প্রথম বারের মতো মাওয়া-ভাঙ্গায় বাজলো ট্রেনের প্রথম হুইসেল। ‘কু ঝিক ঝিক’ ট্রেনের শব্দে উচ্ছ্বসিত পদ্মাপাড়ের বাসিন্দারা। বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণবঙ্গে চলাচল করছে পরীক্ষামূলক ট্রেন। আগামী ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
মাওয়া-ভাঙ্গায় ট্রেন চলাচল দেখে আবেগ আপ্লুত পদ্মা নদীর দুই পাড়ের মানুষ। অনেকে আনন্দে কেঁদেছেন। কেউ আবার নিজের সন্তানকে দেখিয়েছেন ট্রেন চলাচল। এযেন স্বপ্নকে হাতের মুঠোও পাওয়া। ভাঙ্গার তুজারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান পরিমল চন্দ্র দাস বলেন, আমাদের অনেক দিনের আশা, এই এলাকার মানুষ ট্রেনে চড়ে ঢাকায় যাবেন। অল্প খরচে ও নিরাপদে ঢাকা পৌঁছে দিনের কাজ শেষ করে আবার এলাকায় ফিরে আসবে। শেষ পর্যন্ত আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে। এই অঞ্চলের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।
ভাঙ্গা বাজারের ব্যবসায়ী জাবেদ সরদার নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, জীবনে যা দেখতে পারি নাই, সেটা দেখে গেলাম। এই দৃশ্য জীবনে ভুলবো না। আজকে আমাদের আনন্দের দিন। ভাঙ্গা কলেজ পাড় এলাকার বাসিন্দা নাঈম ভুইয়া বলেন, পরীক্ষামূলক ট্রেনে চড়ে ভিষণ আনন্দিত। বললেন, শেখ হাসিনা যা করে দিয়েছেন তা কোনদিন শোধ করার নয়। আল্লাহ তাকে আরও বহু বছর বাঁচিয়ে রাখুন। আমাদের এলাকা বদলে গেছে।
ভাঙ্গার ঘারোয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সফি উদ্দীন মোল্লা বলেন, আমাদের একটা স্বপ্নের পদ্মা সেতু, সেই সেতুতে রেল সংযোগ দেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। তিনি বলেন, এই রেল চালু হওয়ায় আমাদের এলাকার আমুল পরিবর্তন হবে। আমাদের এলাকার কৃষকরা লাভবান হবেন। তাদের উৎপাদিত সবজি সহজেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যাবে। নগরবাসী কম দামে টাটকা সবজি খেতে পারবেন।
ঘারোয়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. মনসুর মুন্সি বলেন, আজকে অনেক ভালো লাগছে। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যাবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তার কারণেই আজ এ অঞ্চলের মানুষ যোগাযোগের ক্ষেত্রে আধুনিক সুবিধা পেয়েছেন। সড়ক সেতুর পর এখন ট্রেনও চালু হওয়ার পথে। এটা আমাদের বড় প্রাপ্তি। প্রার্থনা করি আল্লাহ প্রধানমন্ত্রীকে দীর্ঘ জীবন দান করুন।
স্থানীয়রা বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চালুর কারণে যে শুধু মানুষের যাতার্য়াতের সুবিধা হবে তা কিন্তু নয়। এর ফলে এই অঞ্চলের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যাবে। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পঞ্চিমাঞ্চলের কৃষক এতদিন উৎপাদিত পণ্য নিজের এলাকাতেই বিক্রি করতেন। এখন সেগুলো পৌছে যাবে দেশের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে। এতে করে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ স্বাবলম্বি হবেন। এ কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার কারণেই এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু চালুর পর মানুষের ভাগ্যের চাকা পাল্টে গেছে। এখন ট্রেন চলাচল শুরু হলে কম খরচে পণ্য পরিবহন করা যাবে।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ৭ মিনিটে ঢাকার কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া পরীক্ষামূলক ট্রেনটি দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ভাঙ্গা স্টেশনে পৌঁছে যায়। এ যাত্রায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে ট্রেনটির সময় লাগে মাত্র সাত মিনিট।
কমলাপুর ছাড়ার আগে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতুতে রেল যুক্ত হওয়ায় শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয়, সারা দেশের মানুষ এর সুফল পাবে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন বয়ে আনবে। আমরা যেভাবে রেলের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করছি, এর সুফল দেশের মানুষ পাবে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণসহ পদ্মা সেতু রেল সংযোগের পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালে জুনের মধ্যে শেষ হবে। ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এ কারণে আগামী ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পর পরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে। ইতিমধ্যে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত অংশের কাজ শেষ হয়েছে।
প্রকল্প সূত্র জানা গেছে, পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত তিনটি অংশে রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার মেইন লাইন, ঢাকা-গেন্ডারিয়া পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার ডাবল লাইন, লুপ, সাইডিং ও ওয়াই-কানেকশসসহ মোট ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার ব্রড গেজ রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।
গত বছর ২৬ জুন পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের প্রায় তিন মাস পর গত বছর ২০ আগস্ট পদ্মার মূল সেতুর জাজিরা প্রান্তে রেললাইন বসানোর কাজের উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী। মূল এবং দুপাশের ভায়াডাক্ট মিলিয়ে পদ্মা রেলসেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। রেলসেতুতে আটটি মুভমেন্ট জয়েন্ট রয়েছে। বিশেষ তাপমাত্রায় মুভমেন্ট জয়েন্টের ইস্পাতের স্লিপারগুলো চীন থেকে তৈরি করে আনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ডিপিপি অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের ব্যয় আরও ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বৃদ্ধি করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২৪ সালে জুনে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো প্রস্তাব অনুমোদন দেয় একনেক।
জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পের অর্থায়নে করছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের ঋণ সহায়তা হচ্ছে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। বাকি ১৮ হাজার ২২১ কোটি ৪৪ টাকা ব্যয় হবে সরকারি তহবিল থেকে। মূল প্রকল্পে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ছিলো ৯ হাজার ৯৫৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। প্রকল্পটিতে সরকারি অর্থায়ন ১৮ হাজার ২২১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া চীন সরকার জি-টু-জি পদ্ধতিতে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা অর্থায়ন করতে সম্মত হয়েছে। যা আগে ছিল ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের এপ্রিলে চীনের সঙ্গে চূড়ান্ত ঋণচুক্তি হয়। এর দুই বছর আগে কমার্শিয়াল চুক্তি হয়েছিল। প্রকল্পের নির্মাণ কাজ করছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি।
থাকছে ২০টি স্টেশন
পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্পে কমলাপুর থেকে যশোর পর্যন্ত ২০টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১৪টি স্টেশনই হবে নতুন। পুরোনো ছয়টি স্টেশনকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে। কেরানীগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের নিমতলায় নতুন দুটি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর ও মাওয়া স্টেশন নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। মাওয়া স্টেশনের পরে পদ্মা সেতু পার হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরায় নির্মিত হচ্ছে ‘পদ্মা স্টেশন’। পদ্মা স্টেশনের পরে শরীয়তপুরে ‘শিবচর স্টেশন’।
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় উন্নত দেশের আদলে নির্মাণ করা হচ্ছে জংশন। ভাঙ্গা থেকে একটি লুপ লাইন ফরিদপুর সদর ও অন্য একটি লুপ লাইন নাগরকান্দা পর্যন্ত যাবে। প্রকল্পের আওতায় নাগরকান্দায় স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এরপরে গোপালগঞ্জের মকসুদপুর ও মহেশপুরে নির্মিত হবে দু’টি রেলস্টেশন। এছাড়া নড়াইলের লোহাগড়া, নড়াইল সদরে একটি করে স্টেশন নির্মাণ করা হবে। যশোরের জামদিয়া ও পদ্মবিলে দুটি নতুন স্টেশন নির্মাণ করা হবে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে।
প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান ছয়টি রেলস্টেশন ঢেলে সাজানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। এছাড়া গেন্ডারিয়া ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন নান্দনিক করে গড়ে তোলা হচ্ছে। সংস্কার করা হচ্ছে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি, যশোরের সিংগাই ও রূপদিয়া স্টেশন।