সারাবিশ্বে আতঙ্ক ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী পাঁচ হাজার ৪০৩ জন মানুষ মারা গেছে। করোনাভাইরাসের আগেও পৃথিবীতে আরও বেশ কয়েকটি ভাইরাসের দেখা মিলেছিল। এসব ভাইরাসে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে করোনা হচ্ছে সবচেয়ে দ্রুতগামী সংক্রামণ ভাইরাস।
ভাইরাস কি?
মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে যে ক্ষুদ্র দানব, তার নাম ‘ভাইরাস’। লাতিন শব্দ ‘ভাইরাস’–এর অর্থ ‘বিষ’। অতি ক্ষুদ্র হলেও এসব ভাইরাসের আছে ভয়ংকর মারণক্ষমতা।
আমাদের অনেকেরই জানা আছে, শুধু বিশ শতকেই গুটিবসন্ত প্রাণ কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের। বর্তমানে এই ভাইারাস নিয়ন্ত্রণে নেয়া সম্ভব হয়েছে।
আরেকটি বিভীষিকার নাম স্প্যানিশ ফ্লু। ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সালের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণে প্রাণ হারায় পাঁচ থেকে দশ কোটি মানুষ। যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন শতাংশ।
পৃথিবীতে ছয়টি ভাইরাসকে সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই ছয় ভাইরাসের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। আসুন জেনে নেই পৃথিবীতে মহামারি সাত ভাইরাস সম্পর্কে-
ইবোলা ভাইরাস
ঘাতক ভাইরাসের শীর্ষে আছে ইবোলা ভাইরাস। ইবোলা ভাইরাস সংক্রমিত মানুষের রক্ত, লালা বা যেকোনো নিঃসৃত রস থেকে কিংবা শরীরের ক্ষতস্থানের মাধ্যমে অপরের শরীরে সংক্রামিত হয়ে থাকে।
এখন পর্যন্ত এর ছয়টি প্রকরণ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশের বেশি হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনতে পারলে তাকে বাঁচানো সম্ভব।
এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রথম দেখা যায় ১৯৭৬ সালে। একই সঙ্গে নাইজার, সুদান, ইয়াম্বুকু ও রিপাবলিকান কঙ্গোতে। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে ইবোলা মহামারিতে আফ্রিকার পশ্চিমাংশের দেশগুলোতে ১১ হাজার ৩৩৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।
২০১৯ সালে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ইবোলা ভাইরাসে ২ হাজার ৯০৯ জন আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। আক্রান্তদের মধ্যে ১ হাজার ৯৫৩ জন প্রাণ হারায়। এখনও এই ভাইরাসের কোনো কার্যকর প্রতিষেধক তৈরি করা যায়নি।
রেবিজ ভাইরাস
রেবিজ ভাইরাস নিউরোট্রপিক। এই ভাইরাস প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। এ ভাইরাসের সংক্রমণে হওয়া রোগটির নাম জলাতঙ্ক। ভাইরাসটি সরাসরি মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করে ও স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত করে। মস্তিষ্কে রেবিজ ভাইরাস যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখনই রেবিজের লক্ষণগুলো দেখা দিতে থাকে। লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে তীব্র খিঁচুনি ও পক্ষাঘাতে রোগীর মৃত্যু হয়।
প্যারিসের পাস্তুর ইনস্টিটিউটের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর সারাবিশ্বে জলাতঙ্কের আক্রমণে প্রাণ হারায় ৫৯ হাজার মানুষ। সংক্রমিত প্রাণীর লালায় রেবিজ বা জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাস বিচরণ করে।
সেসব প্রাণী মানুষকে কামড়ালে মানুষ সংক্রামিত হয়। তবে এই রোগের ভ্যাকসিন থাকলেও সঠিক সময়ে চিকিৎসার না দেয়ার কারণে অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস
এই ভাইরাসটি মিউট্যান্ট। ডাচ ভাইরোলজিস্ট রন ফুচিয়ে গবেষণাগারে বার্ড ফ্লু ভাইরাসকে রূপান্তরিত করেন। এ ভাইরাসটি মারাত্মক সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন।ভীষণ বিপজ্জনক বিধায় ২০১১ সালে আমেরিকান বায়োসফটি এজেন্সি (এনএসএবিবি) এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণা ও প্রকাশনার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ২ লাখ ৯০ হাজার থেকে সাড়ে ৬ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য এইচ৫ এন ১ (H5 N1) রূপান্তরিত ও মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা দায়ী।
মারবুর্গ
মারবুর্গ ভাইারাস ইবোলা ভাইরাসের চেয়ে কম মারাত্মক। জার্মানির একটি শহরের নামে এই ফিলোভাইরাসের নামকরণ করা হয়েছে। উচ্চ মারণক্ষমতা অর্থাৎ প্রায় ৮০ শতাংশ আক্রান্ত মানুষ এ ভাইরাসে মারা যায়। মারবুর্গ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে পঞ্চম বা সপ্তম দিনে সংক্রমিত ব্যক্তির
প্রচণ্ড জ্বর এবং সেই সঙ্গে রক্তবমি, মলের সঙ্গে রক্ত, নাক, দাঁতের মাড়ি এবং যোনিপথে মারাত্মক রক্তক্ষরণ হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহ অসুস্থতার পরে পুরুষদের মধ্যে অর্কিটিস নামক অণ্ডকোষের প্রদাহও দেখা দিতে পারে। তবে এই ভাইরাস খুব সহজে সংক্রমিত হয় না।
ডেঙ্গু
বাংলাদেশে প্রতিবছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ মারা যায়। এসিড মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়ে থাকে। ডেঙ্গুর আরেকটি নাম আছে, তা হলো ‘ট্রপিক্যাল ফ্লু’।
ডেঙ্গু ভাইরাস সাম্প্রতিককালে ইউরোপেও হানা দিয়েছে। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ১৪১টি দেশে আনুমানিক ৩৯ কোটি ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ডেঙ্গু জ্বরে প্রায় পাঁচ লাখ ব্যক্তি মারাত্মক রক্তক্ষরণকারী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় প্রাণ হারায় প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।
এইডস
সারাবিশ্বে রয়েছে এইচআইভি। এই ভাইরাসটি পোষক কোষে আট থেকে দশ বছর পর্যন্ত ঘাপটি মেরে থাকতে পারে। এই ভাইরাস মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, এইডস মহামারি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে সাত কোটি মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছে। আর প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ এইচআইভিতে মারা গেছে।
যৌন সম্পর্কের ফলে অপরজনের শরীরে সহজেই প্রবেশ করবে এই রেট্রোভাইরাস। এইডস আক্রান্ত রোগীর শরীরে ফোটানো সূচ থেকেও এই অসুখ সংক্রমিত হয়।
অসুখ আক্রান্ত প্রসূতির সন্তানের শরীরেও এইডস হতে পারে। সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ যৌন জীবন রয়েছে এমন পেশাদারদের ক্ষেত্রে এই অসুখের প্রভাব বেশি থাকে।
ঘন ঘন জ্বর হ্ওয়া ও এক-দেড় মাস ধরে একটানা জ্বর। জ্বরের সঙ্গে গলায় অস্বাভাবিক ব্যথা হয়। খাবার খেতে ও গিলতে সমস্যা হয়। ঘুমের মধ্যেও তীব্র ঘাম হয়। শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে শুরু করে বলে অল্পেই বমি ভাব, পেটের সমস্যা দেখা যায়।
নভেল করোনা (Covid-19)
চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস সারাবিশ্বে আতঙ্ক ছাড়িয়েছে। করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী পাঁচ হাজার ৪০৩ জন মানুষ মারা গেছে। করোনাভাইরাসের একটি প্রকরণ নভেল করোনা (Covid-19)। এই ভাইরাসের এখনও কোনো টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি।
তথ্যসূত্র: ব্যানিয়ার্ড এসি ও ট্রুডো এন, ‘রেবিজ প্যাথজেনেসিস অ্যান্ড ইমিনোলজি’, ২০১৮