অন্যের জমি জাল করে নিজের নামে রেজিস্ট্রি ও খারিজ, সরকারি অর্পিত সম্পত্তি নিজের নামে রেজিস্ট্রি, অন্যের জমি নিজের দাবি করে মামলা করে হয়রানিসহ প্রতারণামুলক নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত মীর কামরুজ্জামান ওরফে লেনিন। মীর কামরুজ্জামান মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের মৃত মীর লুৎফর রহমানের ছেলে।
প্রতারণা মূলক কর্মকাণ্ড করতে কখনো পরিচয় দেন হাইকোট বা জজকোর্টের আইনজীবী, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবার কখনো সাংবাদিক। মূলত তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে চাকরিরত অবস্থায় অসাদাচরণ করার দায়ে চাকরিচ্যুত হন। তাকে ঠক ও প্রতারক নামেই চেনেন এলাকাবাসী। তার প্রতারণার শিকারে কয়েকটি পরিবার পড়েছে বিপদে। আদালতে ঘুরতে ঘুরতে তারা হচ্ছেন নি:স্ব। এমনকি জাল খারিজের জমির কাগজ স্থানীয় কৃষি ব্যাংকে জমা দিয়ে ঋণ গ্রহণ করেছেন। যা খেলাপি হিসেবে গণ্য করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
তার প্রতারণা থেকে বাঁচতে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা সহকারী কমিশনার ও থানায় অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন থেকে তদন্ত শুরু হয়েছে।
তবে অভিযুক্ত কামরুজজামান ওরফে লেনিনের দাবি ভুলে দলিলে অ্যাডভোকেট লেখা হয়েছে। আমেরিকা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় ধানমণ্ডি শাখায় খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি এখন আর করিনা। বর্তমানে আজকের দর্পণের মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি বলে তিনি দাবি করেছেন।
বিভিন্ন অভিযোগ, কাজপত্র ঘেঁটে ও সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, কামরুজ্জামানের প্রতারণা থেকে বাঁচতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করেছেন আজগর আলী ও আব্দুল মান্নান। আজগর আলী স্থানীয় ইউপি সদস্য।
আবেদনে তারা বলেছেন, মীর কামরুজ্জামান তার দুই ভাইয়ের জমি জাল করে রেজিস্ট্রি করে নেয়। যার দলিল নম্বর ৯০৯৩/১৪। একই দলিলে খতিয়ান ১৯৯৬ এর ৪৭০২ দাগ সম্বলিত লুৎফর রহমান শাহ্র ১৫ শতক জমিও জাল করে রেজিস্ট্রি করে নেন মীর কামরুজ্জামান। এছাড়াও একই দলিলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ডেপুটি কমিশনার মেহেরপুর নামে পক্ষে আর এস রেকর্ডকৃত সম্পতি দাগ ৪৪৪৪, ৪৪৫০ (১৯ শতক) এবং ৪৭০২(০২ শতক) যা ঐ সময়কার গাংনীর সাব রেজিস্টার আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে নিজ নামের দলিলে রেজিস্ট্রি করে নেন মীর কামরুজ্জামান।
মীর কামরুজ্জামানের প্রতিবেশী মারজুয়া খাতুনের কাছে ৪ শতক এবং তহমিনা খাতুন নামের একজনের কাছে ৫ শতক জমি বিক্রি করেন তার বাবা লুৎফর রহমান। পরে রোজিফা খাতুন ও তার স্বামী মো: কালু তহমিনার কাছে থেকে ওই ৫ শতক জমি ক্রয় করে বসবাস করে আসছেন। এছাড়া বানুয়ারা খাতুনের স্বামী আব্দুল মান্নানকে জেলা প্রশাসন থেকে ভুমিহীন হিসেবে ৪ শতক জমি ৮৫৮৩ নম্বর দলিল মূলে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। যার নম্বর ১৪২/১২/২০০৪-২০০৫। এই তিনজনের জমি, সরকারের পক্ষে ডেপুটি কমিশনারের জমি এবং আমজাদ শাহ ও শরিকদের জমি ২০১৪ সালে নিজ নামে খারিজ করে নেন মীর কামরুজ্জামান। এর মধ্যে সবগুলো জাল করে রেজিস্ট্র করতে পারলেও সরকারের রেকর্ডকৃত জমি খারিজ করতে পারেননি।
অভিযোগে আরো জানা গেছে, গ্রামের ইউপি সদস্য আজগার আলীর ৬৬ শতক আবাদি জমি জাল কাগজ বানিয়ে নিজের নামে করে নিয়ে করিয়ে নিয়েছেন মীর কামরুজ্জামান। ২ টাকা চার আনা মূলের ১৯৫০ সালের (বাংলা ১৩৫৭) একটি এক পাতার জাল বন্দবস্তের কাগজ বানিয়ে ১৪ বছর ধরে হয়রানি করানো হচ্ছে তাকে। ওই জমি নিয়ে মেহেরপুরের সহকারী জজ আদালত এবং জেলা জজ আদালত থেকে ২টি মামলার রায় পক্ষে পেয়েছেন আজগার আলী। তবুও হয়রানি করা ছাড়েননি লেলিন, পরে তিনি রিভিশন দায়ের করেছেন উচ্চ আদালতে। উচ্চ আদালত স্থিতিবস্থার আদেশ দিয়েছেন। যা দেখে জেলা জজ আদালতের জিপি শাজাহান আলী প্রত্যায়নে বলেছেন, যার দখলে আছে তার দখল বজায় থাকবে।
তেরাইল গ্রামের মৃত লুৎফর রহমান শাহর ছেলে আমজাদ শাহ বলেন, আমার দাদা, বাবা, চাচারা এই জমিতে বাস করেছেন। আমার বয়সও ৬২ বছর। হঠাৎ করি শুনছি ২০১৪ সালে মীর কামরুজ্জামান জমি জাল রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে। মাস খানেক আগে আমরা জানতে পেরে গাংনী থানায় একটি অভিযোগ করেছি। অভিযোগ করায় কামরুজ্জামানের লোকজন আমাদের হাত পায়ে ধরে বলে কাউকে জানাইও না। আমরা ঠিক করে দেবো। আমরা এখন বিপদে আছি। আমরা এর বিচার চাই।
ভুক্তভুগি আজগার আলী জানান, আদালতের নির্দেশে জমিতে চাষ করতে গেলেও কামরুজ্জামান পুলিশ দিয়ে হয়রানি করছে। যে কারণে বাধ্য হয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করেছি।
ভুক্তভোগী রোজিফা খাতুন বলেন, প্রায় ১০ বছর আগে তহমিনার সাথে ৫ শতক জমি কিনেছি। কিন্তু ওই জমি লেনিন (কামরুজ্জামান) জাল করে খারিজ করে নিয়েছে। ওই খারিজ বাতিলের আবেদন করেছি এসিল্যান্ডের কাছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, জমি কেনার ৩ বছর পর মীর কামরুজ্জামান আমাকে বলছিলো তোমার জমিটা আমাকে ফেরত দাও। আমি ভিতরের জমি তোমাকে দিচ্ছি। আমরা গরীব মানুষ, খেয়ি না খেয়ি এই জমি কিনেছি। আমার জমি অল্প হোক। আমি এই পজিশনের জন্য ভেতর থেকে চলে এসেছি, আমি এখানেই থাকব, ওই জমি আমি নেবো না।
ভুক্তভোগী মারজুয়া খাতুন বলেন, আমরা কামরুজ্জামানের বাবা লুৎফর রহমানের কাছে থেকে ৪ শতক জমি কিনেছি প্রায় ৩০ বছর আগে। এখন শুনছি আমাদের জমিও মীর কামরুজ্জামান জাল করে খারিজ করে নিয়েছে। আমরা কাগজ তুলে দেখছি এই অবস্থা। এছাড়া নানা ধরণের অত্যাচার করে কামরুজ্জামানের পরিবারের লোকজন।
ভুুক্তভোগী আব্দুল মান্নানের স্ত্রী বানুয়ারা খাতুন বলেন, আমাকে সরকার ৪শতক জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে। এটা নিয়েও কামরুজ্জামান মামলা করে হয়রানি করছে। আমি অনেক কষ্ট করে লোন করে জমি খারিজ করছি। লোনের টাকা দিতে পারিনি। আমার কষ্ট দেখে লোন কোম্পানীর (এনজিও) অফিসার ২ হাজার টাকা মাফ করে দিয়েছে, সে আর টাকা নেইনি। আমরা কামরুজ্জামানের বিচার চাই।
অভিযুক্ত মীর কামরুজ্জামান বলেন, কয়েকটি দলিলে ভুলে অ্যাডভোকেট লেখা হয়ে গেছে দলিল সংশোধন করার মামলা করেছি। এছাড়া আমজাদ শাহ্দের জমি গুলো ভুলে আমার ভাই, বোন ও মা আমার নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে। এছাড়া ভুলে আরো কয়েকজনের জমি আমার নামে রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। ওই দলিল বাতিলের জন্যও আদালতে আমার ভাই মামলা করেছেন। তবে আজগর আলীর জমিটা নিজেদের বলে দাবি করেছেন তিনি।
এদিকে মামলার নথিতে উল্লেখ, ভাইদের জমি জাল করে রেজিস্ট্র করে নেওয়ায় তার ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
এ ব্যাপারে গাংনীর সহকারী কমিশনার ভূমি (এসি ল্যাণ্ড) নাজমুল আলম,পিএএ বলেন, কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে আবেদন পাওয়ার পর আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠণ করেছি। আপাতপক্ষে বাদিপক্ষের আবদেনে সত্যতা আছে বলে মনে হচ্ছে। তদন্তে মীর কামরুজ্জামান যথাযথ কাগজপত্র দাখিল করতে না পারলে তার খারিজ বাতিল করা হবে।
এছাড়া সরকারের অর্পিত সম্পত্তিও মীর কামরুজ্জামান রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন তবে সেটি খারিজ করতে পারেননি। সেটিও তদন্ত করা হবে। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে এই প্রতারণা গুলো করেছেন বলে কাগজপত্রে মনে হচ্ছে। প্রতারণার দায়ে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।( চলবে…)