ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মেহেরপুর জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই বীর এখন বার্ধ্যক্য জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন।
মেহেরপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের ৩য় তলার কেবিনে ১২ দিন যাবৎ চিকিৎসাধীন আছেন। ইসমাইল হোসেন ভাষা আন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিকভাবে নিজের জীবনের সোনালী দিনগুলো বিসর্জন করলেও আজ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। দুএকজন ছাড়া এই দু:সময়ে তাঁর কেউ খোঁজ রাখেনি বলে দু:খ প্রকাশ করেছেন পরিবারের সদস্যরা।
ইসমাইল হোসেন এর ছেলে আবু সাঈদ মোঃ ফারুক হোসেন বলেন, আমার পিতা মোঃ ইসমাইল হোসেন ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তিনি মেহেরপুরের একজন কৃতি সন্তান। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আপনারা আমার পিতা ভাষা সৈনিক মোঃ ইসমাইল হোসেন কে আমার থেকে বেশি চেনেন এবং জানেন। আজ তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্নিক্ষণে।
মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে আছেন। ওনাকে বার্ধক্য অক্টোপাসের মত চারিদিকে ঘিরে ধরে আছে। তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেন, মেহেরপুর জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনের কোন কর্মকর্তা এই ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিককের খোঁজ-খবর নেবার তাদের সুযোগ হয়নি। তাছাড়া হাসপাতালের সিভিল সার্জন,সুপার ও আরএমও তাদেরও একই অবস্থা। এই মানুষটি হাসপাতালের বারান্দায় দীর্ঘ ৬ দিন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন। মেহেরপুর এর সাংসদ ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এমপি জেনারেল হাসপাতালের আইসিও ওয়ার্ড উদ্বোধন করতে গেলে আমি ওনাকে অনুরোধ করি আমার বাবাকে এক নজর দেখে যাওয়ার জন্য কিন্তু ওনার সময় হয়নি আমার বাবর সাথে দেখা করার বা খোঁজ খবর নেওয়ার।
তবে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইয়ারুল ইসলাম, জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক এডভোকেট মিয়াজান আলী, গাংনী উপজেলার সাহারবাটি ইউনিয়নের নিহত সাবেক চেয়ারম্যান বজলুর রহমানের স্ত্রী গাংনী উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নুরজাহান বেগম ও মেহেরপুর পৌর মেয়র মাহফুজুর রহমানকে। সেই সাথে আমি ও আমার পরিবার আরও কৃতজ্ঞ তৃণমূলের আওয়ামী লীগ,যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের ছেলেদের কাছে। আমি ও আমার পরিবার মেহেরপুরের দলমত সকল শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে দোয়া প্রার্থনা করছি। তিনি যেন সুস্থ্য হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন। ওনার চলার পথে কোন ভুল ত্রুটি থাকলে সেগুলিকে ক্ষমা করবেন।
এ ব্যাপারে মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গাংনী উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ খালেক বলেন, ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন আমাদের শ্রদ্ধাভাজন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে ছিলেন। তিনি অসুস্থ এ বিষয়টি এই প্রথম জানতে পারলাম। অবশ্যই দলের পক্ষ থেকে আমরা দেখতে যাবো এবং একই সঙ্গে তার সুস্থতা কামনা করছি।
ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন বর্ণাঢ্য জীবনী ইসমাইল হোসেন স্কুলজীবন থেকেই দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সাথে জড়িয়ে পড়েন। বাংলা নয় উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানীদের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা প্রথম বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিল বের করে ছাত্র সংগঠন। পুলিশ সেই মিছিলে গুলি করে তাতে সালাম, রফিক, জব্বার সহ নাম না জানা অনেকে সেদিন নিহত হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
সেই প্রতিবাদে তিনি এই আন্দোলনে অন্যান্য ছাত্র দের সাথে মিছিলে জড়িয়ে পড়েন। তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। এই মিছিলে অংশগ্রহণ করার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে রাজটিকেট দিয়েছিলেন। পরে কোর্টের রায়ের উপর আদেশ প্রত্যাহার করে নেন স্কুল কর্তৃপক্ষ কিন্তু হারিয়ে যায় তার জীবন থেকে দুটি বছর। শুরু হয় ছাত্র রাজনীতি। তিনি ১৯৫৪ সালে ১ম মেহেরপুর মহাকুমা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৭ সালে মেহেরপুর মহাকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালে ছাত্র ও জনগণের ন্যায্য দাবীতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এজন্য তিনি কারাবরণ করেন। মুসলিম লীগের সেই দুঃশাসনের সময়গুলোতে ছাত্র সংগঠন, সুরক্ষা ও স্থায়ী আন্দোলন অব্যাহত ও সংক্রিয় রাখেন। জীবিকার তাগিদে ১৯৬৬ সালে ব্যাংকে চাকরি গ্রহণ করেন। নিয়োগ পান বগুড়া শহরে। কিন্তু চাকরি আর বেশিদিন করা হয়ে উঠে না। বগুড়ায় বঙ্গবন্ধুর জনসভা দেখতে গিয়ে সেদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর নজরে আসেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী চাকরি ছেড়ে মেহেরপুর জেলা কমিটি গঠন করতে মেহেরপুরে ফিরে এসেছিলেন।
১৯৬৮ সালে স্থায়ী মহাকুমা মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কঠোর পরিশ্রম, ঝুঁকি গ্রহণ ও অব্যাহত চেষ্টায় দলের নিস্তেজ সদস্যদের উজ্জ্বলিত করে এবং বহুসংখ্যক আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় দলকে গৌরবময় ও মর্যাদাদান প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। যা তৎকালীন নেতৃবৃন্দ বিষয়টি সকলেই অবগত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে ৬ দফা প্রচার কেন্দ্রিক জনজাগরণ ও আন্দোলনে মহাকুমার নেতৃত্ব দান করেন ও দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। সেই সময় স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের কোন সংগঠন ছিল না।
১৯৬৯ সালে মেহেরপুর মহাকুমার একমাত্র কৃষি ফার্ম (বারাদি) কৃষি শ্রমিকদের সংগঠিত করে শ্রমিক লীগ গঠন করেন এবং শ্রমিক লীগের উপদেষ্টা হিসেবে কর্তব্য পালন করেন। পরে সভাপতি নির্বাচিত হয়ে শ্রমিকলীগ সংগঠনকে আরো মজবুত ও গতিশীল করতে সক্ষম হন। ভাসানী ন্যাপের সাথে দলের বিরোধ সৃষ্টি হয় আন্দোলন ও সংঘর্ষের চরম রূপ এর প্রেক্ষিতে তাকে আবারও কারাবরণ করতে হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে দলীয় ভাবমূর্তির স্বপক্ষে এলাকায় গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। সকলের শ্রম ও সাধনা কাজে লাগিয়ে সেই দিন নির্বাচনে মেহেরপুর জেলার সকল আসনে দলীয় সকল প্রার্থীর বিজয় লাভ করেন। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এটা তার রাজনৈতিক জীবনের চরম পাওয়া।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল ইসমাইল হোসেনের। স্বাধীনতার শপথ পাঠ অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ সাহেবের নির্দেশে অধ্যাপক ইউসুফ আলী, জনাব নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী এমপি সাহেবদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার কথা স্মৃতির বড় সম্পদ।
১৯৭১ সালে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, দলীয় কর্মীদের সবাইকে নিয়ে চলে যান ভারতে। ভারত থেকে স্বাধীন যুদ্ধ সংগঠিত করতে জীবন উৎসর্গ শপথ নিয়ে নেমে পড়েন কাজে। ভারতের হৃদয়পুর যুবক্যাম্পে প্রথম দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মুজিবনগর সরকারের মনোনয়ন পেতে বেতাই যুবক্যাম্প কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে কুষ্টিয়া জেলা রেডক্রসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই একই বছরে মেহেরপুর জেলা যুবলীগের সভাপতি হন।
১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে বঙ্গবন্ধু জেলা বাকশালের ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে মনোনয়ন দান করেন। ১৯৮৯ সালে আওয়ামী লীগে ফিরে এসে ১৫ দলীয় জোট নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ওনার ২৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ২৪ বছর মেহেরপুর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে মেহেরপুর শহরে অবস্থিত কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল বিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক ও নারী শিক্ষা উন্নতি ও বিস্তারের জন্য শহরে মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।