মেহেরপুরের দারুস সালাম ক্লিনিকের অপারেশন টেবিলে প্রসূতির মুত্যুর ঘটনায় মেহেরপুর প্রতিদিনে প্রকাশিত সংবাদ আমলে নিয়ে স্বপ্রণোদিত মামলা করেছেন আদালত।
আজ সোমবার মেহেরপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট-১ম আদালতের বিচারক এস এম শরিয়তউল্লাহ স্বপ্রণোদিত এ মামলা করেন। যার নম্বর মিসকেস ০২/২০২৩।
মামলায় মেহেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল)কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে মেহেরপুরের সিভিল সার্জনকে আগামী ৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জেলার হাসপাতাল/ক্লিনিক/ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা আদালতে জমা দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালত মামলার নথিতে বলেছেন, সংবাদ দৃষ্টে দারুস সালাম ক্লিনিকে অপারেশনের সময় এক প্রসুতির মৃত্যু হয়েছে মর্মে দেখা যায়। এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য বিভাগে অভিযোগের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ মৃত্যুর বিষয়টি স্বাভাবিক নয় মর্মে পরিবারের সন্দেহ করছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে। অপারেশনের সময়ে এনেস্থেসিয়োলোজিস্ট হিসেবে যে ডাক্তারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তিনি অপারেশনের সময় উপস্থিত ছিলেন না মর্মে বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এটা সঠিক হয়ে থাকলে তা একটি গুরুতর আইনের লংঘন এবং ইচ্ছাকৃত অবহেলা যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই ঘটনায় বিষয়ে এখনও কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি মর্মে আদালতের গোচরীভূত হয়েছে। এমতাবস্থায়, জনস্বার্থ ও ন্যায় বিচারের উদ্দেশ্যে পুরো ঘটনাটির বিষয়ে প্রশাসনিক তদন্তের পাশাপাশি একটি বিস্তারিত অনুসন্ধান হওয়া সমীচীন বলে আদালত মনে করে। সার্বিক বিবেচনায় The Code of Criminal Procedure, ১৮৯৮ এর ধারা ১৯০ (১) (গ) অনুযায়ী বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত উপর্যুক্ত সংবাদটি বিবেচনায় নিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, মেহেরপুর সদর সার্কেল (স্বয়ং)-কে উল্লিখিত বিষয়ে অনুসন্ধান পূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ প্রদান করা হলো। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে অন্যান্য বিষয়ের সাথে আরো কয়েকটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সেগুলো হলো; ক্লিনিকটির লাইসেন্স আছে কি-না?, যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্লিনিকটি অনুমোদিত হয়ে থাকলে সেটা নবায়নকৃত কি-না?, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র/অনুমোদন আছে কি-না?, ক্লিনিকটিতে সার্বক্ষনিক ডাক্তার আছে কি-না?, অপারেশন পরিচালনাকারী ডাক্তারের সার্জারি ডিগ্রি ছিল কি-না?, অপারেশনের সময়ে এনেস্থেসিয়োলোজিস্ট হিসেবে কোন উপযুক্ত ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন কি-না?, প্রি-এনেস্থেসেয়িটিকক চেক-আপসহ অপারেশনের জন্য নির্দিষ্ট মানদন্ড অনুসরন করা হয়েছিলো কি-না?, সহায়ক নার্সদের উপযুক্ত ডিগ্রি ছিল কি-না?
এছাড়া The Medical Practice and Private Clinics and Laboratories (Regulation) Ordinance, ১৯৮২, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোন বিধানের ব্যত্যয় ঘটয়ে ক্লিনিকটি পরিচালিত হচ্ছে কি-না সে বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করবেন। অনুসন্ধানকালে তিনি সিভিল সার্জন অফিস থেকে গঠিত (যদি থাকে) তদন্ত কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করবেন। অপারেশনের সময়ে সংশ্লিষ্টদের কোন ইচ্ছাকৃত অবহেলা ছিল কি-না, মানদন্ড অনুসরনের ক্ষেত্রে কোন ব্যত্যয় ছিল কি-না এবং মেডিকেল বিষয়ে কোন বিশেষজ্ঞ মতামত প্রয়োজন হলে সিভিল সার্জনের অফিস থেকে সুনির্দিষ্ট মতামত গ্রহন করবেন।
আদালত পর্যবেক্ষনে আরো বলেন, প্রায়ই মেহেরপুরের বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসায় অবহেলার এবং বিধি বহির্ভূতভাবে ক্লিনিক পরিচালনার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এর সাথে সাধারন মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত। একজন অসুস্থ মানুষ চিকিৎসক ও ক্লিনিকের উপর আস্থা এবং বিশ্বাস স্থাপন করে নিজের শরীরের উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার প্রদান করেন। হাসপাতাল, ক্লিনিক বা চিকিৎসকের অবহেলা একজন রোগীর সাথে প্রতারনা এবং বিশ্বাস ভঙ্গের শামিল যা দণ্ডবিধির ধারা ৪০৬ ও ৪২০ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এছাড়া উক্ত অবহেলা একজন ব্যক্তির জীবনকে বিপন্ন করে তুলতে পারে যা দণ্ডবিধির ধারা ৩০৪ক, ৩৩৬, ৩৩৭ ও ৩৩৮ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অধিকন্তু The Medical Practice and Private Clinics and Laboratories (Regulation) Ordinance, ১৯৮২, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ অনুযায়ী নির্ধারিত মানদন্ড অনুসরন না করলে সেটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমতাবস্থায় সিভিল সার্জন, মেহেরপুরকে মেহেরপুর সদর থানাধীন সকল বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক/ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা আগামি ৯ ফেব্রুয়ারি আদালতে দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হলো। এগুলোর মধ্যে কোন কোন প্রতিষ্ঠান The Medical Practice and Private Clinics and Laboratories (Regulation) Ordinance, ১৯৮২, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ এবং আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে সে বিষয়টি তিনি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করবেন।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ জানুয়ারি মেহেরপুর প্রতিদিনে অপারেশ টেবিলে প্রসূতির মৃত্যু শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। মেহেরপুর প্রতিদিনের প্রতিবেদকের কাছে সালাম ক্লিনিকের মালিক ডা. আব্দুস সালাম নিজে অপারেশন করার কথা স্বীকার করেন এবং তাকে ডা. শাহেদ এনেসথেসিস্ট হিসেবে সহযোগীতা করে বলেও জানান। কিন্তু ডা. শাহেদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তিনি ওই দিন ফোন রিসিভ করেন। পরদিন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর ডা. শাহেদ এনেসথেসিয়া করেননি বলে মেহেরপুর প্রতিদিনের কাছে জানান, তবে তাকে লিখিত দেওয়ার কথা বলা হলেও তিনি লিখিত দেননি।