আর কয়েক বছরের মধ্যেই মঙ্গলের আকাশ ভরে যাবে পৃথিবী থেকে পাঠানো অসংখ্য ড্রোনে। অন্তত ৫ থেকে ২০ কিলোগ্রাম ওজনের। না, অস্ত্র ফেলার জন্য নয়। কোথায় কী আছে? কোনও এলাকার আদতে উচ্চতা কত, কোথাও কোনও গহ্বর আছে কি না, লাল গ্রহের বিশাল এলাকাজুড়ে তার নজরদারি চালানোর জন্য। সেই ড্রোন থেকে মঙ্গলের বুকে নামা মহাকাশচারীদের জন্য ছুড়ে দেওয়া হবে গবেষণার নানা উপকরণ। অত্যাধুনিক যন্ত্রাদিও।
এবার নাসার পাঠানো সর্বাধুনিক রোভার ‘পারসিভের্যান্স’-এর সঙ্গে লাল গ্রহের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছে ‘ইনজেনুইটি’ নামে যে হেলিকপ্টার, তার মূল কর্ণধার চিফ ইঞ্জিনিয়ার জে বব বলরাম এ কথা জানিয়েছেন। পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরি (জেপিএল) থেকে আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে।
তিনি বলেন, ‘না এটা আর কোনও স্বপ্নের পর্যায়ে নেই। বাস্তবের দোড়গোড়ায় পৌঁছে গেছে। সেই লক্ষ্যে এবার প্রথম কোনও হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছে মঙ্গলে। যা ওড়ানো হবে লাল গ্রহের আকাশে। পৃথিবীর বাইরে এই প্রথম হেলিকপ্টার ওড়ানো হবে অন্য কোনও গ্রহে। সফল হলে শনি, বৃহস্পতির চাঁদেও ওড়ানো হবে হেলিকপ্টার, ড্রোন প্রাণের চিহ্ন খুঁজতে। আর সেগুলোর আকার হবে অনেক বড়। হবে অনেক ভারিও। এবার যে হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছে, ওজনে হবে তার ৩ গুণ থেকে প্রায় সাড়ে ৫ গুণ। ১১ থেকে ২২ পাউন্ড ওজনের।’
সেভেন সেকেন্ডস অব টেরর!
নাসার পাঠানো ২০২০ রোভার পারসিভের্যান্স লাল গ্রহের ‘জেজেরো ক্রেটারে’ পা ছোঁয়ানোর আড়াই মাস পর তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসবে বলরামের হাতে গড়া হেলিকপ্টার ইনজেনুইটি। তার পরের এক মাসে মোট পাঁচবার মঙ্গলের আকাশে উড়বে সেই হেলিকপ্টার। প্রতিবার দেড় মিনিটের জন্য। লাল গ্রহের পিঠ থেকে তা উড়বে সর্বাধিক ১০০ মিটার উচ্চতায়।
বলরাম বলেন, ‘‘পৃথিবী থেকে কোনও গ্রহ বা উপগ্রহে পৌঁছানোর পর মূলত তিনটি জিনিস হয়ে ওঠে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এন্ট্রি। সেই গ্রহ বা উপগ্রহের কক্ষপথে ঢুকে পড়া। দ্বিতীয়টি হলো, ডিসেন্ট। ধীরে ধীরে গতিবেগ কমিয়ে সেই গ্রহে বা উপগ্রহে নেমে আসা। আর শেষমেশ যেটি দরকার তা হলো, নিখুঁত ল্যান্ডিং। একেবারে ‘ফেদার টাচ’-এর মতো। যাতে অক্ষত ও সক্রিয় থাকতে পারে রোভার।
এটাকেই আমরা বলি ‘সেভেন মিনিট্স অব টেরর’। এই সময়েই সব স্বপ্ন চুরচুর করে ভেঙে যেতে পারে। আমাদের হেলিকপ্টারের রোভার থেকে বেরিয়ে ওড়া পর্যন্ত লাগবে ঠিক ৭ সেকেন্ড। এটাকে আমরা বলছি ‘সেকেন্ড সেকেন্ডস অব টেরর’। এবার আমাদের মঙ্গল অভিযানে এই তিনটি বিষয়েরই অগ্নিপরীক্ষা হবে। যা আগামী দিনে লাল গ্রহে মানুষের সফল পদার্পণের রূপরেখা তৈরি করে দেবে।’’
এ বারের অভিযানে পাঠানো হেলিকপ্টার সফল হলে ২০৩২-এই শনির চাঁদ টাইটানে পাঠানো হবে আরও বড় আকারের হেলিকপ্টার। ‘ড্রাগনফ্লাই’। তার মডেল, নামকরণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে ইতিমধ্যেই।
বায়ুই নেই প্রায়, উড়বে কীভাবে?
বলরামের কথায়, ‘বিজ্ঞান বলে, পৃথিবীতে ১ লাখ ফুট বা সাড়ে ৩০ হাজার মিটার উঁচুতে ওড়া আর মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে ওড়াটা কার্যত একই রকমের। কিন্তু পৃথিবীতে তো হেলিকপ্টার ওড়ে তার সাত ভাগের এক ভাগ উচ্চতা পর্যন্ত। তার বেশি উচ্চতায় তো পৃথিবীতে হেলিকপ্টার ওড়ানোর প্রযুক্তি করায়ত্ত হয়নি আমাদের। তার উপর আবার মঙ্গলের হেলিকপ্টারের কয়েক কিলোগ্রাম ওজনও থাকতে হবে। তার মধ্যে ভারী ব্যাটারি থাকবে যে। থাকবে যে যোগাযোগের জন্য রেডিও। তাদের ওজনটাকে তো আর উড়িয়ে দেওয়া যাবে না!’
সেই ভাবনা থেকেই ইনজেনুইটি হেলিকপ্টার বানাল নাসা। যার মূল স্থপতি হলেন বলরাম। সেই হেলিকপ্টারের ওজন দাঁড়াল ১.৮ কিলোগ্রাম (৪ পাউন্ড)। যার মাথার উপরে রয়েছে দু’টি ব্লেড বা রোটর। প্রত্যেকটির ব্যাস ৪ ফুট বা ১.২ মিটার।
সমস্যা আরও ছিল। পৃথিবীতে সেই হেলিকপ্টার পরীক্ষামূলক ভাবে ওড়ানো হবে কোথায়? পৃথিবীর কোথাওই তো বায়ুমণ্ডল মঙ্গলের মতো অত পাতলা ফিনফিনে নয়।
‘‘শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো ভ্যাকুয়াম চেম্বার আর জেপিএল-এ ২৫ ফুট লম্বা স্পেস সিম্যুলেশন চেম্বারে’’, বললেন বলরাম।
লোকে শুনলে হাসত, বলতো পাগল!
অন্য গ্রহে হেলিকপ্টার পাঠানোর স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল ৩১ বছর আগে। মাদ্রাজের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি)’ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশনের পর বেঙ্গালুরু শহরের সন্তান বলরাম আমেরিকার ‘রেনস্লার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট’ থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি করে তখন সবে কাজে যোগ দিয়েছেন নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরিতে। সেটা ১৯৮৫ সাল।
তখন থেকেই তার মাথায় ঘুরছে কী ভাবে ওড়া যায় মঙ্গলের আকাশে। আর ‘‘সেটা দু’এক জনকে বলতেই তাঁরা হো হো করে হেসে উঠছিলেন! বলছেন, এ আবার কি উদ্ভট ভাবনা! এটা কখনও সম্ভব হতে পারে? যত সব পাগলের কথাবার্তা!’’, বললেন বলরাম।
নাড়া দিল ইলান ক্রু-র বক্তৃতা
নাসার দু’টি এবং প্রযুক্তি সংক্রান্ত আরও পাঁচটি খেতাবজয়ী বলরাম বললেন, ‘‘তখন আমার একটা বছরও কাটেনি নাসায়। ওই সময় একটা বিজ্ঞান সম্মেলনে গিয়ে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইলান ক্রু-র একটি বক্তৃতা শুনি। তাতে তিনি পৃথিবীতে ওড়ানোর জন্য খুব ছোট হেলিকপ্টার বানানোর কথা বলছিলেন। নাম দিয়েছিলেন ‘মেসিকপ্টার’। সেটা শুনেই আমি ভাবতে শুরু করি, খুব ছোট হেলিকপ্টার তো মঙ্গলেও ও়ড়ানো যায়। শুধুই ভাবনা নয়।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে একটা গবেষণাপত্রও লিখে ফেলি। সেটা ১৯৯৯। হাতে কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার সিমি ভ্যালিতে ‘অ্যারোভায়রনমেন্ট’ নামে ছোট খাটো একটি সংস্থার সঙ্গে কথাবার্তাও হয়ে যায়। তাতে ঠিক হয় ৯ ইঞ্চির ‘রোটর’ থাকবে সেই হেলিকপ্টারে। কিন্তু নাসার অর্থবরাদ্দের অভাবে সেই কাজ বেশি দূর এগোতে পারেনি। কাজটা থমকে যায় টানা ১৫ বছর।’’
ভেবেছিলেন এক বাঙালিও
বলরাম জানান, প্রায় একই সময়ে এমন ভাবনা এসেছিল আমার মতোই কলকাতার এক বঙ্গসন্তানের মাথাতেও। অনুভব দত্ত। তিনি এখন মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যারোডায়নামিক্স ও অ্যারোইলেকট্রিসিটি বিভাগের অধ্যাপক।
স্বপ্নপূরণের তিন জাদুকর। চার্লস এলাচি (বাঁ দিক থেকে), জে বব বলরাম ও অনুভব দত্ত।
বলরাম অবশ্য স্বীকার করলেন, পরে খবরা-খবর নিয়ে জানতে পারেন আমেরিকায় এমন চিন্তা-ভাবনা জনাকয়েক বিজ্ঞানীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল সেই ছয়ের দশক থেকেই। যখন চাঁদে একের পর এক ‘অ্যাপোলো মিশন’ পাঠানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছে নাসা। বেঙ্গালুরুতে বলরামের তখন আক্ষরিক অর্থেই শৈশব।
মামাবাড়ি, ঢাউস খাম, শিশু বলরাম
বলরামের শোনানো গল্পের বাকি অংশটুকুর নির্যাসটা এবার তুলে ধরছি। অ্যাপোলো অভিযানের সূত্রে নাসার নামটা তখন গোটা বিশ্বে রটে গেছে। পৌঁছেছে বেঙ্গালুরুতেও। সেখানেই তো আমাদের ইসরোর সদর দফতর। বলরামের মামা খুব কৌতূহলী হয়ে উঠলেন নাসা আর তার বিভিন্ন মহাকাশ অভিযান সম্পর্কে জানার জন্য। সরাসরি চিঠি লিখলেন বেঙ্গালুরুতে মার্কিন কনস্যুলেটে। তার জবাবে দিনকয়েকের মধ্যেই বলরামের মামাবাড়িতে এসে পৌঁছল ঢাউস একটা খাম। যার মধ্যে ছিল নাসার বিভিন্ন অভিযান সম্পর্কে অত্যন্ত ঝকঝকে অনেক বুকলেট। পুস্তিকা।
সেই সব বই দেখেই মাথা ঘুরে গিয়েছিল শিশু বলরামের। তার পর ফের নাসা আর তার মহাকাশ অভিযান সম্পর্কে বলরামের আগ্রহ জাগে চাঁদে যখন মানুষ প্রথম পদক্ষেপ করল। চাঁদের মাটিতে হাঁটলেন তিন মার্কিন মহাকাশচারী। সেই রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা রেডিওতে শুনেছিলেন বলরাম।
সেই বলরামের স্বপ্ন নাসার অর্থবরাদ্দের অভাবে প্রায় ভেস্তেই যেতে বসেছিল। টানা ১৫ বছর কেউ সে দিকে নজর দেওয়ার কথা ভাবেননি।
১৫ বছর পর ধুলোটুলো ঝেড়ে…
বলরাম বললেন, ‘সেটা ২০১৪। আমাদের জেপিএল-এর অধিকর্তা তখন চার্লস এলাচি। তিনি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনারে গিয়েছিলেন ওই সময়। সেখানে ছোট ছোট ড্রোন ও হেলিকপ্টারের নিত্যনতুন ব্যবহারের ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেই সব এলাচির বেশ ভাল লেগেছিল।
জেপিএল-এ ফিরেই তিনি আলোচনা করতে শুরু করেন মঙ্গলে এমন কিছু কি পাঠানো সম্ভব? তখন আমারই এক সতীর্থ এলাচিকে বলেন, অনেক বছর আগে এমন ভাবনাই ভেবেছিলেন বলরাম। তা শুনে এলাচি আমাকে ডেকে পাঠান। মার্স ২০২০ রোভারে কী কী পাঠানো যেতে পারে তা নিয়ে নতুন একটি গবেষণাপত্র আমাকে লিখে ফেলতে বলেন এলাচি। সময় দেন ১০ সপ্তাহ। আড়াই মাস। সেই শুরু। সতীর্থদের নিয়ে মাত্র ৮ সপ্তাহের মধ্যেই লিখে ফেলি সেই গবেষণাপত্র। তার পর কাজ এগিয়ে যায় অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।’
বলরাম জানালেন, এই প্রথম ইনজেনুইটি নামে যে হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছে লাল গ্রহে, স্বপ্ন দেখার শুরুতে সেই হেলিকপ্টারের আকার ও ওজন অনেকটাই কম ভাবা হয়েছিল। কারণ একটাই। মঙ্গলে বায়ুমণ্ডল প্রায় নেই বললেই চলে। সেখানকার বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব আমাদের বায়ুমণ্ডলের মাত্র ১ শতাংশ। বেশি ভারি ও আকার বড় হলে লাল গ্রহের অত্যন্ত পাতলা বায়ুমণ্ডলে সাঁতার কেটে কী ভাবেই বা উড়বে সেই হেলিকপ্টার? তেমন প্রযুক্তিও ছিল না তখন সভ্যতার হাতে। তাই ভাবা হয়েছিল সেই হেলিকপ্টারের আকার হবে বড়জোর আমাদের এক টাকার কয়েনের মতো। ওজনও তথৈবচ।
স্ত্রী স্যান্ডি চিফ মর্যাল অফিসার
এত কথা বললেন, কিন্তু কিছুতেই ভাঙতে চাইলেন না তার ‘জে বব বলরাম’ নামের গোড়ার অক্ষরটির রহস্য। শুধু বললেন, ‘‘জে আমার বাবার নামের আদ্যক্ষর। তবে আমেরিকায় এসে বব নামটি হয়েছে ভাববেন না যেন। বব আমার পারিবারিক মধ্য-নাম।’’
বলরামকে যেমন নাসার প্রায় সকলেই এখন ‘বব’ নামে ডাকেন, তেমনই সমান জনপ্রিয় তার স্ত্রী স্যান্ডি।
মঙ্গল, শনির আগামী দিনের উড়ান। এমন মডেলের কথাও ভেবে রেখেছে নাসা।
বলরাম বললেন, ‘‘উনি সব সময়েই আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। জুগিয়ে চলেছেন। তাই নাসায় ওঁকে সকলে ডাকে ‘সিএমও’ নামে। চিফ মর্যাল অফিসার আমার, আমাদের গোটা প্রকল্পেরও। আমার সহকর্মীদের জন্য রোজই নানা রকমের সুস্বাদু খাবারদাবার বানিয়ে দেন আমার স্ত্রী।’’
যা ভাল, তা স্বীকৃতি পায় দেরিতে, সেটাই ভালো…
তার নিজের ‘মর্যাল’টাও গোপন রাখেননি বলরাম।
সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষ পর্বে পৌঁছে বললেন, ‘‘জানেন, ভালো কাজ, ভালো ভাবনা কখনও মরে যায় না। ছাইচাপা পড়ে না। তার স্বীকৃতি পেতে শুধু একটু বেশি সময় লাগে। সেটা খুব একটা চটজলদি হলে ভালো কাজ, ভাল ভাবনার গুরুত্বই থাকে না যে!’’
বলরাম যে নিজেও হারতে হারতেই জিতেছেন! শেষমেশ জয় হল বলরামেরই। পৃথিবীতে রাইট ভাইদের প্রথম উড়ানের একশো বছর পর ভারতের বলরামের জন্যই তো এই প্রথম সৌরমণ্ডলের আরও একটি গ্রহে উড়তে চলেছে সভ্যতার পাঠানো ৪ পাউন্ড ওজনের হেলিকপ্টার।
ভিন গ্রহে উড়ানের ‘জনক’ হিসাবেই ইতিহাসে জায়গা করে নিলেন বেঙ্গালুরুর বব বলরাম।
সূত্র- বিডি প্রতিদিন