আজ ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নিবেদিত এক প্রাণের নাম সদানন্দ। তিনি পরিবেশ রক্ষায় কথা বলেছেন খোলামেলা। সদানন্দের মতে পরিবেশের সুস্থতার সাথে পাখিদের সম্পর্ক সুগভীর। এক কথায় একটি সূচক। ছোট ঘাস ফুলের পরাগায়ন থেকে উদ্ভিদের বংশবিস্তার এবং সার্বিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় তাদের প্রভাব প্রকৃতির বিস্তৃত ক্ষেত্র জুড়ে। নদী-জলাশয়-ঘাসবন-প্লাবনভূমিতে সমৃদ্ধ আর ভারতীয় সীমান্তবর্তী বনাঞ্চলের সৌন্দর্যমণ্ডিত মেহেরপুরে পাখির সমৃদ্ধি বিশেষ উল্লেখের দাবিদার; তবে তা অনেকটাই আড়ালে রয়ে যাওয়া। এই অঞ্চলের পাখিদের প্রতি ভালোবাসা আর সংরক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে যারা এগিয়ে এসেছেন- সেরকমই একজন সদানন্দ মন্ডল। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক, মনে-প্রাণে একজন প্রকৃতিপ্রেমি ও পাখি পর্যবেক্ষক।
মেহেরপুরে সদরে ডিসি অফিস সংলগ্ন কর্মস্থলের পাশেই ছিলো ভৈরব নদী। অফিসের জানলা দিয়েই নদীপাড়ের লাল-লতিকা হট্টিটির অনবদ্য খাবার খুঁজে খাওয়ার দৃশ্য এবং চাঁদনি রাতে মনকাড়া ডাক ভেসে আসতো অফিস কম্পাউন্ড অবধি। গভীর রাতে ভৈরব নদের পন্ডের ঘাটের বড় গাছগুলো থেকে খয়রা মেছোপ্যাঁচার গম্ভীর কণ্ঠে “হুউম-হুউম” ডাক শোনা যেত। সেই ২০০৩ সাল থেকে পাখির প্রতি ভালোবাসা তাঁর মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। শুরু করেন প্রকৃতিতে পাখি চেনার চেষ্টা। মেহেরপুর সদর এবং মুজিবনগর উপজেলায় এ পর্যন্ত তিনি ১৬১ প্রজাতির পাখি শণাক্ত করেছেন।
পাখি পর্যবেক্ষণের স্মৃতিচারণায় তিনি বলেন, মেহেরপুর সদর উপজেলায় বিসিক শিল্প নগরীর উল্টোদিকে টাংগার মাঠের কথা বিশেষভাবে উল্লেযোগ্য। শীতে এখানে সর্বাধিক ধুসর মাথার টিটি, গোল্ডেন প্লোভার, গ্রে প্লোভার পাখিদের দেখা মেলে। দেশীয় পাখিদের মধ্যে, শামুখ খোল, মেটে বুক ঝিলি, জলমুগরী, পানকৌড়ির আদর্শ আবাস্থল। বিসিকের পাশেই খড়ের ঘাস বনে সারাবছরই প্রাণবন্ত; প্রিনা, ভোমরা ছোটনের মতো ঘাস পাখিরা সারা বছরই কলরবে মুখরিত করে রাখতো। তেরোঘরিয়া বিলও মেহেরপুরের প্রেক্ষাপটে দুর্লভ পাখিদের আশ্রয়স্থল ছিলো। পানকৌড়ি, মেটে হাঁস, সরালীদের বড় এক আবাস্থল। তালসারির তালগাছে দেশী বাবুইয়ের বাসা ঝুলে থাকতো, আমবাগানে দেখা মিলতো পাপিয়া, লালপাড় ঘুঘু। মুজিবনগর আম্রকাননে সারাবছরই বাংলা কোকিল, বেনেবউ, গরমে পাপিয়া দের ডাকে ম-ম করতো। আমঝুপি নীলকুঠির পুরানো গাছগুলোর কোঠরে বাস করতো কুঠুরে পেঁচা, মেছো পেঁচা এবং দুর্লভ বাফি ফিশ আউল। পুরোনো রেইন-ট্রি গাছের মাথায় সকালে ফুল খেতে আসতো প্লাম-হেডেড প্যারাকিটদের ঝাঁক।
অভিজ্ঞ এই পাখিপ্রেমিক দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে যুক্ত আছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সঙ্গে। বিগত ৩ বার জাতীয় পর্যায়ে শীতের পাখি শুমারিতে অংশ নিয়ে তিনি ছুটে গেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে- ভোলার উপকূলীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২০২০ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরে। বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের জীব বৈচিত্র রক্ষাকারী সংগঠন বা বিবিসিএফ এর একজন সদস্য এবং পাখি ও পরিবেশ রক্ষায় বিবিসিএফ এর সাথে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এছাড়া নিজেও গ্রামীন পর্যায়ে পাখিদের আবস্থাল গুলোতে চাষীদের, জনগনকে এবং বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের পাখিদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন, সুযোগ পেলেই তাদের গুরুত্ব বোঝান।
শিক্ষক হিসেবে তার হাত ধরে পাখি দেখায় এগিয়ে আসছে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। ২০১৭ সালে ক’জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি দল “কিচির-মিচির”। আজ সেখানে যুক্ত হয়েছেন পাখিদের ভালোবাসেন এমন অনেকে। নিয়মিত পাখি পর্যবেক্ষণ, শিকার রোধে স্থানীয় মানুষদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি সহ নানাভাবে অবদান রেখে চলেছেন তাঁরা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পাখি রক্ষার জন্য কাজ করা সহজ নয়। তিনি জানান, অপরিকল্পিত উন্নয়ন পাখির গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থলগুলোর উপরে আঘাত হানছে। টাংগার মাঠে মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন এবং পাশের কাজলী খালের পানি স্বল্পতা ও কাদা তৈরি না হওয়ায় শীতে তেমন পাখি দেখা যায় না। গৌরিনগর মাঠেও নিবিড় চাষাবাদে, কীটনাশক প্রয়োগে কীটপতঙ্গ কমে যাওয়ায় অনেক পাখি কমে গেছে। এ অঞ্চলের একাংশ মানুষ এখনও পরিবেশে পাখির গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ। ফাঁদ পেতে শিকার, গুলটি ব্যবহার ও ফলজ গাছে ক্ষতিকারক মিহি জালের ব্যবহার পাখিদেরকে বিপদাপন্ন করে তুলছে এবং সবমিলিয়ে ঝুঁকিতে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জমিতে এক ধরণের গাছ লাগানোতে পাখিদের খাবার, কীটপতঙ্গের বৈচিত্রের অভাবে অনেক প্রজাতি কমে যাচ্ছে।
সদানন্দ বলেন, একটি প্যাঁচা গড়ে প্রতিদিন একটি করে ইঁদুর খেয়ে জীবদ্দশায় দশবছরে ৩,৬৫,০০০ টাকার ফসল রক্ষা করে অপরদিকে ঠিক একই মূল্যে পরিবেশের বড় অংশ জুড়ে বাস্তুতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। সুতরাং কোন অঞ্চলে পাখি কমা বা বিলুপ্তি সেই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও পরিবেশকে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। মেহেরপুরের দৃষ্টির আড়ালে ও অবহেলিত পাখিদের আবাসস্থলগুলো সংরক্ষণে এগিয়ে আসার সময় এখনই।
লেখক: জৌষ্ঠ সাংবাদিক ও গ্রন্থ প্রণেতা