বিএনপির জ্বালাও পোড়াও রাজনীতির অবসান হবে কবে? এই প্রশ্নটিই বর্তমান লেখাটির শিরোনাম করা হয়েছে! বিএনপি ইতোমধ্যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দলীয় সম্পৃক্ততার কারণে অনেকে স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করলেও কানাডার আদালতের রায় এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
এখবর এখন পক্ষে-বিপক্ষের সবারই জানা যে, কানাডার আদালত পঞ্চমবারের মত বিএনপি-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে আখ্যায়িত করে রায় দিয়েছে। সেই বিএনপি গত ২৮ অক্টোবর (২০২৩) ঢাকায় তাদের মহাসমাবেশ থেকে রাজনৈতিক সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়। ‘পলিটিক্যাল ইকোনোমি অব এনার্জি ট্রঞ্জিশন’ এর প্রফেসর ফ্রাঁসোয়া ব্যাফোইল সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের রাজনীতির সাথে ‘হ্যালুসিনেশনের’ মিল খুঁজে পেয়েছেন।
যদিও ২৮ তারিখে সমাবেশ করার অনুমতি নেয়ার সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে ‘শান্তিপূর্ণ’ সমাবেশ করা হবে বলে অঙ্গীকার করেছিল বিএনপি নেতৃত্ব। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল দায়িত্বপালনরত একজন পুলিশ সদস্যের ওপর লাঠি হাতে বোধশূন্য উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বেধড়ক পেটানো শুরু করে।
বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন। সমগ্র এলাকা এবং তার আশে-পাশে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো ছিল। ফলে, যেসব ঘটনা ঘটেছে সেইসব কিছুই সিসিটিভির ভিডিওতে ধারণ করা হয়েছে।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক পুলিশ সদস্য মুমূর্ষু অবস্থায় ফুটপাতে পড়ে আছেন। পাশের গলি থেকে কয়েকজন বেরিয়ে এলো এবং একজন হাতের লাঠি দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা সেই অসহায়, আহত পুলিশ সদস্যকে ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে পেটাতে থাকল। হতভাগ্য সেই পুলিশ সদস্য দুর্বলভাবে হাত নাড়াচ্ছেন। অর্থাৎ তখনও বেঁচে আছেন। মুহূর্তেই লাঠি হাতে ছুটে এলো আরও অনেকে এবং লাঠি দিয়ে নৃশংসভাবে পেটাতে থাকল। কেউ একজন সেই পুলিশ সদস্যকে কোপাতে থাকে। নিথর পড়ে থাকা একজন মানুষকে অনেকে মিলে উন্মাদের মতো আঘাতের সেই দৃশ্য অসহনীয়! কিন্তু আঘাতকারীদের মধ্যে কোনো দ্বিধা বা দয়ার উদয় হয় নাই। ঢাকা মহানগর পুলিশের কনস্টেবল আমিরুল ইসলাম পারভেজকে যে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করল বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা, টেলিভিশনের পর্দায় সে দৃশ্য দেখে চোখের পানি আটকাতে পেরেছে, এমন লোক কমই আছে। পারভেজের পিতা সেকান্দার আলী মোল্লা ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ভাবতে অবাক লাগে স্বাধীন বাংলাদেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে দায়িত্বপালন করতে যেয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়!
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, মাটিতে পড়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে অনেকে। কেউ কেউ মুখে ইটের টুকরো দিয়ে বারবার আঘাত করছে; শরীরের ওপর উঠে লাথি মারছে। পুলিশ সদস্যের ওপর নিষ্ঠুরভাবে লাঠি ও চাপাতি দিয়ে যারা করেছে তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজেরই লোক। সহিংসতার উন্মত্ততায় মেতে ওঠা এইসব লোক আমরা যে সমাজে বসবাস করি সেই সমাজেরই একটি অংশ। তারা বিএনপি-জামায়াত-এর নেতা-কর্মী। ভাবতে কষ্ট হয়, নির্মম এসব লোক আমাদেরই সমাজের! যে সমাজে এমন মানবিকতাবিহীন লোকেরা ঘুরে বেড়ায়, সেই সমাজ নাগরিকদের জন্য কতটা বিপজ্জনক আর ঝুঁকিপূর্ণ! সেই চিন্তা আমাদের ভীত আর বিপর্যস্ত করে তোলে!
বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ২৮ অক্টোবর ২০২৩ তারিখ শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দলটির নেতা–কর্মীরা সহিংসতায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। এসময় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালনরত পুলিশ, আনসার ও অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর দলটির নেতাকর্মীরা আক্রমন করে। দায়িত্বপালনরত অবস্থায় এক পুলিশ সদস্যসহ ২ জন নিহত হন। গুরুতর আহত একজন আনসার সদস্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে মৃত্যুবরণ করেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাকরাইল, মতিঝিল, মগবাজার, হাইকোর্ট মোড়, বিজয়নগর ও আরামবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি ও জামায়াত এর নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে একজন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত তিনশ’ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৪১ জন পুলিশ সদস্য এবং ১৮ জন সাংবাদিক রয়েছেন। সংঘর্ষ চলাকালে কাকরাইলে পুলিশ বক্স ও বিভিন্ন স্থানে অন্তত দেড় ডজন গাড়িতে আগুন এবং দুই ডজন যানবাহন ভাঙচুর করে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা।
এদিকে মহাসমাবেশের দিন বিকেলে মালিবাগ ফ্লাইওভারের ওপর বলাকা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। ওই বাসে আগুনের ঘটনাটি ধারণ করা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, যুবদল নেতা রবিউল ইসলাম নয়ন একটি বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরা অবস্থায় বাসটির পাশে ঘুরছেন। বুলেট প্রুফ জ্যাকেটে ‘প্রেস’ লেখা রয়েছে। তার হাতে একটি লাঠি। সঙ্গে বেশ কয়েকজন যুবক।
‘পলিটিক্যাল ইকোনোমি অব এনার্জি ট্রাঞ্জিশন’ এর প্রফেসর ফ্রাঁসোয়া ব্যাফোইল তার ‘দ্য পলিটিক্স অব ডেস্ট্রাকশন’ গ্রন্থে ইউএসএসআর, পোল্যান্ডের পিআইএস পার্টি এবং ইসলামিক স্টেট-এর কর্মকান্ড যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সে অনুযায়ী বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ভিত্তিক রাজনীতির ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেতে পারে। সামাজিক বিজ্ঞানে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড মনোবিশ্লেষণমূলক পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডভিত্তিক রাজনীতির হোতারা ‘স্থান এবং সময়ের’ রেফারেন্স ধ্বংস করে(যেমন ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার নমুনা ধ্বংস করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট); এর পরিবর্তে সন্ত্রাসীদের মূল হোতাগণ তাদের পছন্দমত কোনকিছু দিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা দাঁড় করে থাকেন; এবং আশ্রয়ের জন্য ক্ষতাবান ব্যক্তিদের ভালবাসা বা ঘৃণার ভাব বুঝে সামাজিক স্থানগুলিতে তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের নিযুক্ত করে থাকে। কানাডার আদালত কর্তৃক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত বিএনপির বেলায়ও তেমনটি লক্ষ্য করা যেতে পারে। তাদের কৃত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে অস্বীকার এবং এটিকে অন্য উপায়ে পুনরুৎ্পাদন করে, যা স্বপ্নদ্রষ্টার (যেমন বিএনপির লন্ডনস্থ নেতা) ইচ্ছার সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সামঞ্জস্য বিধান করে। একারণে সন্ত্রাসীদের থেকে উদ্ভূত রাজনীতির সাথে একটি হ্যালুসিনেশনের (যার অর্থ অমূলক বা বিভ্রান্তির )অনেক মিল রয়েছে। এই বিশ্লেষণের পরে আমরা এই উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে, অতীতের ন্যায় বিএনপি তাদের বর্তমানের জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি পরিত্যাগ করবে না। এর জন্য তারা ভিন্ন ব্যাখ্যা এবং তাদের সেই মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক ব্যাখ্যার সমর্থন তারা দেশের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও পাবে। যেমনটি ইউএনএইচসিআর ২৮ অক্টোবর ২০২৩ বিএনপি-জামায়াত কর্তৃক সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে বিভ্রান্তিকর এবং মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করছে!এই পরিস্থিতিতে সঠিক ঘটনা যথাযথভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরে বিএনপি-জামায়াতের মুখোশ খুলে দিতে হবে।
লেখক: সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।