সাপ দেখেনি কেউ। অথচ, সাপ আতংকে ভুগছেন গ্রামের নারী পুরুষ, বৃদ্ধ বনিতা সকলেই। সাপ থেকে বাঁচতে গ্রামবাসি এখন সাপুড়ে ও ওঝাদের কাছ থেকে ঝাঁড়ফুক নেওয়ার পাশাপাশি নিচ্ছেন কার পড়া। শিক্ষিত আর অশিক্ষত নয়, সকলেরই এখন রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে এই সাপ আতংকে।
আর এ সুযোগে এলাকার কবিরাজরা (ওঝাঁ) এগুলোকে জ্বীন সাপের কাজ বলে গুজব ছড়িয়ে জনতার মাঝে আতংক বাড়িয়ে তুলছেন। সেই সাথে হাতিয়ে নিচ্ছেন অর্থ।
মেহেরপুর সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম উজুলপুর। প্রকৃতিতে ঘেরা শান্ত গ্রামটিতে অধিকাংশ মানুষ কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িত। পাখির ডাক আর প্রকৃতির মৃদুমন্দ হাওয়ায় তাদের ঘুম ভাঙ্গে প্রতিদিন।
১৩ মে সকালে হঠাৎ গ্রামের মানুষ জানতে পারেন উজলপুর গ্রামের কুঠিপাড়া এলাকার কৃষক কামাল হোসেনের ছেলে ৮ম শ্রেনীর ছাত্র মুরসালিন সাপের কামড়ে মারা গেছেন।
মাঝরাতে সাপে কাটে মুরসালিনকে। ওই রাতে তাকে আড়াইশ বেডের মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্ত করা হয়। ভোর রাতের দিকে মারা যায় মুরসালিন।
পরের দিন সন্ধ্যায় গ্রামের স্টুডিও ব্যবসায়ী রুবেল আহম্মেদ বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় হাতে কামড় লাগে। সাথে সাথে তার হাতে জালাপোড়া শুরু করে এবং হাত অবশ হয়ে যায়।
রুবেল আহম্মেদ জানান, আমার হাতে সাপে কামড় দেয়ায় পাশের শোলমারী গ্রামের ওঝাঁ (কবিরাজ) রতন হোসেনকে ফোনে জানায়। ওঝাঁ আয়াতুল কুরছি পড়ে ফুঁ দিতে বলেন। আমি আয়াতুল কুরছি পড়ে ফুঁ দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্বালা পোড়া শেষ হয়।
স্থানীয় মাঠে কাজ করছিলেন ওই গ্রামের হেলাল উদ্দীন নামের এক কৃষক। হঠাৎ তার হাতে কামড় দেই সাপে। পরে তাকে উদ্ধার করে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্ত করা হয়।
হেলাল উদ্দীন জানান, মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে তিনদিন চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছি। পরের দিন একই গ্রামের কুঠিপাড়া এলাকার গৃহবধু চাদনী বেগমকে কামড় দেই।
দুদিন পর কুঠিপাড়া এলাকার গৃহবধু চাঁদনীকে সাপে কাটে। চাঁদনী জানান, বিকালের দিকে হঠাৎ আমার বাম হাতের কনুইয়ের উপর মাছলে জালা পুড়া শুরু হয়। আমার স্বামী ও পরিবারের লোকজনকে জানানোর পর আমাকে পাশের গ্রামের ওঝাঁ রতনের কাছে নিয়ে যায়। সব কিছু জানার পর সে আমাকে কিছু ঝাঁড়ফুক দেন এবং গলায় কার পরিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পরে আমার জালা পোড়া সেরে যায়।একই সময়ে নুর আলী নামের এক কৃষকের বুকে সাপে কাটে। কৃষক নুর আলী শোলমারী গ্রামের ওঝাঁ আবুল হাসেমের কাছে গিয়ে ঝাঁড়ফুক নিয়ে সুস্থ্য হয়। নুর আলী বলেন, সাপ আতংকে পরিবার পরিজন নিয়ে দিন কাটাচ্ছে গ্রামের হাজারো মানুষ। তাই আমার পরিবারের লোকজনকে সাপ থেকে বাঁচাতে কবিরাজ (ওঝাঁ) আবুল হাসেমের কাছ থেকে কার পড়া নিয়ে সবাই গলায় ঝুলিয়ে রাখছি।তিনি জানান, সাপের কামড়ে রোগীর শরীরে বিষ থাকলে ওঝাঁদের ফিস লাগে ৫ শ টাকা আর বিষ না থোকলে তিন শ টাকা দিতে হচ্ছে।
গত দুই সপ্তাহে উজুলপুর গ্রামটিতে টিপু মনিসহ প্রায় শতাধিক মানুষকে এই জ্বীন সাপে কেটেছে বলে গুজব উঠেছে। গ্রামের স্কুল ছাত্র স্বাধীন, মোবারক হোসেন, কলেজ ছাত্র নাজমুল হোসেন জানান, এপর্যন্ত অর্ধশতাধিক ব্যাক্তিকে সাপে কাটার কথা ছড়ালেও এখনও কেউ সাপ দেখতে পাননি। তবে কবিরাজ ও ওঝারা এটিকে জিন সাপ বলে প্রচার করছেন। মানুষ বাধ্য হয়েই সেটাকে মেনেও নিচ্ছেন।
শোলমারী গ্রামের ওঝাঁ (কবিরাজ) আবুল হাসেম ও রতন হোসেন জানান, গ্রামে এখন পর্যন্ত যাদের সাপে কেটেছে তাদের মধ্যে একজন মারা গেছে। বাকীদের ঝাঁড়ফুক দিয়ে সুস্থ্য করা সম্ভব হয়েছে।
এটা প্রকৃতপক্ষে সাপ না বলে মত দেন এই দুজন কবিরাজ। তারা বলেন, সাপ সেজে জ্বীন এসে মানুষকে কামড় দিচ্ছে। যে কারণে তাদের বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে।
কুতুবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম রেজা জানান, সাপের কামড়ে এক ছাত্রের মৃত্যুর পর বেশ কয়েকজনকে সাপে কাটে। এই সাথেই শুরু হয়েছে গুজব।এটাকে জ্বীন সাপ বলেও দুজন ওঝাঁ মত দিলে আতংক আরও বেড়ে যায় গ্রামবাসির মধ্যে। আমি ইতোমধ্যে আতংকিত না হতে বলেছি। গ্রামবাসির মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে নানাভাবে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছি।
প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে কবিরাজী করার অভিজ্ঞতা মেহেরপুর শহরের ইনছান সাপুড়ের।জ্বীন সাপের কথা শুনে তিনি বলেছেন, আমার পঞ্চাশ বছরের সাপুড়ে পেশায় জ্বীন সাপ আছে বলে জানিনে এটা।
মেহেরপুর সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. অলোক কুমার দাশ বলেন, এটা শ্রেফ গুজব। ঘটনাটি জানার পর স্বাস্থ্য বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই গ্রামটিতে পরিদর্শন করা হয়েছে। একটি চক্র আতংক ছড়িয়ে ফায়দা লুচতে চাচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। গ্রামবাসির মনোবল ধরে রাখতে উজুলপুর গ্রামে একটি মেডিকেল টীম সার্বক্ষণিক কাজ করছে।