বীর নিবাসের চাবি পেয়ে কাঁদছিলেন নড়াইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সবুর। লোহাগড়া উপজেলার কুমড়ী গ্রামের বসিন্দা তিনি। এখন তাঁর বয়স ৭৫এর বেশি। এই কান্না ছিল আনন্দের। তিনি বলছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর জীবনের ঘানি টানতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের জন্যে মাথার নিরাপদ আশ্রয় বানিয়ে দিতে পারেননি। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ তাঁর অসামপ্ত কাজটি করে দিলেন। শেষ জীবনে এমন নিরাপত্তা পেয়ে তিনি তাঁর পরিবার অভিভূত।
ওই দিনের অনুষ্ঠানেই শেখ হাসিনা সারাদেশে প্রায় পাঁচশ’ বীর নিবাসের চাবি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এরইমধ্যে পাঁচ জেলায় পাঁচ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে চাবি হস্তান্তর করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কাজ চলছে আরও ২৫ হাজার বীর নিবাস তৈরির। সারাদেশে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এরকম ৩০ হাজার ‘বীর নিবাস তৈরি করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এটা মূলত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্যে শেখ হাসিনার বিশেষ আবাসন প্রকল্প।
এই প্রকল্পের প্রতিটি বাড়ির আয়তন ৭৩২ বর্গফুট। একতলা বাড়িতে দুটি শেবার ঘর একটি বসার ঘর , একটি খাওয়ার ঘর, একটি রান্নাঘর, একটি প্রশস্ত বারান্দা ও দুটি শৌচাগার থাকছে। প্রতিটি বাড়িতে থাকছে একটি উঠান, একটি নলকূপ, গবাদি পশু-হাঁস-মুরগি পালনের আলাদা ব্যবস্থা। প্রতিটি বাড়ি তৈরি করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ লাখ ১০ হাজার টাকা।
মুক্তিযোদ্ধাদের এই নিরাপদ আবাসনের মত সারাদেশের গ্রাম গঞ্জ শহরে নগরে চলছে মানুষ নিরাপদ আশ্রয় দেয়ার কর্মযজ্ঞ। এখানে প্রান্তীক ভূমিহীন মানুষ রয়েছেন, রয়েছেন ভিভিন্ন শ্রেণি পেশার কম আয়ের মানুষ। যার যেমন আয় তার জন্যে তেমন করে ভাবা হয়েছে এই প্রকল্পে। বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় এসেছেন দেশের একজন মানুষও নিরাশ্রয় থাকবে না।
আশ্রয়হীন মানুষের মাথার ওপর নিরাপদ আশ্রয় দেয়ার এই চিন্তা শুরু করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে প্রথম ভূমিহীন-গৃহহীন, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয়ণ শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার দীর্ঘ ২১ বছর পর আবার পরিকল্পিতভাবে মানুষের আবাসনের কাজ শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।
১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর বঙ্গবন্ধুর জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের আলোকে তাঁর ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মডেল’ সামনে আনেন। পিছিয়ে পড়া ছিন্নমূল মানুষকে মূলধারায় একে এক যুক্ত করতে থাকেন। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিনে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন। একই বছর তিনি সারা দেশের গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষের পুনর্বাসনের জন্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে শুরু করেন “আশ্রয়ণ প্রকল্প”।
১৯৯৭ সালে “আশ্রয়ণ প্রকল্প” নেয়ার আগেই ১৯৯৬ সালে বস্তিবাসী,হরিজন ও দলিত শ্রেনির মানুষের জন্য ভাসানটেকে ফ্ল্যাট নির্মাণ শুরু করেন। পরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অব্যবস্থাপনায় হারিয়ে যায় সেই প্রকল্প। ২০০৯ সালে সরকারে এসে শেখ হাসিনা আবার নতুন ভাবে সেই কাজ শুরু করেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ পর্যন্ত ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৪৩২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাথা গোজার ঠাঁই হয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ২১১টি উপজেলা গৃহহীন ও ভূমিহীন মুক্ত হয়েছে। পূর্ণাঙ্গভাবে গৃহহীন-ভূমিহীন হয়েছে নয়টি জেলা ।
গ্রাম শুধু নয় নগরে বাস করা প্রান্তিক মানুষের আবাসনের কথা ভেবেছেন শেখ হাসিনা। শহরের বস্তিবাসীদের থাকার সুবিধার জন্যে ২০২১ সালে মিরপুরে ৩০০টি ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট উদ্বোধন ও হস্তান্তর করেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা ভাড়ায় অত্যাধুনিক এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দ পান বস্তিবাসী। এ প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে ঢাকায় ১০০১ টি ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট নির্মাণ চলছে।
অনগ্রসর দলিত-হরিজন-বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে চলছে আবাসন কর্মসূচি। ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে পাইলট কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, নওগাঁ, যশোর ,বগুড়া এবং হবিগঞ্জে। পরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নতুন ১৪ জেলাসহ মোট ২১টি জেলায় এ কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু হয়। এরই মধ্যে সব জেলায় ধারাবাহিকভাবে শুরু হয় এ কর্মসূচি।
আবাসনের আ্ওতায় আনা হয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদেরও। যাদের ভূমির কোন অধিকার কিংবা মাথা গোঁজার ঠাঁই কখনও হয়নি। তাদের কথ্ওা ভাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুজিববর্ষ উপলক্ষে সমতলের বাসিন্দা সাড়ে তিন হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারকে দেয়া হয় আধাপাকা ঘর।
সব শেষ সাধারণ পেশাজীবীদের জন্যে ভাবতে শুরু করেছেন শেখ হাসিনা। শুরুতেই বর্তমান সরকার সাংবাদিকদের আবাসনের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন সাংবাদিকরা চাইলে সহজ কিস্তিতে সরকারি ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন। প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, সাংবাদিকতায় সরকারি চাকরির মত অবসর ভাতার ব্যবস্থা নেই। যে কারণে চাকরি জীবনের শেষে তাদের আবাসন নিশ্চিত করতেই প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ।
এই আবাসন প্রকল্পগুলোতে মানুষকে শুধু আশ্রয় দিয়ে সরকার দায়িত্ব শেষ করেছে এমন নয়। কয়েকটি বিশেষ ব্যবস্থাপনা এই কাজের সঙ্গে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। যমেন নারীর ক্ষমতায়ন। আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়কেই জমির মালিকানার গ্যারান্টি দেয় হয়। যা কেবল একজন পুরুষ এবং তার পরিবারকে মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার সুযোগই দেয় না বরং নারীর ক্ষমতায়নের একটি বিরল উদাহরণও সৃষ্টি করে।
আশ্রয়ণের আওতায় এসে মানুষের জীবন যাপন হয়েছে পরিকল্পিত। কারণ সেখানে ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল অসহায় দরিদ্র মানুষকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়ে জীবিকা নির্বাহের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা চলছে। গৃহহীন মানুষের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বেড়েছে। তারা সমাজে একীভূত হতে পারছে। তাদের সম্মানজনক জীবনযাত্রা এবং সামাজিক অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সর্বোপরি বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে গৃহায়ন কার্যক্রম। শুধু গৃহ নির্মাণের ফলে মানুষের জীবনের টেকসই উন্নয়নের নানামুখী লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। কারণ গৃহায়নের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য,নিরাপত্তা, ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার প্রাপ্তি সম্পৃক্ত। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নানা ইতিবাচক বদল এরইমধ্যে সবার চোখে পড়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের এই আবাসনের উদ্যোগের তথ্য বিশ্বের অনেক দেশের কাছে একটি একটি অনন্য উদ্যোগ। কারণ পড়া মানুষের সাহায্যে নানা দেশে নানা উদ্যোগ থাকলেও সরকারিভাবে বাড়ি নির্মাণ করে ঠিকানাহীন মানুষকে ঠিকানা দেয়ার এমন নজির সাধারণত দেখা যায়নি।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।