নারী নির্যাতনসহ সব ধরনের অপরাধ রোধে পুলিশ নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। এ কৌশলের নাম দেয়া হয়েছে ‘বেস্ট প্র্যাকটিস’। এর আওতায় জিডি, মামলা, গ্রেফতার বা রিমান্ডের আসামি, ডিবির কার্যক্রম, তদন্ত নিষ্পত্তি, পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্সসহ সার্বিক দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতর থেকে সারা দেশে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে এসব নির্দেশনা দেয়া হয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সূত্র জানায়, এক বছর ধরে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ বেস্ট প্র্যাকটিস কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। নীতিটি অবলম্বন করে ইতোমধ্যে ঢাকা রেঞ্জ ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। এ কারণে এটি পুলিশ সদর দফতর গ্রহণ করেছে। পরে ঢাকা রেঞ্জের বেস্ট প্র্যাকটিস কার্যক্রম পর্যালোচনা করে তা অনুসরণ করার জন্য সম্প্রতি পুলিশের অন্য ইউনিটকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
নতুন কৌশলের আওতায় প্রতিদিন সকাল ৯টার মধ্যে ২৪ ঘণ্টার সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলার বিষয় সংশ্লিষ্ট থানাকে সার্কেল অফিসে পাঠাতে হবে। প্রতিদিন সকাল ১০টার মধ্যে সার্কেল অফিসার তার অধীন থানাগুলোর মামলা-জিডি পর্যালোচনা করে নির্দেশনা দেবেন। নির্ধারিত ছক অনুযায়ী বেলা ১১টার মধ্যে মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দফতর বা রেঞ্জ অফিসে মামলা-জিডির তথ্য পাঠাতে হবে। রেঞ্জ অফিস বা মেট্রোপলিটন সদর দফতর থেকে অভিযোগকারীকে ফোন করে জানতে চাওয়া হবে- তিনি কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন কিনা, মামলা-জিডি করতে কোনো অর্থ দিতে হয়েছে কিনা, থানায় তাকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে কিনা। একটি নির্দিষ্ট সময় পর অভিযোগকারীকে ফোন করে জানতে চাওয়া হবে- তিনি যে প্রতিকার বা আইনগত সহায়তা পাওয়ার জন্য মামলা-জিডি করেছিলেন তা পেয়েছেন কিনা। তদন্ত কর্মকর্তার গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে বাদীর কাছ থেকে তথ্য নেয়া হবে। তদন্তের কোনো পর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তাকে অর্থ দিতে হয়েছে কিনা তাও জানতে চাওয়া হবে।
বেস্ট প্র্যাকটিস অনুযায়ী, তদারক কর্মকর্তারা (সার্কেল অফিসার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপার) সারেজমিন মামলার তদন্ত করছেন কিনা তা বাদীর কাছে জানতে চাওয়া হবে। মাস শেষে মামলার বাদীর কাছ থেকে তদারকির বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য উপকমিশনার (ডিসি) বা এসপির কাছে পাঠানো হবে। পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বাদীকে কোনো ধরনের হয়রানি করা হয় কিনা সে বিষয়ে বাদীকে মেট্রোপলিটন সদর দফতর বা রেঞ্জ অফিসের নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হবে। প্রথম ফোনকলের সময় বাদীকে মেট্রোপলিটন-রেঞ্জ অফিসের নম্বরটি সংরক্ষণ করে রাখতে বলা হবে। যেসব জিডির ক্ষেত্রে পুলিশের করণীয় বা আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিষয় থাকে সেসব ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো গাফিলতি বা অবহেলা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে উপকমিশনার বা পুলিশ সুপারের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নতুন নির্দেশনায় বলা হয়, প্রতিদিন সার্কেল অফিস থেকে ছক অনুযায়ী গ্রেফতার বা রিমান্ডে থাকা আসামিদের বিষয়ে তথ্য নেবে মেট্রোপলিটন-রেঞ্জ অফিস। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই আসামিদের নিকটাত্মীয়ের নাম ও ফোন নম্বর উল্লেখ থাকতে হবে। পরবর্তীতে মেট্রোপলিটন-রেঞ্জ অফিস থেকে আসামিদের নিকটাত্মীয়দের ফোন করা হবে। জানতে চাওয়া হবে- গ্রেফতারের পর বা রিমান্ডে থাকাকালে আসামি কোনো ধরনের নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হয়েছেন কিনা, ভয়-ভীতি দেখিয়ে আসামির আত্মীয়ের কাছ থেকে কোনো ধরনের অর্থ বা অন্য ধরনের সুবিধা নেয়া হয়েছে কিনা।
বেস্ট প্র্যাকটিসের নির্দেশনা অনুযায়ী, ডিবি পুলিশের কার্যক্রম সম্পর্কে মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দফতর ও রেঞ্জ অফিস পৃথকভাবে তথ্য সংগ্রহ করবে। ডিবি কার্যক্রমের তথ্যে অভিযানের সূত্রসহ গ্রেফতার বা রিমান্ডে থাকা আসামিদের নাম ও মোবাইল নম্বর থাকতে হবে। ডিবি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় যেসব গ্রেফতার ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে সেসব তথ্য সংগ্রহ করবে রেঞ্জ অফিস। মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে নির্দেশনায় বলা হয়- দুর্বল চার্জশিটের নাম করে আসামিদের কাছ থেকে কোনো ধরনের সুবিধা নেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, প্রতিদিন বেলা ১১টার মধ্যে সার্কেল অফিসের গত ২৪ ঘণ্টার কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। এ সংক্রান্ত ছকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, বিরোধ নিষ্পত্তি এবং টেলি-পুলিশিংসহ সার্কেল অফিসারের কার্যক্রম উল্লেখ থাকতে হবে। মাদক দ্রব্য আইনে মামলা হলে রেঞ্জ অফিসের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে মাস শেষে তথ্য নেবে মেট্রোপলিটন-রেঞ্জ অফিস। মুলতবি মামলার তালিকা পর্যালোচনাকালে কোনো মামলা মেডিকেল সার্টিফিকেটের জন্য মুলতবি থাকলে সেজন্য সার্কেল অফিসার ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনায় বলা হয়- সফটওয়্যারের মাধ্যমে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স মনিটরিং করতে হবে। আবেদন ফরম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সফটওয়্যারে অ্যান্ট্রি দিতে হবে। আবেদনকারী কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হলে রেঞ্জ বা মেট্রোপিলটন সদর দফতরের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পারলে তদন্ত কর্মকর্তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।
পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নিরাপত্তায় মেট্রোপলিটন কমিশনার ও রেঞ্জ ডিআইজি অফিস থেকে দেয়া ছক অনুযায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সব সার্কেল তার এলাকার সব মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের এজেন্টের নাম ও যোগাযোগের ঠিকানা রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করবেন। থানার ওসিরাও একই ধরনের রেজিস্ট্রার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। প্রতি থানা এলাকায় কমপক্ষে একবার সব এজেন্টদের সঙ্গে বৈঠক করবেন ওসি। ব্যাংকের নিরাপত্তার জন্য মেট্রোপলিটন সদর দফতর বা রেঞ্জ ডিআইজি অফিস থেকে নিরাপত্তা ছক প্রত্যেক ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ছক অনুযায়ী নিরাপত্তা কার্যক্রম তদারকি করতে হবে। ব্যাংকের ম্যানেজারদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা সভার আয়োজন করতে হবে। ব্যাংকের নৈশপ্রহরী ও নিরাপত্তারক্ষীর মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা সংরক্ষণ করে যোগাযোগ রাখতে হবে। ব্যাংক ম্যানেজারদের সঙ্গে মাসে অন্তত একবার নিরাপত্তা সভার আয়োজন করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান যে বেস্ট প্র্যাকটিস পন্থা উদ্ভাবন করেছেন সেটি পুলিশি সেবা হয়রানিমুক্ত করতে অত্যন্ত কার্যকর। এক সময় মামলা-জিডিতে অনেক অভিযোগ ছিল। এখন এ সংক্রান্ত অভিযোগ প্রায় শূন্যের কোটায়। মানুষ অনেক সহজে ভালো সেবা গ্রহণ করতে পারছে। পুলিশ সদস্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেছে।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা যুগান্তরকে বলেন, জনগণের পুলিশ হওয়ার জন্য আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে পুলিশের সব ইউনিট হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। এ কাজের জন্য ইতোমধ্যে বেশকিছু উদ্ভাবনী ধারণা বা বেস্ট প্র্যাকটিস আমাকে কাজে যুক্ত করা হয়েছে। এসব ধারণা পর্যালোচনা করে সবচেয়ে ভালোটিকে বেস্ট প্র্যাকটিস হিসেবে চিহ্নিত করে তা অনুসরণ করতে বিভিন্ন ইউনিটকে নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। তিনি আরও বলেন, আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।