⇒বিভিন্ন স্থানে সড়কে নিহত আরও ৯ জন
⇒ ২৭২ দিনে সড়কে ঝরল ২২১৪ প্রাণ
কয়েকদিন পর এসএসসি পরীক্ষা শুরু। এ উপলক্ষে সোমবার রাজধানীর ওয়ারী উচ্চবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের পরীক্ষার্থীদের জন্য বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করে। এতে যোগ দিতে যাওয়ার সময় ওয়াসার পানিবাহী লরির চাকায় পিষ্ট হয়ে চিরবিদায় নেয় এসএসসি পরীক্ষার্থী আবির হোসেন (১৬)।
তার মৃত্যুর সংবাদে বিদ্যালয়ের আনন্দ-উৎসবে মুহূর্তেই নেমে আসে বিষাদের ছায়া। শোকে স্তব্ধ হয়ে যান তার মা-বাবাসহ স্বজন। প্রতিবাদে সহপাঠীরা নেমে আসে রাস্তায়। তারা যাত্রাবাড়ী-বঙ্গভবন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। ঘটনার পর লরি ও এর চালককে আটক করেছে পুলিশ।
সকালে বাবার সঙ্গে ওয়ারীর জয়কালি মন্দির এলাকার বাসা থেকে বের হয় আবির। পরে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলের পথে রওনা হয় সে। বিদায় অনুষ্ঠানে অংশ নেবে, তাই স্কুল ড্রেসের বদলে পরেছিল পাঞ্জাবি-পায়জামা। বন্ধুদের সঙ্গে বলধা গার্ডেনের পাশের সড়ক দিয়ে ঘুরে যাচ্ছিল আবির।
বলধা গার্ডেনের উত্তর পাশের গেটের সামনে ওয়াসার পানির পাম্প। সেখান থেকে পানি নেয়ার পর বেপরোয়া গতিতে থাকা ওয়াসার লরিটি তাকে ধাক্কা দেয়। আবির সড়কে পড়ে গেলে তার মাথার ওপর উঠে যায় লরির চাকা। সঙ্গে থাকা সহপাঠী ও এলাকাবাসী লরিচালক চুন্নু মিয়াকে (৪৯) আটক করে। পরে আবিরকে পুলিশের সহায়তায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ওয়ারী থানার এসআই জহির হোসেন প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জানান, দুপুর ১২টার দিকে পানির পাম্প থেকে পানি নিয়ে ওয়াসার লরিটি মূল সড়কে উঠছিল। এ সময় আবিরকে চাপা দেয় লরিটি। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়।
ওয়ারী উচ্চ বিদ্যালয় ও আবিরের সহপাঠীদের সূত্রে জানা গেছে, বেলা ১১টায় বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনা ও বাৎসরিক মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সকাল থেকেই এসএসসি পরীক্ষার্থী ও অন্য শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে স্কুলে আসতে থাকে। শিক্ষার্থীদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মুখর হয়ে উঠছিল স্কুল চত্বর। কিন্তু আবিরের মৃত্যুর খবরে মুহূর্তেই শোকের ছায়া নেমে আসে।
আবিরের চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আবিরের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বড়ুরা উপজেলায় সোনাইমুড়ি গ্রামে। তার বাবার নাম হানিফ মিয়া। ১১ মাস আগে আবিরের মা নিলুফা বেগম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ৫ বছর আগে আবিরের বড় ভাই ফয়সাল আহমেদ রেজা পানিতে ডুবে মারা যান। ওয়ারীর ৫৩/৪ জয়কালী মন্দির এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকত সে।
তার বাবা নবাবপুরে মেশিনারি পার্টসের ব্যবসা করেন। ছেলের এমন মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল বাবা হানিফ মিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে বসে বুক চাপড়াচ্ছিলেন আর স্মৃতিচারণ করছিলেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আবির ওয়ারী উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। স্কুল থেকে বিদায় নিতে গিয়ে ছেলে আমার দুনিয়া থেকেই চিরবিদায় নিয়ে নিল।
তিনি বলেন, আমরা বাবা-ছেলে একসঙ্গে বাসা থেকে বের হই। আবির স্কুলের দিকে চলে যায়, আর আমি চলে যাই দোকানের দিকে। এরপর আমি আমার ছেলের দুর্ঘটনার খবর পাই। হানিফ মিয়া বলেন, তিন সন্তানের মধ্যে আবির ছিল সবার ছোট। মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর আবির অধিকাংশ সময় কাটাত তার বড় বোন আমেনা বেগমের বাসায়। আবিরকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। আমি আমার ছেলের ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগের (পূর্ব) ওয়ারী জোনের সহকারী কমিশনার তারিকুল ইসলাম জানান, ওয়াসার পানিবাহী লরিসহ (ঢাকা মেট্রো ঢ ১১-০১১৪) চালককে আটক করে ওয়ারী থানা হেফাজতে আনা হয়েছে।
এদিকে আবিরের মৃত্যুর খবর শুনে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে সহপাঠীরা। তারা যাত্রাবাড়ী-বঙ্গভবন সড়ক অবরোধ করে। পরে ওয়ারী উচ্চবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে তারা সরে গিয়ে স্কুলের সামনে মানববন্ধন করে। তারা দোষী চালকের শাস্তির দাবি জানায়।
ওয়ারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল কুদ্দুস সাংবাদিকদের বলেন, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনা ছাড়াও সোমবার স্কুলে বার্ষিক মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। মিলাদের পর পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্রও দেয়া হতো।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আসার কথা ছিল স্থানীয় এমপি কাজী ফিরোজ রশীদের। বেলা ১১টার পর অনুষ্ঠান শুরু হয়। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ পর আবিরের দুর্ঘটনার সংবাদ আমরা জানতে পারি।
এ খবর শুনেই আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আবিরকে শনাক্ত করি। আমরা আবিরের সহপাঠীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, ওয়াসার গাড়িটি বেপরোয়া গতিতে চলছিল। আবিরের মৃত্যুর কারণে স্কুলের সব কর্মসূচি বন্ধ রাখা হয়। সেখানে কেবল আবিরের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল করা হয়। এদিকে ওয়ারী থানা সূত্রে জানা যায়, এ ঘটনায় আবিরের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হতে পারে।
বিভিন্ন স্থানে নিহত ৯ : এদিকে রোববার রাত থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় আরও ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ২৭২ দিনে সড়কে প্রাণ গেল ২২১৪ জনের। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
নেত্রকোনা : সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের সতরশ্রী এলাকায় সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টায় ট্রাক ও মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে অসীম রায় (২৮) নামে এক শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় হৃদয় ও মুরাদ নামে দুজন আহত হয়েছেন।
কুমিল্লা : বুড়িচংয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় সাকিবা জাহান নামে এক ছাত্রী নিহত হয়েছে। সোমবার দুপুরে কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের উপজেলার রামপুর এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত সাকিবা (৭) ওই এলাকার এতবাপুর গ্রামের শাহজাহান মিয়ার মেয়ে।
নগরকান্দা (ফরিদপুর) : সালথায় ট্রাকের ঢালার চাপায় হেল্পারের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সকালে উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের ফুকরা গ্রামে ট্রাক থেকে ইট নামানোর সময় এ ঘটনা ঘটে। নিহত জসিম মোল্লা (৩২) ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার খলিল মণ্ডলহাট এলাকার ইকরাম মাতুব্বর ডাঙ্গী গ্রামের ইছাহাক মোল্লার ছেলে।
বগুড়া : শেরপুরে যাত্রীবাহী বাসের চাপায় জেসমিন আকতার (৩৫) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার দুপুরে উপজেলার গাড়িদহ এলাকায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক পার হওয়ার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। জেসমিন আকতার শেরপুর উপজেলার গোসাইপাড়ার সোহেল রানার স্ত্রী।
লক্ষ্মীপুর : ইটবাহী ট্রাক্টর ট্রলির চাপা পড়ে চালকের সহযোগী (হেলপার) রাজু আহমেদ (১৯) নিহত হয়েছেন। সোমবার দুপুরে লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের সুতার গোপ্টা এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত রাজু সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরমনসা গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে।
মেহেরপুর : গাংনীতে পৃথক দুর্ঘটনায় জেবা খাতুন (৯) নামের এক শিশু শিক্ষার্থী নিহত ও ৭ জন আহত হয়েছে। সোমবার দুপুর ১টায় গাংনী উপজেলার ইকুড়ি ও ছাতিয়ান এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত জেবা রাইপুর ইউনিয়নের ইকুড়ি গ্রামের জসিমের মেয়ে।
টেকেরহাট (মাদারীপুর) : গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে পিকআপ ভ্যান উল্টে এক মাছ ব্যবসায়ী নিহত ও তিনজন আহত হয়েছেন। সোমবার ভোরে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উপজেলার দিগনগর ইউনিয়নের বিশ্বমবরদীতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত নাছির মোল্যা (৩৮) গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার উলপুর গ্রামের আউয়াল মোল্যার ছেলে।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : কলাপাড়া-কুয়াকাটা সড়কের নীলগঞ্জ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুরে মোটরসাইকেল উল্টে জুয়েল রানা (২৬) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। তিনি কলাপাড়া পৌর শহরের রহমতপুর এলাকার সোহরাব হোসেনের ছেলে।
কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) : কমলগঞ্জে ট্রলি থেকে পড়ে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার বিকাল সাড়ে ৫টায় আদমপুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রাম এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
সুত্র-যুগান্তর