হারিয়ে ফেলছি।
লেখক: সাংবাদিক ও একাধিক বইয়ের লেখক।