‘আস্ সালামু আলাইকুম’ ভাইজান কেমন আছেন?আফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে কে যেন পিছন থেকে সালাম দিলেন।ঘাড় বাঁকা করে পিছনে তাকাতেই দেখলাম এক দ্বীনি ভাই। উত্তর দিলাম ‘ওয়া আলাইকুমুস্ সালাম’। কেমন আছেন? তাতো ভাল, কিন্তু মুখে ঐটা কি লাগিয়েছেন।কেন জানেন না…?আমার উত্তর দেওয়া শেষ না হতেই তিনি বলে উঠলেন, বুঝেছি বুঝেছি ভয়পেয়েছেন তো। এত দিন যে তাবলীগ করলেন……কিন্তু? কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।তিনি পুরা কথাটা না বললেও আমি বুঝে গেলাম তিনি কি বলতে চাচ্ছিলেন। কথাটা মোটামুটি এরকম ‘এত দিন যে তাবলীগ করলেন কিন্তু এখনোদ্বীলের ইয়াকিন ঠিক হলোনা? আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করুন, তাওয়াক্কুল করুন’। কথাটা যদিও আনেকটা এ্যাটম বোমার মতই তারপরও আমি নিজেকে সামলে নিলাম। তাকে মুহাব্বাতের সাথে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। মুহাব্বতের সাথে বললাম,ভাই বুঝতে পেরেছি আপনি কী বলতে চাচ্ছেন।আচ্ছা একটু বোঝার চেষ্টা করুন, গ্রীষ্মেসূর্য যখন প্রখর হয় তখন কি আমরা ছাতা ব্যবহার করি না? উত্তর আসলো, তাতো করি। বর্ষায় যখন বৃষ্টি নামে তখন কি আমরা ছাতা ব্যবহার করি না?তাতো করি। আকাশে যখন কালো মেঘ জমে আর বাতাস বইতে থাকে তখন কি আমরা নিরাপদ স্থানে চলে যেই না?তাতো যাই। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের মুখে মাস্কআর হাতে গ্লাভসব্যবহার করতে বাঁধা কোথায়?
প্রিয় পাঠক আসুন এখন আমরা জেনে নিই তাওয়াক্কুল কাকে বলে?
তাওয়াক্কুল আরবী শব্দ এর অর্থ হলো, ভরসা করা, নির্ভর করা।
তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ অর্থ হলো, আল্লাহ তা’য়ালার উপর ভরসা করা।
অর্থাৎ, দুনিয়া-আখিরাতের সকল কাজে, সকল মকসুদ হাসিল করার জন্য এবং সকল বিপদ-মুসীবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার উপর ভরসা রাখা।
পবিত্র কুরআনে কারীমায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহর উপরে তোমরা ভরসা কর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (সূরা মায়েদাহ, ২৩)
মানুষকে দুনিয়ার জীবনে কোননা কোন কাজে কাউকে না কাউকে ভরসা তো করতেই হয়। কোথাও না কোথাও তাকে আত্মসমর্পন করতেই হয়। দুঃখ-বেদনা, সুবিধা-অসুবিধা, সমস্যা-সংকটের কথা কোথাও না কোথাও বলতেই হয়। সেই স্থানটা কোথায়? এখানেই ঈমানদার ও অবিশ্বাসীর মধ্য পাথ্যর্ক্য। অবিশ্বাসী সেই স্থান এমন ব্যক্তি বা বস্ত্তকে বানিয়ে নেয় বাস্তবে যাদের কল্যাণ-অকল্যাণের কোনোই ক্ষমতা নেই। পক্ষান্তরে আল্লাহ যাদেরকে ঈমান দান করেছেন, তাওহীদের আলোয় আলোকিত করেছেন তারা তাদের সকল বেদনা, সকল প্রার্থনা এমন একজনের কাছে পেশ করে যিনি বাস্তবেই মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক। আর যিনি সৃষ্টির প্রতি পরম দয়ালু।
লক্ষ্য করুন, হিজরতের সময় দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুসাওর গুহায় অবস্থান নিয়েছিলেন। তাদের খোঁজ করতে করতে সেখানেও পৌঁছে গিয়েছিল মক্কার মুশরিকরা। গুহার ভিতর থেকে রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের পা দেখতে পাচ্ছিলেন।হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্! তাদের কেউ যদি এখন নিজের পায়ের দিকে তাকায় তাহলে তো আমাদের দেখে ফেলবে। রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হে আবু বকর! আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’।(সূরা তওবাহ, ৪০)
শত্রু গুহার মুখে চলে এসেছে, বাহ্যত বাঁচার কোন পথ নেই, ধরা পড়তেই হবে। এই অবস্থায়ও রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএতমিনান দ্বীলে তার মাহবুবেব প্রতি পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রেখে বলেছেন নিশ্চয় আমার মাহবুবই আমাদের রক্ষা করবেন। কেউই আমাদের কোন আনিষ্ঠ করতে পারবে না।
মূসা আলাইহিসসাল্লাম ও তার কওম যখন লোহীত সাগরের পাড়ে এসে দাড়াঁল আর পিছনে ছিল ফেরাউনের বাহিনী তখন মূসা আলাইহিসসাল্লামের সাথীরা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, হে মুসা আমরাতো ধরা খেয়ে গেলাম। মুসা আলাইহিসসাল্লাম মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমার সাথে আমার আল্লাহ রয়েছেন।’(সূরা শু‘আরা, ৬১-৬৩)
বাহ্যিকভাবে তাঁদের বাঁচার কোন পথ ছিল না। কারণ ডানে-বামে পিছনে শত্রুদল। আর সামনে সাগর। এরপরেও মূসা আলাইহিসসাল্লাম আল্লাহর উপর দৃঢ় ভরসা রেখে বলছেন, কখনো নয়, অসম্ভব হতেই পারে না। ফেরাউন আমাকে ধরতে পারবে না। কারণ নিশ্চয়ই আমার সাথে আমার প্রতিপালক রয়েছেন। তিনি আমাকে বাঁচার পথ দেখাবেন।
তাওয়াক্কুল হচ্ছে ভরসা করা, জীবনের সকল বিষয়ে, কল্যাণ লাভের ক্ষেত্রেও আবার অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাবার ক্ষেত্রেও। আর তা এমন সত্ত্বার উপর যিনি সকল বস্ত্তর স্রষ্টা। বস্ত্তর গুণ ও বৈশিষ্ট্যের স্রষ্টা। যিনি গোটা জাহানের পালনকর্তা এবং যিনি দুনিয়া-আখিরাতের সকল কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক। আল্লাহ তা’য়ালা যদিও উপায়-উপকরণ তৈরী করে রেখেছেন কিন্তু মৌলিক ভাবে তার কোন শক্তি নেই। এই উপকরণের মধ্যে শক্তি দান কারী সত্বা আল্লাহ তা’য়ালার সত্বা। একেই তাওয়াক্কুল বলে।
ভাই আব্দুল ওহহাব রহমাতুল্লাহি আলাইহিরকথা থেকে বিষয়টি আমাদের কাছে আরো স্পষ্ট হবে। তিনি মাখলুক বা উপায়-উপকরণকে নফি করেছেন এভাবে,
১) ইয়ে মাখলুখ হেয়, ইয়ে খোদ নেহি বনা, আল্লাহ তা’য়ালানে আপনা কুদরতছে ইচকো বানায়া।
অর্থাৎ, এটি মাখলুক, এটি নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি, একে আল্লাহ তা’য়ালা নিজ কুদরতের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।
২) ইচকো আন্দারজো ছিফাত হেয় ইয়ে ইচকো আপনা নেহি হায়, আল্লাহ তা’য়ালানে আপনা কুদরতছে ইচকো আন্দার রাখখা।
অর্থাৎ, এর মধ্যে যে গুন আছে তা তার নিজের নয়, এই গুন আল্লাহ তা’য়ালার দেওয়া।
৩) ইয়ে ছিফাত জাহির করনেকেলিয়ে ভিহারআনগারি আল্লাহকা এরাদাকা মোহতাজ, ইয়ে খোদ কুচ নেহি করছাকতা।
অর্থাৎ, এই গুন প্রকাশ করার জন্যও সে আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল, এটি নিজে কিছুই করতে পারে না।
এজন্য জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে খুবভালভাবে মনে রাখতে হবে, মাখলুক বা উপায়-উপকরণ নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি, একে আল্লাহ তা’য়ালা নিজের কুদরতের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে যে গুন আছে তা এর নিজের নয়, এই গুন আল্লাহ তা’য়ালার দেওয়া। এই গুন প্রকাশ করার জন্যও এটি আল্লাহর ইচ্ছার (কুদরতের) উপর নির্ভরশীল, এটি নিজে কিছুই করতে পারে না। এর ব্যতিক্রম হলে তা শিরকে পর্যবসিত হবে। আক্বীদা নষ্ট হবে।
উদাহরণ স্বরূপ কেউ অসুস্থ হল। এখন তার চিকিৎসা গ্রহন করা সুন্নত। এইক্ষেত্রে একজন মুমীন ও একজন আবিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য হল আবিশ্বাসী পুরাপুরি ঔষধের উপর ভরসা করবে সে মনে করবে ঔষধ-ই তার রোগ নিবারন করবে। অপরদিকে একজন মুমীন তখন একথা মনে করবে যে, এই ঔষধ নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি একে আল্লাহ তা’য়ালা নিজের কুদরতের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে সেফা দান করার যে গুন তা এর নিজের নয় এই গুন আল্লাহ তা’য়ালার দেওয়া এবং এই গুন প্রকাশ করার জন্যও এটি আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল, এটি নিজে কিছুই করতে পারে না। এটিই তাওয়াক্কুল। তবে এই ধ্যান যদি আমলের সময় না থাকে তাহলে তা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী। মনেরাখতে হবে যদি আমলের সময় এই ধ্যান হয় তাহলে তাওয়াক্কুলের সঠিক অর্থ অর্জিত হবে।
ইবনেল ক্বাইয়িম রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, বান্দা যদি কোন পাহাড় সরাতে আদিষ্ট হয় আর যদি সে কাজে সে আল্লাহ তা’য়ালার উপর যথার্থভাবে ভরসা করতে পারে, তবে সে পাহাড়ও সরিয়ে দিতে পারবে।(ইবনেল ক্বাইয়িম)
তাওয়াক্কুল সম্পর্কে ভ্রান্তি
অনেকেই মনে করেন যে, তাওয়াক্কুল হলউপায়-উপকরণ অবলম্বন ছাড়াই হাত গুটিয়ে বসে থাকা।
খুবভাল করে মনে রাখতে হবে যে, কোন চাহিদা পূরণে উপায়-উপকরণ ও মাধ্যম গ্রহণ না করা কোন অবস্থাতেই আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বা ভরসার মর্মার্থ নয়। কোন কিছু না করে নিশ্চেষ্ট বসে থাকার নাম তাওয়াক্কুল নয়; বরং তা তাওয়াক্কুলের ভান। আরবীতে একে ‘তাওয়াকুল’ (تواكل) বলে। তাওয়াকুল বা নিশ্চেষ্ট বসে থেকে আল্লাহর উপর ভরসা যাহির করা আল্লাহর দ্বীনের কোন কিছুতেই পড়ে না।
বর্ণিত আছে হযরত উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু একদিন একদল ইয়েমেনবাসীর সাক্ষাত পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কারা? তারা বললো, ‘আমরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলকারী।’
উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আসলে তোমরা তাওয়াক্কুলের বাহানা করছো! প্রকৃত তাওয়াক্কুলকারীতো সে যে জমীনে বীজ বপন করেছে তারপর আল্লাহর উপর নির্ভর করেছে।’
অর্থাৎ তাওয়াক্কুলের অর্থ এটা নয় যে আপনি বীজ না বুনেই ফলের আশা করবেন, কিংবা স্ত্রী গ্রহণ না করেই আল্লাহর কাছে একটা ফুটফুটে সন্তানের জন্য কান্নাকাটি করবেন। আপনি আপনার সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু সম্পাদন করুন, অতঃপর ফলাফলের জন্য আল্লাহর উপর নির্ভর করুন। এরই নাম হচ্ছে তাওয়াক্কুল ।
এক সাহাবী একবার রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি আমার উট গুলো চরাতে চাই। নামাজের সময় ওই উটগুলো বেঁধে রাখব না ছেড়ে রেখে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবো?রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন, ‘প্রথমে তার গোছা রশি দিয়ে বাঁধ তার পর তাওয়াক্কুল করো।’(তিরমিযী)
যারা প্রচেষ্টা ছাড়াই কিছু লাভ করতে চায় তাদেরকে কখনই আল্লাহর উপর ভরসাকারী বলা যায় না।
বরং তাওয়াক্কুলের দু’টি দিক রয়েছে। এক. আল্লাহর উপর ভরসা ও নির্ভরতা। দুই. তাঁর সাথে কাজের উপকরণ অবলম্বন করা।
আসলে লক্ষণীয় যা তা হ’ল- শুধুই উপায়-উপকরণের উপর নির্ভর না করা। বান্দাকে জানতে ও বুঝতে হবে যে, উপায়-উপকরণ গ্রহণ করে চাহিদা পূরণ ও সমস্যা সমাধান কেবল জাগতিক নিয়ম মাত্র। উপকারকারী ও অপকারকারী কেবলই আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা।
রসূলেকরীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে আল্লাহ পাকের উপর অধিক তাওয়াক্কুলকারী আর কে হতে পারেন? তিনিই তো সবচেয়ে বড় ভরসাকারী।
রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের ঘটনা থেকে তাওয়াক্কুলের শিক্ষাটি চমৎকারভাবে বোঝা যায়। তিনি যে আল্লাহর সাহায্য পাবেন এ বিষয়ে কোনই সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু তাই বলে তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকেন নি। হঠাৎ করেই একদিন ‘আল্লাহর নামে বের হলাম’ বলে বেরিয়ে যান নি। যথারীতি তিনি যাত্রার জন্য ঘোড়া ঠিক করে রেখেছিলেন। সঙ্গী কে হবে তাও স্থির করেছিলেন। হিজরতের সময় তিনি একজন পথপ্রদর্শক(গাইড) সাথে নিয়েছিলেন, যে তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর যাত্রাপথে কোন পদচিহ্ন যাতে না থাকে তিনি সে ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। তিনি যাত্রার জন্য এমন সময় বেছে নিয়েছিলেন যখন লোকজন সাধারণতঃ সজাগ থাকে না। আবার জনগণ সচরাচর যে পথ দিয়ে চলাচল করে তিনি তা বাদ দিয়ে অন্য পথ ধরেছিলেন। এমন কি কাফেররা তাদের তালাশ করে ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোথায় লুকিয়ে থাকবেন এসব কিছুই আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন। এসব কিছুই উপায়-উপকরণ ও মাধ্যম অবলম্বনের অন্তর্গত। অর্থাৎ তাঁরপক্ষে সম্ভবপর সব ধরনের সতর্কতা ও গোপনীয়তা তিনি অবলম্বন করেছিলেন। অতঃপর যেগুলো তার সাধ্যের বাইরে ছিল সেগুলোর জন্য তিনি আল্লাহর উপর নির্ভর করলেন।
ওহুদ যুদ্ধে রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটার উপর আর একটা অর্থাৎ দু’টো বর্ম গায়ে দিয়েছিলেন। সায়েব ইবনে ইয়াযীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘ওহোদ যুদ্ধের দিনে রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’টি বর্ম পরে জনসমক্ষে এসেছিলেন’।(আহমাদ) রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতের জন্যও যুদ্ধের পোশাকের ব্যবস্থা করেছেন।(ইবনে হিববান )
মক্কা বিজয়ের দিনে তিনি শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করেছিলেন। আনাস বিন মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয় দিবসে যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তাঁর মাথায় শিরস্ত্রাণ ছিল’। (বুখারী)
হযরত মারইয়াম আলাইহিসসাল্লামের ঘটনা দেখুন। সন্তান প্রসবের পর তিনি যে খেজুর গাছের নিচে বসে ছিলেন আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে সেই খেজুর গাছ ধরে ঝাঁকি দিতে বলেছিলেন, যাতে তাঁর সামনে খেজুর ঝরে পড়ে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তুমি তোমার দিকে খেজুর গাছের কান্ড ধরে নাড়া দাও। সেটি তোমার উপর পাকা খেজুর নিক্ষেপ করবে।’ (সূরা মারইয়াম,২৫)
এহেন দুর্বল মহিলা কিভাবে মযবূত ও শক্ত খেজুর গাছ ধরে এমনভাবে ঝাঁকি দিল যে টপটপ করে খেজুর ঝড়ে পড়ল? এই মহীয়সী মহিলার ঘটনা দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে উপকরণ গ্রহণের গুরুত্ব শিক্ষা দিয়েছেন- চাই সেসব উপকরণ লঘু ও দুর্বল হোক। কেননা এই সতী-সাধ্বী মহিলার সেই মুহূর্তে এরূপ দুর্বল ধরনের কাজ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।
আল্লাহ তা’য়ালার জন্য কোন মাধ্যম ছাড়াই খেজুর নীচে ফেলা অবশ্যই সম্ভব ছিল। কিন্তু যেহেতু কোন কিছু পেতে হ’লে মাধ্যম একটি জাগতিক নিয়ম হিসাবে রয়েছে, সেহেতু আল্লাহ মারিয়াম আলাইহিসসাল্লামকে কান্ড ধরে ঝাঁকি দিতে বলেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি আল্লাহর উপর যথাযথভাবে ভরসা করেছিলেন এবং তাঁর দুর্বল পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছিলেন তখন আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা ফলবতী করেছিলেন এবং ফলগুলোকে তাঁর নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছিলেন।
অতএব, তাওয়াক্কুলের হাকীকত বা মূল কথা হ’ল সর্বাবস্থায় অন্তরে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা, সেই সাথে প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ ব্যবহার করা এবং পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহই রিযিকদাতা, তিনিই একমাত্র স্রষ্টা, জীবন ও মৃত্যু দাতা। তিনি ছাড়া যেমন কোন ইলাহ বা উপাস্য নেই, তেমনি তিনি ছাড়া কোন প্রতিপালক নেই।
তেমনি বর্তমানেবিশ্বে যে মহামারীরছড়িয়ে পড়েছে তা হতে রক্ষা পেতেউপায়-উপকরণ গ্রহন করা মোটেও তাওয়াক্কুলেরপরিপন্থীনয়। তবেমনে রাখতে হবে, করোনার মধ্য যে গুন রয়েছে তা প্রকাশ করার জন্য সে আল্লাহর ইচ্ছার (কুদরতের) উপর নির্ভরশীল, সে নিজে কিছুই করতে পারে না। এই কথাকে স্মরণ রেখে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা এবং প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ ব্যবহার করা। এ ব্যপারে ইসলাম আমাদের দিক নির্দেশনা দিয়েছে।
একবার হযরত ওমর ফারূক রাযিয়াল্লাহু আনহু শাম অর্থাৎ বর্তমানের সিরিয়া সফরে যাচ্ছিলেন। পথে সংবাদ পেলেন, শাম অঞ্চলে মহামারি আকারে প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে। এত জটিল রূপ ধারণ করেছে যে, রোগটি দেখা দেওয়া মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে বহু মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। উর্দূনে (জর্ডান) হযরত আবু উবায়দা ইবনেল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুর মাজারের কাছে পুরো কবরস্থানটিতে সেইসব সাহাবায়ে কেরাম সমাহিত আছেন, যাঁরা উক্ত প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু সঙ্গীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন, এই পরিস্থিতিতে ওখানে যাবেন, নাকি ফিরে যাবেন। তখন হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহু একটি হাদীস শোনালেন যে, রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোন অঞ্চলে যদি প্লেগ দেখা দেয়, তা হলে বাইরের কোন মানুষ যেন উক্ত অঞ্চলে প্রবেশ না করে আর ওখানকার কোন মানুষ যেন ওখান থেকে পালায়ন না করে।’
এই হাদীসে রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, যেন আমরা ওখানে না যাই। তাই তিনি শাম সফর মুলতবি করে দিলেন। হযরত আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই বিষয়টিকে তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী মনে করলেন। তাই সে সময় হযরত আবু উবায়দা ইবনেল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, ‘আপনি কি আল্লাহর তাকদীর থেকে পালায়ন করছেন?’
অর্থাৎ আল্লাহ যদি এই প্লেগ দ্বারা আমাদের মৃত্যু লিখে রেখে থাকেন, তাহলে যাওয়া না যাওয়া দু-ই তো সমান।
হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু তার উত্তরে বললেন, ‘যদি আপনি ছাড়া অন্য কেউ কথাটা বলত, তাহলে আমার কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু আপনি জেনে বুঝে কথাটা বললেন।’
তারপর হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর তাকদীর থেকে আল্লাহর তাকদীরের দিকে পালায়ন করছি।’ (বুখারী, মুসলিম)
ওমর ইবনে খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহুর সময়ের আর একটি ঘটনা বর্ণিত আছে, একজন কুষ্ঠরোগী মহিলা যে বাইতুল্লার তওয়াফ করছিল। হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু ঐ মহিলার নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তাকে দেখে ফেললেন। তিনি মহিলাটিকে বললেন, হে আল্লাহর বান্দী, লোকদরেকে কষ্ট দিও না, তুমি যদি নিজের ঘরে বসে থাক তবে ভাল হয়। উক্ত মহিলা হারাম শরীফে আসা বন্ধ করে দিল এবং নিজ ঘরে বসে থাকল। (হায়াতুস সাহাবাহ)
এই দুটি ঘটনা হতেই বোঝাযায়, হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বুঝাতে চেয়েছেন, সবধানতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়। বরং এটি তাওয়াক্কুলের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। কারণ রসূলে করীম সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করেছেন, তোমরা সাবধানতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন কর। হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এখানে সবধানতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাকে উপায়-উপকরণ হিসেবে গ্রহন করেছেন।
মানুষের স্বভাবের ভিতরে একটি বিপরীত মুখি জযবাবা ঝোক রয়েছে। যদি বলা হয় ওটি স্পর্শকরবেনা তাহলে সেটি স্পর্শ করারপ্রতিআগ্রহ বেড়ে যায়। যদি বলা হয় ওটি ধরবে না তাহলে সেটি ধরার জন্য ছটফট করতে থাকে। আর যদি বলা হয় ওখানে যেওনা তাহলে ওখানে যাওয়ার প্রতি তার ঝোক প্রবণতা বেড়ে যায়।
মহামারীর একটা পর্যায়ে আমাদের অভিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম জন সমাবেশকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। কিন্তু আমরা সেই শুরু থেকেই বীরত্ব প্রকাশ করে এসেছি যে, জীবন দিয়ে দেব, শহীদ হয়ে যাব, তবুও সমাবেশ ছাড়বনা।
খুব ভাল ভাবে মনে রাখতে হবে, সবক্ষেত্রে বীরত্ব প্রকাশ করার নাম দ্বীন নয়।
সায়েখুল ইসলাম আল্লামা মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম অসাধারন একটি উদাহরণ এনেছেন, তিনি বলেন, এক বুযুর্গ, রোগাগ্রস্ত অন্য এক বুযুর্গকে দেখতে গেলেন। দেখলেন, রোগী খুব কষ্টের মধ্যে আছেন। কিন্তু উহ্ আহ্ করে কষ্ট প্রকাশ না করে আল্লাহ আল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ অযিফা জপ করছেন। আগুন্তুক বুযুর্গ বললেন, ভাই আপনার এই আলহামদুলিল্লাহ বলা খুবই প্রশংসনীয় বিষয়। কিন্তু এটি তো আল্লাহর কাছে দু’আ করার ক্ষেত্র যে, হে আল্লাহ! আমাকে সুস্থতা দান করুন।
আপনি তো এই অবস্থায় আলহামদুলিল্লাহ জপে আল্লাহর সামনে বীরত্ব প্রদর্শন করছেন । ব্যাপারটা এরকম যে, আল্লাহ দেখুন আপনি অসুখ দিয়েছেন কিন্তু আমি কত বীর যে, আমার মুখ থেকে একটি বারের জন্য আহ উচ্চারিত হচ্ছে না। তো আল্লাহর সামনে বীরত্ব প্রদর্শন করা কোন বন্দেগী নয়। আল্লাহর সামনে নিজের অসহায়ত্ব প্রদর্শনের নাম বন্দেগী। তিনি যখন চাচ্ছেন যে, বান্দা! তুমি একটু উহ্ আহ্ করে আমাকে ডাক, তখন অক্ষাম ও অসহায় হয়ে আল্লাহকে ডাক। কীভাবে ডাকবে? যেমন ডেকেছিলেন হযরত আইউব আলাইহিসসাল্লাম, ‘কষ্ট আমাকে স্পর্শ করেছে। আপনি তো পরম দয়ালু।’
নবীদের থেকে বেশি বীর-বাহাদুর কে হবে? এত বড় রোগ! এত অসহনীয় কষ্ট! কিন্তু আল্লাহকে ডাকছেন,‘হে আল্লাহ! আমি কষ্ট পাচ্ছি। আপনি তো পরম দয়ালু।’ (সুরা আম্বিয়া, ৮৩)
এজন্য একেবারে দঃখ বা কষ্ট প্রকাশ না করা কামালাত বা যোগ্যতার মাপকাঠি নয়। কারণ এটা কোন সুন্নত পদ্ধতি নয়। আল্লাহ যখন চাচ্ছেন, বান্দা তুমি একটু উহ্ আহ্ করো, তখন উহ্ আহ্ করো। আল্লাহর সামনে এত পারঙ্গমতাপ্রদর্শন করা ভালো নয়। এটিও বন্দেগী তথা দাসত্বের পরিপন্থী। (ইসলাম আওর হামারী যিন্দেগী)
মনে করুন, আপনি যে সমাবেশে যাচ্ছেন সে রাস্তার মাঝখানে একটি বাঘ বসে আছে অথবা বিরাট অকৃতির একটি অজগর সাপ রয়েছে। তাহলে আপনি কি বলতেন, আমি শহীদ হয়ে যাব তার পরও ওখানে যাব? আসলে ঘটনা হচ্ছে করোনা ভাইরাস চোঁখে দেখা যায় না বলেই মনের ভিতরে এরকম জযবা তৈরী হয়েছে। মনে রাখবেন জযবা দিয়ে দ্বীন হয় না। নিজের মনোবাসনা পূরণকরার নাম দ্বীন নয়। আল্লাহ ও তাঁর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করার নাম দ্বীন।
একবার রসূল সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসল্লাম আদেশ দিলেন, যখন বৃষ্টি হয় এবং ময়লা কাঁদা এত বেশি হয় যে, চলতে ফিরতে মানুষের খুব বেশি কষ্ট হয়, পা পিছলে যাওয়া আশষ্কা হয়, ময়লা-কাদায় পোশাক নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়, এমতবস্থায় শরীয়ত অনুমতি দিয়েছে যে, মানুষ মসজিদের স্থলে ঘরে নামায পড়বে । (বুখারী)
অবশ্য বর্তমানে আমরা শহরে বসবাস করি, যেখানে রাস্তাঘাট পাকা। তাই এখানে বৃষ্টিতে এমন দুরাবস্থার সৃষ্টি হয় না। এমন ময়লা-কাদা হয় না, যাতে চলাচল দুষ্কর হয়। কিন্তু যেখানে রাস্তা-ঘাট কাঁচা, সেখানে আজও এই বিধান প্রযোজ্য। এমতাবস্থায় জামাত মাফ হয়ে যায় এবং মানুষের জন্য ঘরে নামায পড়া জায়েয হয়ে যায়।
হযরহ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমার ঘটনা ।হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা একদিন মসজিদে বসে ছিলেন। ইত্যবসরে আযানের সময় হল। সঙ্গে সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টিও শুরু হল। মুয়াজ্জিন আযান দিলেন। তিনি মুয়াজ্জিনকে বললেন, এ ঘোষণাও করে দাও, ‘সবাই নিজ নিজ ঘরে নামায পড়ুন।’
একথা রসূলেকরীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেও বর্ণিত আছে যে, এমতাবস্থায় এ ঘোষণা করে দেয়া চাই। কিন্তু এই বাক্য অন্যান্যাদের কাছে খুব অপরিচিত মনে হল। কারণ সর্বদা মানুষ দেখে ও শুনে আসছে যে, মসজিদ থেকে এ ঘোষণা হয়, ‘নামাযের জন্য আস, সফলতার জন্য আস।’কিন্তু আজ বিপরীত ঘোষণা হচ্ছে, যে নিজ নিজ ঘরে নামায পড়ুন। তাই লোকেরা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হযরত! এটা আপনি কি করলেন? আপনি মানুষকে মসজিদে আসতে বারণ করছেন? উত্তরে তিনি বলনে, ‘হ্যাঁ! আমি তা এমন ঘোষণা করাবই। কারণ এমন ঘোষণা সেই সত্ত্বা থেকেও দেয়া হয়েছে,যিনি আমার থেকেও উত্তম এবং তোমার থেকেও উত্তম।’ (বুখারী)
সায়েখুল ইসলাম আল্লামা মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেন, এখন যদি কেউ একথা বলে যে, আমার কাছে এ ধরণের ঘোষণা মন্দ লাগে । আমার এমন ঘোষণা করতে লজ্জা লাগে। তার অর্থ হল, তুমি রসূলেকরীম সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আগে বাড়ার চেষ্টা করছে। রসূলেকরীম সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম এ ঘোষণা করেছেন এবং অনুমতিও দিয়েছেন। আর তুমি বলছ, আমি এর অনুমতি দিচ্ছি না, আমার এ ঘোষণা করতে মন্দ লাগে। অতএব দ্বীনের কোন বিষয়ে রসূলের সুন্নাত এবং তাঁর শিক্ষার আগে বাড়ার চেষ্টা করছ।
ডা.আবদুল হাই রহমাতুল্লাহি আলাইহি একটি কথা বলতেন। হৃদয়পটে যত্ন করে রাখার মত। তিনি বলতেন, ভাই! নিজের কামনা পূর্ণ করার নাম দ্বীন নয়, বরং দ্বীন হল আল্লাহ ও তাঁর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করার নাম। প্রথমে লক্ষ্য রাখবে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি চান? সেটা পূর্ণ করা। এটাই দ্বীন । নিজ আগ্রহ আবেগ, কামনা-বাসনা পূর্ণ করার নাম দ্বীন নয়। যেমন কারো আগ্রহ সৃষ্টি হল প্রথম কাতারে নামায পড়ার প্রতি। কারো মনে জাগল, জিহাদ করবে। কারো মনে চাইল দাওয়াত-তাবলীগে সময় দেবে। এসব তো অবশ্যই সওয়াবের কাজ। নিঃসন্দেহে এগুলো দ্বীনের কাজ। তবে তোমাকে দেখতে হবে, এ মূহুর্তে দ্বীনের চাহিদা কী? যেমন তোমার মনে চাইল, জামাতের প্রথম কাতারে শরীক হওয়ার। অথচ ঘরে তোমার মাতা-পিতা খুবই অসুস্থ। নড়াচড়া করতে পর্যন্ত পারছেন না। তাহলে এ মুহূর্তে জামাতে শরীক হওয়ার চেয়েও মাতা-পিতার খেদমত করার গুরুত্ব অধিক। এ মুহূর্তে আল্লাহ তোমার কাছ থেকে এটাই চান। তাই এ মুহূর্তে তোমর কর্তব্য হবে ঘরে একাকী নামায সেরে নেয়া এবং মাতা-পিতার খেদমতে পরিরপূর্ণভাবে আত্ননিয়োগকরা। এ মুহূর্তে যদি মাতা-পিতার খেদমত না করে তুমি চলে যাও মসজিদে জামাতে শরীক হতে, তাহলে এটার নাম দ্বীন নয় বরং এটা হবে নিজের কামনাকে অগ্রাধিকার দেয়া ।
অবশ্য শরীয়তের এ বিধান তখন প্রযোজ্য হবে, যখন মসজিদ হবে দূরবর্তী অবস্থানে । যদি মসজিদ নিকটেই হয়, সেখানে গেলে মা-বাবার খেদমতে অসুবিধা হবে না, তখন মসজিদে যাওয়াই শ্রেয়।
হযরত মাওলানা মাসীহুল্লাহ খান রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ সম্পর্কে একটি উপমা পেশ করেছেন। তাহল যেমন জনমানবহীন কোন এক প্রান্তরে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই থাকে । ইত্যবকাশে নামাযের সময় হয়ে গেল। তাদের অবস্থান থেকে মসজিদ অনেক দূরে । স্বামী তার স্ত্রীকে বলল, নামাযের সময় হয়ে গেছে, আমি মসজিদে যাব নামায পড়ব। স্ত্রী এটা শুনে ভয় পেয়ে গেল, বলল, তুমি আমাকে একা রেখে কোথায় যাবে? এখানে তো কেউ নেই। তুমি এভাবে চলে গেলে ভয়ে আমার প্রাণ বের হয়ে যাবে। তুমি যাবে না। স্বামী উত্তর দিল, জামাতের প্রথম কাতারে শরীক হওয়ার ফযীলত অনেক। আমাকে যেতেই হবে, এ ফযীলত অর্জন করতেই হবে। যা হবার তা হবে, আমি যাবই।
হযরত মসীহুল্লাহ খান রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এর নাম দ্বীন নয়। এটা দ্বীনের কাজও নয়। এটা হবে প্রথম কাতারে নামায আদায় করার আশা পূর্ণ করা। কারণ এ মুহূর্তে দ্বীনের দাবি ছিল, স্ত্রীকে একা ছেড়ে না যাওয়া এবং মসজিদের পরিবর্তে ঘরে একাকি নামাজ পড়ে নেয়া। দ্বীনের এই দাবি যেহেতু উপেক্ষিত হল, তাই এটা দ্বীন হবে না। আল্লাহ ও তাঁর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য হবে না।
অনুরুপভাবে বাড়িতে যদি মাতা-পিতা অসুস্থ থাকেন, বিবি-বাচ্চা পীড়িত থাকে, যখন তাদের জন্য প্রয়োজন আপনার খেদমত। অথচ আপনার মনে সৃষ্টি হল তাবলীগে যাওয়ার সাধ। তাই আপনি বলে দিলেন, আমি তাবলীগে গেলাম। তাহলে এটা দ্বীন হল না। হাঁ, তাবলীগে যাওয়া অবশ্যই দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু এ মুহূর্তের দাবি আপনার তাবলীগ নয়, বরং এ মুহূর্তের দাবী হল খেদমত। আল্লাহ ও তাঁর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুমও এখন এটাই। তাই আপনাকে অবস্থার আলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে, তাহলেই হবে দ্বীন। তাহলেই হবে ইতাআত। নিজের মনোবাসনা পূরণকরার নাম তো দ্বীন নয়।
খুব ভালোভাবে মনে রাখতে হবে, নিজের চাহিদা ও নিজের প্রবৃত্তির তাড়না পূরণের নাম দ্বীন নয়। দ্বীন হল আল্লাহ পাকের আনুগত্যের নাম। তা আমার বুঝে আসুক আর না আসুক। (ইসলাম আওর হামারী যিন্দেগী)
এখন মনে করুন আমি করোনা ভাইরাস বহন করছি এমতাবস্থায় আমি সমাবেশে যোগ দিলাম, আমার পাশে যে ভাইটি ছিল সে আমার নিকট হতে বহন করে তার বাড়িতে নিয়ে গেলো, তার কাছ থেকে তার পরিবারের লোকজন গ্রহন করল। আবার উল্টাটাও হতে পারে, যেমন আমি কোন সমাবেশে গেলাম সেখানে আমার কোন ভাই এই ভাইরাসটি বহন করছিল, তার কাছ থেকে আমি পেয়ে গেলাম, এবার আমি বাসায় আসলাম এবং আমার নিকট হতে আমার বৃদ্ধ মা-বাবা সন্তান-স্ত্রী সহ সকলকে দিয়ে দিলাম। এখন সকলের অসুস্থ হওয়া শুরু হল এবং কষ্টের মধ্যে পড়ে গেল তাহলে এটা কি হঠকারিতা নয়। লক্ষ করুন, আমার মনের চাহিদা ও প্রবৃত্তির তাড়না পূরণ করতে গিয়ে কতগুলো মানুষকে ক্ষতির সম্মুখীন করলাম। মনে রাখবেন ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা যেখানে গোড়ামীর কোন স্থান নেই।মহান আল্লাহ তা’য়ালা কোন ব্যক্তির উপর এমন কোন কাজের বোঝা চাপিয়ে দেন না যা তার সাধ্যের বাইরে।(সূরা বাকারা,২৮৬)
প্রিয় পাঠক, তাওয়াক্কুলের ব্যাপারে আর একটু কথা বাকী রয়েছে। সেটা এখন বলে নিই। একটি বিষয়ে আমাদের অনেকের মনেই খটকা রয়েছে যে, কোন কোন বুজুর্গ তাওয়াক্কুলের তরিকা এই নির্বাচন করেছেন যে, তারা জীবন যাপনের জন্য কোন কাজই করেননি। যার কারনে কখনো ক্ষুধার্ত থাকতে হয়েছে। কখনো কখনো মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাদের দানও করেছেন। স্বয়ং রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে কোন কোন সাহাবীরও এরকম অবস্থা ছিল। যেমন তারা রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে ইলম অর্জন করার জন্য আসহাবে সুফফায় এসে পড়ে থাকতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহান আল্লাহ তা’য়ালা ও রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাশুনা এবং তা থেকে শিক্ষা অর্জন করা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদের জীবন উপকরেণর কোন পন্থা ছিল না। তারা সুফফায় এজন্য এসে ছিল যে, মহান আল্লাহ তা’য়ালা যদি কিছু দেন খাব অন্যথায় ধৈয্য ধারণ করব। এক হাদীসে আছে, ‘রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে দুই ভাই ছিল। এক ভাই জীবিকা অন্বেষণে ব্যস্ত থাকত আর অন্য ভাই জীবিকা অর্জনে কাজ করত না, তবে সে শিক্ষা অর্জনের জন্য নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আসা যাওয়া করত। কিন্তু এটা জীবিকা অর্জনে নিয়োজিত ভাইয়ের পছন্দ হতো না। তার কথা ছিল, আমি একা কেন উপার্জন করব। এ কারণে সে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নালিশ দিয়েছিল। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিযোগকারীকে বললেন, ‘তার ব্যাপারে আপত্তি করবে না। হতে পারে আল্লাহ তা’য়ালা তার করনেই তোমাদের রিযিক প্রদান (তিরমিযী)
সায়েখুল ইসলাম আল্লামা মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেন,রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন তাওক্কুলের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেননি। এভাবে এই ধারাবাহিকতা আউলিয়ায়ে কেরাম এবং সুফিয়ায়ে কেরাম পর্যন্ত ছিল।
তবে মনে রাখতে হবে যে আসবার দ্বারা স্বভাবতই ফল উৎকলিত হয়ে যায়। যেমন, মানুষের ক্ষুধা লাগলে খানা ক্ষুধা নিবারণ করে এমন আসবাব বর্জন করা হারাম। অর্থাৎ যদি কারো সামনে খানা উপস্থিত হয় এবং সে বলে আমি আল্লাহর উপর তাওক্কুল করেছি তিনি আমার ক্ষুধা মিটিয়ে দেবেন। এই বলে সে খানা খায় না। তাহলে মনে রাখুন, যদি সে এমন অবস্থায মৃত্যুবরণ করে তাহলে হারাম মৃত্যু হবে তার। কেননা সবব অর্থাৎ খানা খাওয়াকে গ্রহন করা ফরজ এবং ওয়াজিব।
আসবাবের দ্বিতীয় প্রকার এমন-আসবাব যার মাধ্যমে কখনো ফল লাভ হয় আবার কখনো হয় না। যেমন ঔষধ, তা কখনো উপকার দেয় আবার কখনো উপকার দেয় না। তার হুকুম হল, আমাদের মত দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য এমন আসবাবও বর্জন করা জায়েয নেই। এই আসবাবকে গ্রহন করার পর আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিৎ। কিন্তু যাদেরকে মহান আল্লাহ তা’য়ালাতাঁর সত্ত্বার সাথে বিশেষ সম্পের্কের তাওফীক দান করেছেন তাদের জন্য এ জাতীয় আসবাব বর্জন করাও জায়েজ। তবে শর্ত হল, মহান আল্লাহ তা’য়ালার কাছে কোন অবস্থাতেই যেন অভিযোগ না হয়। মহান আল্লাহ তা’য়ালার উপর দৃঢ় ঈমানদার লোক অনেক সময় এ প্রকারের আসবাব বর্জন করেন। যদি খানা উপস্থিত হয় খানা খান কিন্তু কামাই রুজি অর্জনের ক্ষেত্রে তাওক্কুল করেন। স্বয়ং রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কোন কোন সাহাবায়ে কেরাম এবং অনেক বুজুর্গানে দ্বীন এমনটি করেছেন। যদি কারো মধ্য সহনশক্তি থাকে তাহলে এমন করাও জায়েয। কিন্তু এটা আমাদের মত দুর্বলদের জন্য নয়। কারণ আমাদের মধ্যে শক্তি নেই। যদি কেউ তাদের অনুসরণ করতে চায় তাহলে মারা যাবে। এজন্য এ ব্যপারে অনুস্মরণ করা যথার্থ নয়।(ইসলাম আওর হামারী যিন্দেগী)
মোট কথা, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বেশী বেশী নফল নামাজ, দোওয়া ও এস্তেগফারের মধ্যে লিপ্ত থাকব এবং দ্বীলে দ্বীলে খুব ভয় করতে থাকব এবং মহান আল্লাহ তা’য়ালার উপর ভরসা করে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করব এবং এজন্য যে ধরনের উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার দরকার তা করব।এসময়ে দ্বীলে একথা স্মরন রাখতে হবে যে, করোনা এবং করোনা হতে প্রতিরক্ষার জন্য আমরা যে সমস্ত উপায়-উপকরণ অবলম্বন করেছি এদের কারো কোন ক্ষমতা বা শক্তি নেই সমস্ত ক্ষমতা ও শক্তির মালিক এক মাত্র আল্লাহ। আমি যদি সুরক্ষিত দূর্গের মধ্যেও অবস্থান করি আর আল্লাহ যদি চান তাহলে ঐ সুরক্ষিত দূর্গের মধ্যেও করোনা আমার নিকট পৌঁছে যাবে।
আল্লাহ! তিনি সকল বস্ত্তর উপর ক্ষমতাশীল। তাঁর ক্ষমতা স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেখানে কোন প্রকার ত্রুটি, অপূর্ণতা ও দুর্বলতার লেশমাত্র নেই। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেছেন এবং যা ইচ্ছা তাই করবেন। বিশ্বজগত ও বিশ্বজগতে যা কিছু আছে সবই তাঁর সৃষ্ট। যে বস্ত্তকে তিনি যে আকারে সৃষ্টি করেছেন তাই তার সর্বোৎকৃষ্ট রূপ। পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানী ব্যক্তিরা যদি তাঁদের সমস্ত জ্ঞান একত্র করে এবং সমবেতভাবে তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট রূপ উদ্ভাবন করতে চেষ্টা করেন অথবা তাতে কোন প্রকার হ্রাস-বৃদ্ধির চেষ্টা করেন, যে কৌশলে তিনি তা সৃষ্টি করেছেন কোন অবস্থাতেই তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট রূপ উদ্ভাবন করতে পারবে না। (কিমিয়ায়ে সা’দাত)
এজন্য হে মুমীনেরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন কর, ঘরে থাক অর্থাৎ নূহ্ আলাইহিসসাল্লামের কিস্তিতে উঠে পড়,বীরত্বপ্রদর্শন করো না, আর মহান মালিকের কুদরতি খেয়ালের মধ্যে যা আছে তাকে তা করতে দাও।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সঠিক কথার উপর আমল করারর তৌফিক দান করুন। (আমিন)
লেখক:
বায়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়, খুলনা
ইমেইল: belayetfiqcbd@gmail.com