পবিত্র কুরআনে কারীমায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা তার নিজের অধিকারের পরই মাতা-পিতার অধিকারের কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে ইসলামে যে নির্দেশনা রয়েছে তা সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব, ইনশাল্লাহ্।
১. মাতা-পিতার সাথে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে উত্তম আচরন করা, তাঁদের সঙ্গে সর্বদা কোমল আচরণ করা। কখনো বিরক্তি কিংবা অনীহা প্রকাশ না করা।
২. আদব রক্ষা করে চলা, অর্থাৎ মাতা-পিতার সঙ্গে সর্বদা নীচু অওয়াজে ও কোমল কন্ঠে কথা বলা তাঁদের নাম ধরে না ডাকা এবং চলার সময় তাঁদের পিছনে পিছনে চলা।
৩.কৃতজ্ঞ হওয়া, আল্লাহ তা’য়ালার নিয়ামতরাজিকে যেমন কেউ গণনা করে শেষ করতে পারে না, তেমনিভাবে মাতা-পিতার অনুগ্রহকেও কেউ হিসেব করে শেষ করতে পারবে না। এজন্য সর্বদা মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া।
৪.আনুগত হওয়া, মাতা-পিতার আনুগত্য ওয়াজিব। তাদের আদেশ-নিষেধ সন্তানের জন্য অপরিহার্য। বুযুর্গানে দ্বীন বলেন, মাতা-পিতার নাফরমানীর শাস্তি হলো, মৃত্যুকালে কালিমা নসীব না হওয়া।
৫. অবাধ্য না হওয়া, হাদীসে এসেছে, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান জান্নাতে যাবেনা।
৬. খিদমত করা, হিজরত ও জিহাদ আল্লাহ তা’য়ালার কাছে দুটি প্রিয়তম বস্তু। বস্তুত, যদি কারও মাতা-পিতা অসুস্থ কিংবা বৃদ্ধ হয়ে যায় এবং ঐ সময় তাদের সেবা-শূশ্রƒশা করার মত কেউ না থাকে, যখন তাদের জন্য প্রয়োজন খেদমত তবে তাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ আমল থেকে পর্যন্ত অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সে হিজরত ও জিহাদকারীদের সমতুল্য সওয়াব প্রাপ্ত হবে।
৭. তাদের আরামের জন্য চিন্তা ও ব্যবস্থা করা।
৮. স্ত্রী-সন্তান, সম্পদ সবকিছুর উপর মাতা-পিতাকে প্রাধান্য দেওয়া।
৯. কোনো প্রয়োজনে ডাকলে সাথে সাথে সাড়া দিয়ে উপস্থিত হওয়া।
১০. তাঁদের প্রয়োজন মেটানো, তাঁদের প্রয়োজনগুলির দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখা, যেমন খাবার, পরিধেয় বস্ত্র ইত্যাদি তাঁরা বলার আগেই তা পুরা করার চেষ্টা করা।
১১. তাঁদের জন্য সাধ্যানুযায়ী ব্যায় করা।
১২. উত্তম জিনিস পছন্দ করা। তাঁদের খানা-পিনা, পরিধেয় বস্ত্র, ব্যবহার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে উত্তম বস্তুটিই পছন্দ ও ব্যবস্থা করা।
১৩.দূরে থাকলে তাদের সাথে মাঝে মধ্যে সাক্ষাৎ করা ।
শুধুমাত্র জীবিত অবস্থায় নয় মাতা-পিতার মৃত্যুর পরও সন্তানের জন্য রয়েছে অনেক করনীয়:
১৪. দোওয়া করা, মাতা-পিতার মৃত্যুরপর সন্তানের পক্ষ থেকে মাতা-পিতার জন্য দোওয়া করা হচ্ছে তাদের জন্য সর্বত্তম কল্যাণ কামনা। পবিত্র কুরআনে কারীমায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা মাতা-পিতার জন্যে দোয়া করতে শিখিয়েছেন, ‘হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’ (বনি ইসরাইল :২৪)
১৫. নেক কাজ করে তাদের জন্য সাওয়াব রেছানী করা।
১৬.মাতা-পিতার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে উত্তম আচরন করা।
১৭. তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা ও সাহায্য করা।
১৮. সাদকা করা, মাতা-পিতা বেঁচে থাকতে দান-সাদকাহ করে যেতে পারেন নি বা বেঁচে থাকলে আরো দান-সদকাহ করতেন, সেজন্য তাদের পক্ষ থেকে দান-সদকাহ করা।
১৯. মাতা-পিতার ভাল কাজসমূহ জারী রাখা, মাতা-পিতা যেসব ভাল কাজ যেমন, মসজিদ তৈরী করা, মাদরাসা তৈরী করা, দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীসহ যে কাজগুলো করে গিয়েছেন সন্তান হিসাবে তা যাতে অব্যাহত থাকে তার ব্যবস্থা করা। কেননা এসব ভাল কাজের সওয়াব তাদের আমলনামায় যুক্ত হতে থাকে।
২০. কোনো গুনাহের কাজ করে গেলে তা বন্ধ করা, মাতা-পিতা বেঁচে থাকতে কোনো গুনাহের কাজের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তা বন্ধ করতে হবে বা শরীয়াহ সম্মতভাবে সংশোধন করে দিতে হবে।
২১. ওয়াদা করে গেলে তা বাস্তবায়ন করা, মাতা-পিতা কারো সাথে কোনো ভাল কাজের ওয়াদা করে গেলে বা এমন ওয়াদা যা তাঁরা বেঁচে থাকলে করে যেতেন, সন্তান যথাসম্ভব তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।(সূরা বনি ইসরাঈল:৩৪)
২২. মাতা-পিতার পক্ষ থেকে মাফ চাওয়া, মাতা-পিতা বেঁচে থাকতে কারো সাথে খারাপ আচরণ করে থাকলে বা কারো উপর জুলুম করে থাকলে বা কাওকে কষ্ট দিয়ে থাকলে মাতা-পিতার পক্ষ থেকে তার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিবে অথবা ক্ষতি পূরণ দিয়ে দিবে।
২৩. ঋণ পরিশোধ করা, মাতা-পিতার কোনো ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধ করা। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসে রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তির আত্মা তার ঋণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে যায়; যতক্ষণ তা তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হয়।’ (সুনান ইবন মাজাহ) ঋণ পরিশোধ না করার কারণে জান্নাতে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়; এমনকি যদি আল্লাহর রাস্তায় শহীদও হয়। হাদীসে আরো এসেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দার ঋণ পরিশোধ না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (নাসায়ী )
২৪. কাফফারা আদায় করা, মাতা-পিতার কোনো শপথের কাফফারা, ভুলকৃত হত্যাসহ কোনো কাফফারা বাকী থাকলে তা পূরণ করা।
২৫. বৈধ ওসিয়ত পূর্ণ করা, মাতা-পিতা শরীয়াহ সম্মত কোনো ওসিয়ত করে গেলে তা পূর্ণ করা।
২৬. রোজা রাখা, মাতা-পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় যদি তাদের কোনো মানতের রোজা বা ওয়াজিব রোজা কাযা থাকে, সন্তান তাদের পক্ষ থেকে রোজা পালন করলে তাদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে।
২৭. হজ্জ বা উমরাহ করা, মাতা-পিতার পক্ষ থেকে হজ্জ বা উমরাহ করলে তা আদায় হবে এবং তারা উপকৃত হবেন।
২৮. মানত পূরা করা, মাতা-পিতা যদি রোজা, হজ্জ অনূরুপ কোনো মানত করে তবে তাঁর পক্ষ থেকে মানত পূরা করা।
২৯. কুরবানী করা, মাতা-পিতার পক্ষ থেকে কুরবানী করলে তার ছাওয়াব দ্বারা তারা উপকৃত হবে।
৩০. কবর জিয়ারত করা, সন্তানের জন্য এটাও জরুরী যে, সে মাঝে মধ্যে তার মাতা-পিতার কবর জিয়ারত করবে। এর মাধ্যমে সন্তান এবং মাতা-পিতা উভয়ই উপকৃত হবে। তবে কবর যিয়ারত কোন দিনকে নির্দিষ্ট করে না করা।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে মাতা-পিতার কল্যাণ কামনার দ্বারা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফীক দান করুন।(আমীন)
লেখক:
বয়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়, খুলনা।