অগ্নিদুর্ঘটনায় প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হচ্ছে। প্রাণহানি হচ্ছে অসংখ্য মানুষের। করোনা মহামারির মধ্যেও গত বছর ২১ হাজার ৭৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ২৪৬ কোটি টাকার বেশি। সবচেয়ে বেশি সাত হাজার ৭২৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগে।
ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটিসহ বিভিন্ন চুলা থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তিন হাজার ৫৬৪টি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে তিন হাজার ৪৬৫টি অগ্নিদুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। আর মোট অগ্নিকাণ্ডের ৭০ শতাংশেরও বেশি (১৪ হাজার ৭৫৮টি) ঘটেছে এই তিনি কারণে। সবচেয়ে বেশি আগুন লেগেছে বাসাবাড়ি ও আবাসিক ভবনে। ২০২০ সালের অগ্নিদুর্ঘটনায় নারীর প্রাণহানির সংখ্যা পুরুষের দ্বিগুণেরও বেশি। আর আহতও হয়েছে বেশি পুরুষ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় প্রতি বছরই চুলা, বিদ্যুৎ ও বিড়ি-সিগারেট থেকে সর্বোচ্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। গেল বছর চুলা থেকে সৃষ্ট আগুনে ক্ষতি হয়েছে ৩০ কোটি ৯৫ লাখ ৫৬ হাজার ৮৫০ টাকার সম্পদ। বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে লাগা আগুনে ১০১ কোটি ২৩ লাখ ৯৩ হাজার ১০৮ টাকা এবং বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরোর আগুনে ক্ষতি হয়েছে ১৪ কোটি ২০ লাখ ৯ হাজার ৬২৬ টাকার সম্পদ।
২০১৯ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বছরটিতে কেবল তিন কারণে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি হয়েছে ২৭৯ কোটি ৮৯ লাখ ৪০ হাজার ৮৬ টাকার সম্পদ। ওই বছর ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডে মোট ক্ষতি হয় ৩৩০ কোটি ৪১ লাখ ২৮ হাজার ৭৪৪ টাকার সম্পদ।
জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, বাসাবাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে হচ্ছে। এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী সচেতনতার অভাব। আর কলকারখানাগুলোতে বিল্ডিং কোড না মানার ফলে অগ্নিকাণ্ড বাড়ছে। শর্টসার্কিটের অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে বড় ব্যবসায়িক ভবনে ফায়ার স্টপার লাগানো এবং সব ভবন বা বাসাবাড়িতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখারও পরামর্শ দেন তিনি। নতুন ভবন নির্মাণে বিদ্যুৎবিষয়ক প্রকৌশলীদের সার্বক্ষণিক তদারকির উপরেও জোর দেন এ বিশেষজ্ঞ। বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো ও চুলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি। গত বছর অগ্নিদুর্ঘটনার জন্য অজ্ঞাত কারণসহ মোট ২০টি কারণ উল্লেখ করেছে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে খোলা বাতির ব্যবহারে ৩৬৯টি দুর্ঘটনা ঘটে। উত্তপ্ত ছাই ও জ্বালানি থেকে ৫৪৫টি, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলায় ৭২০টি, যন্ত্রাংশের ঘর্ষণজনিত কারণে ১৪১টি, শত্রুতামূলক বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক ১৮০টি, বজ পাত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ৯৮টি, বাজি পোড়ানো থেকে ৫০টি, মাত্রাতিরিক্ত তাপ/উচ্চতাপ থেকে ৯৪টি, মেশিনের মিস ফায়ার থেকে ১৭৩টি, স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বালন থেকে ২৩টি, চিমনির স্ফুলিঙ্গ থেকে ৩৩টি, স্থির বিদ্যুৎ থেকে ১৬টি, রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে ১২টি, বিস্ফোরণ (সিলিন্ডার, বয়লার ইত্যাদি) থেকে ১৩৫টি, গ্যাস সরবরাহ লাইনে আগুনে ৭২২টি, যানবাহনের দুর্ঘটনাজনিত কারণে ২৫৯টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। এর বাইরে অজ্ঞাত ও অন্যান্য কারণে দুই হাজার ৭৪৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
গত বছর অগ্নিকাণ্ডে পুরুষের চেয়ে নারীর মৃত্যু হয়েছে বেশি। বছরটিতে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৫৪ জনের। এর মধ্যে পুরুষ ৪৮ জন আর নারী ১০৬ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ২৯৩ জন পুরুষ এবং ৭৮ জন মহিলা। এর বাইরে ফায়ার সার্ভিসের ১৫ কর্মকর্তা ও কর্মচারী আহত হয়েছেন। ২০১৯ সালে অগ্নিকাণ্ডে মোট নিহত হন ১৮৪ জন এবং আহত হন ৫৬০ জন। বছরটিতে ফায়ার সার্ভিসের একজন নিহত এবং ২৬ জন আহত হন।
আগুন লাগার ২৯ ধরনের স্থানের কথা উল্লেখ করেছে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে বাসাবাড়ি ও আবাসিক ভবনে সর্বোচ্চ ছয় হাজার ১৫০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বহুতল ভবনে ১৪২টি, রান্নাঘরে দুই হাজার ৪৮৪টি, শপিংমল ও মার্কেটে ৪২৮টি, হাট-বাজারে ৬৭২টি, দোকান (মুদি ও টংসহ) এক হাজার ৮৮৪টি, পোশাক শিল্প-প্রতিষ্ঠানে (রপ্তানিমুখী) ১৭৭টি, পোশাক শিল্প-প্রতিষ্ঠানে (স্থানীয়) ৯৬টি, পোশাক শিল্প ব্যতীত অন্য কলকারখানায় ৩৮৩টি, পাটগুদাম ও পাটকলে ৮০টি, কেপিআই-এ ২০টি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬৫টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে (মসজিদ, মন্দির, গির্জা ইত্যাদি) ৩৩টি, ব্যাংক-বীমা ও অন্যান্য অফিসে ৯৬টি, হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁয় ২১১টি, হাসপাতাল-ক্লিনিক-ফার্মেসি-ল্যাবে ৯০টি, বেজমেন্টে ১৮টি, বস্তিতে ১০৯টি, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও উপকেন্দ্রে ৮৬টি, নৌযানে (জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার ইত্যাদি) ২১টি, ট্রেনে চারটি, গাড়িতে (স্থলপথে চলে এমন সব যান) ২৮২টি, গ্যাসলাইন ও গ্যাস সিলিন্ডারে ৯৫৭টি, বয়লারে ২০টি, এসিতে ৩২টি, বন-জঙ্গলে ১৪৮টি, গোশালা ও খড়ের গাদাসহ এ ধরনের স্থানে তিন হাজার ৯১টি অগ্নিকাণ্ড হয়। এর বাইরে অন্যান্য স্থানে তিন হাজার ২৯৪টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে।