রেখা রানী বিশ্বাস। বয়স ৪০। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকরে খোরদো শাখা থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ঋণ নেওয়ার মাস দুয়েক পরেই কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে ঘরবাড়ি, মাঠের ফসল পানিতে ডুবে যায়। গ্রামের অন্যদের সঙ্গে রেখা রানী স্বামী সন্তান নিয়ে আশ্রয় নেন পাকুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
দু’দিন পরেই আশ্রয় কেন্দ্রে রেখা রানীর কাছে কিস্তির জন্য হাজির হন গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীরা। বসে থাকেন রাত ১০টা পর্যন্ত, ভয় দেখান থানা-পুলিশের। এক পর্যায়ে গ্রামীণ ব্যাংকের মাঠকর্মীর কাছ ঋণ গ্রহীতা রেখা রাণী প্রশ্ন করেন, ঋণী সদস্য মারা গেলে তার কিস্তি কে দেয়? মাঠকর্মী বলেন, তার ঋণ মাফ করে দেওয়া হয়। ঠিক পর দিনই আশ্রয় কেন্দ্রের পাশে কাঁঠাল গাছে রেখা রানীর ঝুলন্ত লাশ দেখা যায়। এই গল্পটি ২০০৮ সালে গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছিলেন ওই আশ্রয় কেন্দ্রের অন্য বাসিন্দারা।
এরকম গল্প আমাদের দেশে অহরহ। ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রামের জোবরা গ্রাম থেকে ক্ষুদ্র ঋণ ছড়ানোর পর আজ পর্যন্ত কত রেখা রানী আত্মহত্যা করেছেন তার কোন গবেষণা হয়নি। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কেন মানুষকে আত্মহত্যা করতে হয় এই কারণ কেউ খুঁজে বের করেনি। কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণের বাজার বড় হয়েছে । এক গ্রামীণ ব্যাংককে অনুসরণ করে সারাদেশে হাজার দুয়েকের বেশি প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
এখন আরও একটি গল্প বলবো। গল্পটি ২০০৭ সালের। এর আগের বছর বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য দেখিয়ে ড. ইউনূস এবং তার গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাই এই কনসেপ্টের ফলাফল সরেজমিনে দেখতে বাংলাদেশে এসেছিলেন ডেনিশ ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা টম হেইনম্যান। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ফিল্ম তৈরির জন্য ঢাকার অদূরে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতা জাহানারা নামে এক নারীর সাথে দেখা করেন তিনি। হেইনম্যান যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেই ওই নারী তার ঝুপড়ি বাড়িটি বিক্রি করে দেন। কারণ তিনি ঋণের কিস্তির চাপ সহ্য করতে পারছিলেন না।
সে সময় জাহানারা বর্ননা করেছিলেন কিভাবে গ্রামীণ ব্যাংকসহ বিভিন্ন মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশনের ঋণ কর্মকর্তাদের দ্বারা ভয়ভীতি, হয়রানি এবং খারাপ ব্যবহারের শিকার হয়েছিলেন তিনি। এরপর আরও কয়েকবার কলাকৌশলীসহ টম হেইনম্যান বাংলাদেশে এসেছিলেন জাহানারার অবস্থা জানতে। কিন্তু তাকে খুঁজে পাননি। পরে তিনি স্থানীয় সাংবাদিকেদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সাংবাদিকরাও জাহানারার খোঁজ দিতে পারেননি। আমাদের প্রথম গল্পের রেখা রানী তো মরে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু জাহানারা কোথায় তা আজও কেউ জানে না।
পরে বাংলাদেশ, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মেক্সিকোর ওক্সাকা রাজ্যের দরিদ্র মানুষদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে তৈরি হয়েছিল ফিল্ম ‘দ্যা মাইক্রো ডেবিট’। হেইনম্যানের সেই ফিল্মে জাহানারার সাথে সাক্ষাৎকার ছিল প্রথমে। এতে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারীরা বেশিরভাগেরই বিভিন্ন এনজিও এবং মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশনে অসংখ্য ঋণ নিয়েছেন। অনেকে পুরানো ঋণ শোধ করতে নতুন ঋণ নেওয়ার আশঙ্কার কথা জানান। কেউ কেউ ৩০-২০০% পর্যন্ত বার্ষিক সুদ শোধ করার কথাও বলেন। তাদের বর্ণনায় উঠে আসে চরম সামাজিক চাপ এবং সাপ্তাহিক কিস্তি আদায়ের নিষ্ঠুরতার চিত্র।
গ্রামীণ ব্যাংক যেখান থেকে শুরু সেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের জোবরা গ্রামে যায় হেইনম্যানের কলাকুশলীরা। স্থানীয়দের সহায়তা সেখানে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতা এবং আশপাশের মানুষজনের সাথে কথা বলেন তারা। এতে ওঠে আসে গ্রামীণ ব্যাংকের অমানবিক আচরণ এবং মিথ্যাচারের ভয়ঙ্কর সব তথ্য। তথ্য চিত্রে বলা হয়, ১৯৯৫ সালে হিলারি ক্লিনটন পরিদর্শনে গিয়ে ৬০ জনকে ঘর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে দেওয়া হয় ৫ থেকে ৬ জনকে। জোবরা গ্রামে ঋণ গ্রহীতার সংখ্যা ৫০ থেকে ৮০ জন। তাদের মধ্যে সফল হন মাত্র ৪ থেকে ৫ জন। তাদের অনেকে ভিটেমাটি বিক্রি করেছে, কেউ ঘরের চালের টিন বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
এই ফিল্মে সাক্ষাৎকার দেন বাংলাদেশের নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির, বেসরকারি সংগঠন অ্যাকশন এইড ইন্টারন্যাশনালের শহিদুর রহমান এবং অর্থনীতিবিদ কাজী খলিকুজ্জামান। বক্তব্যে নিউ এজ সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ক্ষুদ্রঋণে সুদের হার ৪০-১২৫%। যেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে সুদের হার ১৩-১৪%। ক্ষুদ্রঋণ অনেক বড় ব্যবসা বলেও আখ্যায়িত করেন তিনি। হেইনম্যানের ফিল্মে অ্যাকশনএইড ইন্টারন্যাশনালের শহিদুর রহমান বলেন, ক্ষুদ্রঋণে রিটার্নের পরিমান অনেক বেশি। আর খলিকুজ্জামানের মনে করেন কিস্তি দিতে গিয়ে অন্যান্য মৌলিক বিষয় যেমন- স্যানিটেশন, শিক্ষা, সুষম খাবার চাহিদা পূরণ করতে পারে না ঋণ গ্রহিতারা।
নব্বইয়ের দশক থেকে পরবর্তী দুই দশক দারিদ্র্য দূরীকরণের সমাধান হিসাবে বাংলাদেশে আসে ক্ষুদ্রঋণ। পাড়ায় পাড়ায় নারীরা জোটবদ্ধ হয়ে সমিতির সদস্য হন। এনজিওগুলোর প্রশিক্ষিত মাঠ কর্মীদের যুক্তির কাছে পরাজয় মানতে বাধ্য হন তারা। জামানত ছাড়া ঋণের বিষয়টিকে ব্রান্ডিং করা হয় ক্ষুদ্রঋণে। সমিতির সদস্যদের বলা হয় গ্রামীণ ব্যাংকে সুদের হার ২৬-৩১%। আপত দৃষ্টিতে এই সুদের হার কিস্তি অনুপাতে কম মনে হলেও চক্রবৃদ্ধির কারনে তা বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
আর আমাদের গণমাধ্যমের তথ্য খবর অনুযায়ী ক্ষুদ্র ঋণব্যবস্থা বাড়ায় রেখা রাণী ও জাহানারাদের সংখ্যা। কারণ আর কিছু নয়, একসময় যখন তথ্য প্রযুক্তি সুবিধা ছিল না, তখন এসব বিষয় সহজে জানতে পারতো না তৃণমূলের মানুষ। ঋণ নেয়ার পর থেকেই শুরু হতো কিস্তি শোধের সপ্তাহ গণনা। কয়েকজনের গ্রুপ করে ঋণ দেয়ায় কখনও কখনও একজনের কিস্তি অন্যকে শোধ করতে হতো। দেখা যায় ঋণের টাকা তোলার সাথে সাথে অনেকের কাছ থেকে কেটে নেওয়া হতো গ্রুপের অন্য সদস্যদের কিস্তির টাকা। এই বিষয়গুলো উঠে আসে হেইনম্যানের ছবিতে। ‘দ্যা মাইক্রো ডেবিট’ নামে ওই তথ্যচিত্রে মূলত হেইনম্যান বলতে চান, ক্ষুদ্রঋণকে অনেক বড় এবং মহৎ সামাজিক ব্যবসা হিসেবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বহির্বিশ্বে প্রচার করা হয়। দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অনুদান আনা হয়। এদিয়ে বাড়ানো হয় এনজিওর পরিধি। গত ১০ বছরে তথ্য প্রযুক্তির প্রসারে ক্ষুদ্র ঋণের তাণ্ডব কিছুটা কমলেও এখনো এর প্রভাব কমেনি।