মেহেরপুর জেলার ওপর দিয়ে টানা চারদিনের অবিরাম বৃষ্টিতে মাঠের উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মরিচসহ বিভিন্ন সবজি আউশ ধান বিনষ্টের পাশাপাশি অনেক নিচু এলাকার আমনধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুর ও মাছের ঘের। ক্ষয়ক্ষতি নিরপনে মাঠে কাজ করছে কৃষি অফিস।
গত শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে ঝড়ো হাওয়া ও ভারি বৃষ্টি। এতে আউশধান পানিতে তলিয়ে গেছে ও মাটিতে নেতিয়ে পড়েছে। একই অবস্থা মরিচ,লাউ,চিচিংগা, ঢেড়শ,মিস্টি কুমড়া,বাঁধাকপি, ফুলকপির ক্ষেতসহ বিভিন্ন সবজি ক্ষেতের। কৃষকরা বলছেন, বেশ কয়েক বছর পর অতি বৃষ্টিতে ফসলের ব্যপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকরা মোটা অংকের টাকা লোকসানে পড়বে।
জেলায় আবহাওয়া অফিস না থাকায় আগাম প্রস্ততি নিতে না পারাই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তবে ক্ষয়ক্ষতি নিরপনে কৃষি অফিস কাজ করছে।
শুক্রবার বিকেল থেকে শুরু হয় বৃষ্টি আর মাঝারি ঝড়। গতকাল সোমবার(১৬ সেপ্টেম্বর) বিকেল পর্যন্ত একইভাবে তা অব্যাহত রয়েছে।
সরেজমিনে মেহেরপুর জেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে,পানির নিচে তলিয়ে গেছে নিচু এলাকার জমির ফসল। অন্যদিকে সবজি ক্ষেতে পানি জমে থাকায় গাছ মরতে শুরু করেছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে মরিচ ক্ষেত। আউস মৌসুমের ধান কাটতে যাদের বাকি ছিল তারাও পড়েছেন চরম বিপাকে। এছাড়াও লিচু এলাকার আমন ধান তলিয়ে গেছে প্রানির নিচে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে সবজি ক্ষেত,বাঁধাকপি,ফুলকপি,লাউ,চিচিংগা ও ঢেঁড়সের মাঠ।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী জেলায় চলতি সময়ে ২ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে আউশ,২ হাজার ৬৬০ হেক্টর আমনধান, ৪ হাজার ৫৪৫ হেক্টর মরিচ এবং ৪ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন সবজির আবাদ হয়েছে। যা জেলার সারা বছরের চাহিদা পুরুন করে দেশের বিভিন্ন জেলার চাহিদা পুরুন করে এবং তা বিক্রি করে সংসার খরচ চলে কৃষকদের।
এদিকে ঝড়ো হাওয়া ও ভারি বৃষ্টিতে ক্ষতির পরিমাণ করছে জেলা কৃষি বিভাগ। তথ্য বলছে, শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমির আমনধান, ১৫০০ হেক্টর আউশধান, ৪৫০ হেক্টর জমির মরিচ আবাদ এবং ৮০০ হেক্টর জমির সবজি পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে।
কৃষকরা জানান,দীর্ঘ কয়েক বছর অনাবৃষ্টির এই জেলায় আকস্মিক প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। মেহেরপুর জেলায় আবহাওয়া অফিস না থাকায় বৃষ্টিপাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কোন সংবাদ জানতে পারিনি। দুর্যোগের আগাম সংবাদ পেলে প্রস্ততি নেয়া যেত।
মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালী গ্রামের মরিচ চাষি মতলেব হোসেন বলেন, দুই বিঘা ৫ কাঠা জমিতে মরিচ লাগিয়েছি দেড়মাস আগে। প্রতিটি গাছে ফুল ধরেছে। কিছু গাছে মরিচ ধরেছে। বাতাস ও ভারি বৃষ্টিতে মরিচ গাছ নেতিয়ে পড়েছে। অনেক মরিচ গাছ মরতে শুরু করেছে।
কৃষক ছাইদুল ইসলাম বলেন, দেড়বিঘা জমিতে লাউ আবাদ করেছি। চারদিনের বৃষ্টির পানিতে লাউয়ের মাচা পর্যন্ত পানি উঠেছে। এভাবে পানিতে জমি ডুবে থাকলে লাউগাছ মরে যাবে।
সদরের মদনাডাংগা গ্রামের কৃষক কোরবান আলি জানান, দুই বিঘা জমির আউশধান কেটে মাঠে বিচালি শুকানোর জন্য জমিতে ফেলে রাখা হয়েছিল। পুরো জমির ধান পানিতে ভাসছে। ধানে চারা গজিয়ে পড়েছে। দুই বিঘা জমিতে অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ মন ধান ঘরে উঠতো।
গাংনীর গাড়াডোব গ্রামের কৃষক রহমতুল্লা বলেন, মেহেরপুর জেলায় আমাদের মত হাজারও কৃষক আছে। যারা শুধুমাত্র সবজি চাষ করে। কিন্তু মেহেরপুর জেলায় তেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় সবজির চাষ করে লাভবান হই। অথচ হঠাৎ এই দুর্যোগের কারনে সব সবজি পানির নিচে। আমার এক বিঘা জমির আগাম জাতের বাঁধাকপির জমিতে পানি জমে থাকায় মরে যাচ্ছে।
ভাটপাড়া গ্রামের মরিচ চাষি আব্দুল আলীম বলেন, ঝড়ো হাওয়ায় মরিচের গাছ পড়ে গেছে। বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে মরিচের গাছ।
ধানচাষি রহিদুল ইসলাম বলেন,আউশধান লাগিয়েছি দেড়বিঘা। ধান পেকে গেছে। দুএকদিনের মধ্যেই ধান কাটামাড়াই করে ঘরে তুলতাম। জমিতে গিয়ে দেখি শুধুই পানি। দুএকদিনের মধ্যেই ধানে চারা গজিয়ে যাবে। এধান ঘরে তুলতে না পারলে সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়বে।
এদিকে টানা বৃষ্টিতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে জনজীবন।
কখনো হালকা বৃষ্টি আবার কখনো ভারী বৃষ্টিপাতের কবলে পড়েছে মেহেরপুর জেলা। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। শ্রমজীবী এবং কর্মজীবী মানুষ ঘর থেকে বের হলেও যানবাহন না পেয়ে বিপাকে পড়ছেন। অন্যদিকে বৃষ্টির মধ্যে ছোট ছোট যানবাহন নিওয় বের হলেও যাত্রী পাচ্ছেন না এর চালকরা। এতে অলস সময় পার করছেন তারা।
এদিকে জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে মানুষ বের হলেও পাচ্ছেন না কাঙ্খিত সেবা। অব্যাহত বৃষ্টির কারণে রাস্তাঘাট হয়ে পড়েছে ফাঁকা। ব্যবসা-বাণিজ্য সহ সব কাজেই বিরূপ প্রভাব পড়েছে। কার্যত অচল অবস্থা বিরাজ করছে জনজীবনে।
বঙ্গোপসাগরের গভীর স্থল নিম্নচাপ এবং মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে মেহেরপুর জেলাসহ খুলনা বিভাগের সব জেলায় বৃষ্টিপাত ও ঝড় হচ্ছে বলে জানায় চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস। চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা রকিবুল ইসলাম জানান, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলে গতকাল সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১০৮ মিলিমিটার এবং বাতাসের গতিবেগ ছিল ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার।
মেহেরপুর কৃষিসমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ বিজয় কৃঞ হালদার বলেন, মেহেরপুর জেলা একটি কৃষি নির্ভয় জেলা। এজেলায় প্রাকৃৃতিক কোন দুর্যোগ নেই। জেলায় প্রচুর সবজি,ফল,ধান ও মরিচ হয়। গত শুক্রবার থেকে একটানা বর্ষণ ও ঝড়োহাওয়া বইছে। এতে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে উঠতি ফসলের ক্ষতি হয়েছে বেশি। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরপনে কৃষি বিভাগ কাজ করছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক ভাবে একবার ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট প্রেরণ করা হয়েছে। আবারও মাঠ পর্যায়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরপন করার কাজ অব্যাহত রয়েছে। তবে সবজির জমি থেকে দ্রত পানি নিষ্কাশন করা এবং পচনরোধক স্প্রে করতে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।