‘বিদ্রোহী’ একটি অবিস্মরণীয় কবিতার নাম। ১৯২১ সালে তৎকালীণ বৃটিশশাষিত বিশাল ভারতবর্ষে এই একটি কবিতা সকলকে বিস্ময়কর ভাবে নড়ে-চড়ে বসতে বাধ্য করেছিলো। মাত্র একুশ বছর বয়সে রচিত এই কবিতার মাধ্যমে সারা ভারত বর্ষে এক ধুমকেতুর মতো আলোকবিচ্ছুরণে বিস্ময়কর আত্মজাগরণ হয় এক মহান কবি’র; নাম-কাজী নজরুল ইসলাম। তার অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ নামের এই অনবদ্য কবিতার নামেই সকলের কাছে পরিচিতি পেলেন ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে। তারপর থেকে পাদ-প্রদীপের আলোয় উঠে আসা এই কবি একটানা লিখে চললেন দেশের স্বাধীনতার পক্ষে আর গণমানুষের নিপীড়ন, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে।
তার লেখার প্রায় প্রতিটা কবিতার পরতে-পরতে উঠে এলো তৎকালীন সারাভারত বর্ষের মুক্তি দাবির পাশাপাশি সাম্যের বাঁধনে মানবমুক্তির উদাত্ত আহ্বান। সেই সাথে তার লেখনীতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনবদ্য ফসল হিসেবে উঠে এসেছেÑসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতারোধে প্রাসঙ্গিক নানান বিষয়াবলী এবং বিশ্বমানবমুক্তি আর ভালোবাসার জন্য অসামান্যসব লেখনী, কবিতা-গান। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ। বিশ্বমানবতার উপর নিপীড়ন, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে অগ্নিকণ্ঠে সোচ্চার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২১তম জন্মজয়ন্তী।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার বাণীতে বলেন, ‘কবি কাজী নজরুল অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখতেন, তা বাস্তবায়নে আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্রোহী কবির জীবনাদর্শ অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ, সুখী-সমৃদ্ধ ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে।
কবির এবারের এ জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিদের্শনা অনুসারে করোনা ভাইরাস সংক্রমন জনিত কারণে জনসমাগম এড়িয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে জাতীয়ভাবে এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি গ্রহন করেছে। এর মধ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সংস্কৃতিমন্ত্রণালয় নির্মান করেছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘জাগো অমৃত পিয়াসী’।
আজ রোববার সকাল এগারটা হতে বিটিভিসহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে একযোগে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হবে। এর আগে সকাল ১১টায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্যে শুরু হবে দিনের আনুষ্ঠানিকতা। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম-আজকের এই দিনে-বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দ’র ১১ জ্যৈষ্ঠ (ইংরেজি ১৮৯৯ সাল) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানাধীন চুরুলিয়া গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে আসা কবির জন্ম। বাবা কাজী ফকির আহমেদ ও মা জাহেদা খাতুন। দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। সে নামের সঙ্গে সুবিচার (!) করতেই যেন শৈশবে পিতৃহারা হন মানবতা আর সাম্যের এই কবি। পিতার অকাল মৃত্যুতে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি শিশু বয়সেই মক্তবে শিক্ষকতা, হাজি পালোয়ানের মাজারে খাদেম এবং মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ করতে শুরু করেন। এরপরও কবিকে নানা বাধার দুর্লংঘ্য পর্বত পাড়ি দিতে হয়েছিল। এরই মাঝে একদিন সকলকে চমকে দিয়ে বাংলার সাহিত্যাকাশে দোর্দণ্ড প্রতাপে আত্মপ্রকাশ করেন কবি।
কবিরুপে নজরুলের এ অভ্যূদয় কেবল ধুমকেতুর সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পর্কে যথ্যার্থই বলেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
সময়ের পথপরিক্রমায় মানুষের চেতনায় আঘাত করে দেশ-প্রেম আর সত্যের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তোলার বিস্ময়কর ক্ষমতা লালন করতেন বলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্যায়-অবিচার, দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মূর্ত প্রতীক। কবি তার জ্যোর্তিময় লেখনিতে বারবার তুলে এনেছেন বাঙালির মেধা-মনন ও অস্তিত্বের জগত ; অসম্প্রদায়িক বাঙালিত্ব, প্রেম, দ্রোহ আর মানবতা। পরবর্তীতে জ্যোর্তিময় অসম্প্রদায়িক এই কবি হয়ে উঠলেন-প্রেম, দ্রোহ আর মানবতার কবি। মানবানুভূতির এই ত্রয়ী বন্ধনের বাইরেও তার সৃজনে উঠে এসেছে বিপ্লব আর সাম্যের বাঁধনে মানবমুক্তির উদাত্ত আহ্বান।
বাংলার সাহিত্য আকাশে অগ্নিবীণা হাতে ধূমকেতুর মতোর আবির্ভাবের কবি নজরুলের ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তার কাব্য-সংকলন ‘অগ্নিবীণা’। এই কাব্য-সংকলন বাংলা কবিতায় সৃষ্টি করে এক নতুন ধারা। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে ; ‘প্রলয়োল¬াস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’, ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ইত্যাদি। নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল ‘বাউন্ডুলের আত্নকাহিনী’। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার লেখা অন্যান্য গদ্যের মধ্যে রয়েছে ‘হেনা’, ‘ব্যাথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়; যার নাম ‘ব্যথার দান’। এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন ‘যুগবাণী’ও প্রকাশিত হয়।
নজরুলের সাহিত্যকর্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ্যযোগ্য হলো তার গান। কবির লেখা গানসমূহ এখন ‘নজরুলগীতি’ নামে পরিচিত। তার এসব গানের মধ্যে ভক্তিমূলক গান, প্রণয়গীতি, প্রকৃতি বন্দনা, দেশাত্নবোধক গান, রাগপ্রধান গান, হাসির গান, ব্যাঙ্গাত্মক গান, সমবেত সঙ্গীত, রণ সঙ্গীত এবং বিদেশীসুরাশ্রিত গানসহ দশটি ভাগে বিভাজ্য হয়েছে। তিনি তার সীমিত কর্মজীবনে তিন হাজারেও অধিক গান রচনা করেছেন।
পৃথিবীর কোনো ভাষায় একক হাতে এত বেশি সংখ্যক গান রচনার উদাহরণ নেই। এ সকল গানের বড় একটি অংশ তারই সুরারোপিত। তার রচিত ‘চল চল চল, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল’ বাংলাদেশের রণসঙ্গীত। তার কিছু গান জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে গানের মালা, গুল বাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। পরবর্তীকালে আরও গান সংগ্রন্থিত হয়েছে। তবে তিনি প্রায়শ তাৎক্ষণিকভাবে লিখতেন; একারণে অনুমান করা হয় প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের অভাবে বহু গান হারিয়ে গেছে। এছাড়া, কাজী নজরুল গান রচনাকালে ১৯টি রাগের সৃষ্টি করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জš§ দেন। এটি হল ইসলামী সংগীত তথা গজল। নজরুল প্রায় তিনহাজার গান রচনা এবং সুর করেছেন; যা এখন নজরুল সংগীত নামে পরিচিত। মধ্যবয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। এক সময় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
এই মানসিকভারসাম্যহীন কবিকে ১৯৭২ সালের ২৪ মে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ উদ্যোগে সপরিবারে ভারতে থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তখন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন এবং জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দেন। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়।
একই সালে কবির ছোট ছেলে ও বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৬ সালে কবি নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয় তাকে। তৎকালীন প্রধান আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে তার হাতে দিয়ে আসেন। সেখানেই কবির শেষ দিনগুলো কাটে। সে বছরের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার জীবনকাল ৭৮ বছর হলেও ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দুঃসহ নির্বাক জীবন কাটিয়েছেন।
তার মৃত্যুর পর তার লেখা গান-‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই’ কথাকে বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়ে তাকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে।
ধ্যানে-জ্ঞানে, নিশ্বাসে-বিশ্বাসে, চিন্তাচেতনায় পুরোদস্তুর অসাম্প্রদায়িক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখনও দুই বাংলায় সমভাবে সমাদৃত। তার প্রসঙ্গে ওপার বাংলার কবি অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নিকো নজরুল/এই ভুল টুকু বেঁচে থাক/বাঙালি বলতে একজন আছে/দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।
মেপ্র/এমএফআর