মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার দূর্গে হানা দিয়ে অনলাইন জুয়ার আরো চার এজেন্টকে আটক করেছে পুলিশ।
বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১ টার দিকে মুজিবনগর থানার ওসি মেহেদী রাসেল, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি সাইফুল আলম ও সাইবার অপরাধ বিভাগের এসআই মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে যৌথভাবে মহাজনপুর গ্রামের মাঠাপাড়া এলাকার খয়রুদ্দিনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে চার অনলাইন এজেন্টকে আটক করে।
আটকৃতরা হলেন, মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালি গ্রামের দক্ষিণপাড়া বাসিন্দা ও সাবেক চেয়ারম্যান মাহাবুবুর রহমানের ছেলে মাহফুজুর রহমান জয় (২৪), রশিকপুর গ্রামের খানপাড়ার রকিব শেখের ছেলে তরিকুল ইসলাম (২৬), মহাজনপুর গ্রামের মাঠপাড়ার মনিরুল ইসলামের ছেলে আক্তারুজ্জামান আক্তার (২২) ও মহাজনপুর খাঁ পাড়ার আবুল বাশারের ছেলে রুবেল হোসেন (২৩)।
এসময় তাদের অপর সহযোগী মহাজনপুর গ্রামের মিনারুল ইসলামের ছেলে শাহিন (৩০), খয়রুদ্দিনের ছেলে আরিফুল ইসলাম (২৫), জাকের আলীর ছেলে হেলাল (২৮), উজ্জল হোসেনের ছেলে মাহফুজ (২০) পালিয়ে যায়।
এ ঘটনায় মুজিবনগর থানায় এস আই উত্তম কুমার বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ৩০(২)/৩৫ ধারায় গতকাল বৃহস্পতিবার একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় তদন্তভার দেওয়া হয়েছে ডিবি ওসি সাইফুল আলমকে।
মামলার এজাহারে জানা গেছে, আসামি মাহফুজুর রহমান জয়ের কাছ থেকে একটি অপপো ব্রান্ডের মোবাইল ফোনসহ ০১৯১১৯০৮৪৭৪ ও ০১৫৮১-৩৮৬৯৭৪, আসামি আক্তারুজ্জামানের কাছে স্যামস্যাং গ্যালাক্সি কোম্পানীর মোবাইল ফোন এবং সিম নং ০১৮৪১০৬৫১৩০ এবং ০১৮৮৮০৮৯৬০৩, তরিকুল ইসলামের কাছে থেকে উদ্ধার করা হয়েছে রিয়েল মি জিটি মাষ্টার মডেলের একটি ফোন। মোবাইলে সিম রয়েছে ০১৯৪৫ ১৫৬৬৭৩ এবং ০১৬৫০-১১৫১৮৮, রুবেল হোসেনের কাছ থেকে রেডমি নাইন মডেলের মোবাইল ফোন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ০১৯৭৩৯৫৮০৩০ এবং ০১৩০৫-৪২৪৫৭৩। এছাড়া একটি বিকাশ এজেন্ট সিম যার নং ০১৭৫৩৫৮৮২৪১, ও একটি রকেট এজেন্ট সিম যার নং ০১৭৭৯৩৪৯৭৩৬, দুটি গ্রামীণ ফোন কোম্পানীর সিম দুটি সাদা কাগজে মোড়ানো। রকেট ১৩৫৭ ও বিকাশ ২২২৩৪ লেখা আছে। সিম দুটির আসামি তরিকুল ইসলামের নিকট থেকে জব্দ করা হয়েছে।
এছাড়া ৫০ হাজার নগদ টাকাও জব্দ করা হয়েছে।পলাতক আসামি শাহীনের ফেলে যাওয়া ইনফিনিক্্র হট ১২ মডেলের ফোন থেকে ০১৬১২৬৯৪৫৭৩ ও ০১৮১৬৯৫৬৩৪২ সিম জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া সিম বাদেই একটি ভিভো ওয়াই৭৬ ফাইভজি মডেলের মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। পলাতক আসামি আরিফুল ইসলামের ফেলে যাওয়া রিয়েলমি ৮ মডেলের মোবাইল ফোন থেকে ০১৩১৬৯১৮৮৮৯ সিম পাওয়া গেছে। রবি কোম্পানীর এসএমই ৪.৫জি নতুন ১০ টি সিম, কার্ডযার প্রতিটি প্যাকেটের স্টীকারে আলাদা আলাদা নম্বর লেখা রয়েছে। সিম কার্ডগুলো পলাতক শাহীনের বলে জানা গেছে।
মামলার এজাহারে বাদী বলেন, বিভিন্ন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, এক শ্রেনীর অসাধু লোক রাশিয়ান অনলাইন জুয়া সাইট ওয়ানএক্সবেট, লাইনবেট, মেলবেট, বেট উইনিয়ার. এবং ওয়ালমেট এর সাব এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। এসব সাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ব্যাতিরেকে অবৈধ ই-ট্রানজেকশন, মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়য়ে কতিপয় সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ এর যোগসাজসে এ কার্যক্রম সম্পন্ন করছে।
এসব অনলাইন জুয়া সাইটের সাব এজেন্টের ভূঁয়া তথ্য দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বিকাশ, নগদ, রকেট উপায় এর রিপ্রেজেন্টেটিভ এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীক এজেন্ট এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীক সিম নিবন্ধন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই ই-ট্রানজেকশন করছে।
আটক মাহফুজুর রহমান জয়কে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, সে ওয়ানএক্্রবেটের সাব এজেন্ট। তার নিজের চ্যানেলের নাম প্রামানিক নগদ (সাব এজেন্ট-১৪৪৮৪) সে নগদ এজেন্ট নাম্বার ০১৯৭৫১০০০৯০ জুয়ার ওয়ালে ব্যবহার করে তার নিজের ওয়ানএক্সবেট এর সাব এজেন্ট পরিচালনা করেন।
সে আরো জানায়, তার ফোনে রেড্ডি নামক মোবাইল এপলিকেশন অনলাইন জুয়া ওয়ান এক্সবেট অর্থ পরিচালনাকারী ওয়েবসাইট ম্যানেজমেন্ট. আইও আছে। তার চ্যানেলের এ্যাকাউন্টে বর্তমানে ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৭৮৩ টাকা রয়েছে। এছাড়া তার সহযোগী মোনাখালি গ্রামের বদর কামড়ির ছেলে আব্দুস ছামাদ জুয়ার অন্যান্য জুয়ার সাইট পরিচালনা করেন।
অপর আসামি আক্তারুজ্জামানকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে এবং পলাতক আসামি শাহীন ও আরিফুল ইসলাম এক সাথে চ্যানেল বিক্রয়সহ সাব এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। এছাড়া অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে এজেন্ট নাম্বার ব্যবহার করে অবৈধ ই ট্রানজেকশন করে। অনলাইন জুয়া ওয়ানএক্সবেট, লাইনবেট, মেলবেট, বেট উইনার এবং ওয়ালমেট এর ১৮-২০ জন সাব এজেন্ট হিসেবে তাদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন।
গ্রেফতারকৃত তরিকুল ইসলাম প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, সে নিজে পলাতক আসামি শাহীন আব্দুস ছামাদ, আরিফুল এবং গ্রেফতারকৃত আক্তারুজ্জামানের নিকট থেকে ওয়ানএক্্রবিটের একটি সাব এজেন্ট চ্যানেল নিয়ে দুটি এজেন্ট সিম কার্ড ০১৭৫৩-৫৮৮২৪১ (বিকাশ এজেন্ট) এবং ০১৭৭৯-৩৪৯৭৩৬ (রকেট এজেন্ট) ভাড়া নেওয়ার জন্য আসে। এক মাসের জন্য ওই এজেন্ট সিম দুটির ৫০ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়ার জন্য আসেন।
গ্রেফতারকৃত রুবেল হোসেন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, পলাতক আসামি আরিফুল, হেলাল, মাহফুজের কর্মী হিসেবে ওয়ানএক্সবেট, বেট উইনার এবং ওয়ালমেট এর ডিপোজিট এবং উইথড্রল এর কাজ করে। পলাতক আসামি শাহীন এর ফেলে যাওয়া মোবাইল ফোন যা গ্রেফতারকৃত আসামিদের কর্তৃক সনাক্ত করা হয়েছে।
ওই ফোনটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অনলাইন জুয়া বেট উইনার এর এ্যাডমিন হিসেবে রহমান নগদ, রহমান রকেট, রহমান বিকাশ, রহমান উপায়সহ ৪টি চ্যানেল পরিচালনা করেন। অনলাইন জুয়া বেট উইনার এর অবৈধ জুয়ার টাকা জুয়ার চ্যানেলে রহমান নগদ এজেন্ট নাম্বার ০১৮৪০৬৬৫২৬৪, রহমান রকেট এজেন্ট নাম্বর ০১৮৬৫ ৭৩৪৭৭০, রহমান বিকাশ এজেন্ট নং ০১৩১৯৭৬৬৯৯১, রহমান উপায় এজেন্ট নং ০১৮৬৯ ৫২৫৩৫৪ ব্যবহার করে বেট উইনার এর ওয়েবসাইটের ওয়ালে প্রদর্শনের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার টাকা ই-ট্রানজেকশন করে।
গ্রেফতারকৃত মাহফুজুর রহমান জয়, আক্তারুজ্জামান তারিকুল ইসলাম ও রুবেল হোসেন পলাতক আসামিসহ অজ্ঞাতনামা অন্যান্য আসামি অবৈধ ই ট্রানজেকশনের জন্য ভূঁয়া ট্রেড লাইসেন্স এর মাধ্যমে অসৎ উদ্দ্যেশ্যে অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিং রকেট, নগদ, বিকাশ ও উপায় এজেন্ট সিমকার্ড তুলে অনলাইন জুয়া খেলা পরিচালনা করে আসছে।
মেহেরপুর ডিবির ওসি সাইফুল আলম বলেন, অনলাইন জুয়ার অন্যান্য এজেন্টদের আইনের আওতায় আনার অভিযান অব্যহত রয়েছে। অবৈধ ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে তারা রাশিয়ায় কোটি কোটি টাকা পাচার করছে। পুলিশ সুপার স্যারের নির্দেশে আমরা এ দূর্গ নিশ্চিহৃ করতে মাঠে কাজ করছি।
এদিকে, পুলিশের পাশাপাশি মেহেরপুর প্রতিদিন অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িতদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করছে। মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধানেও দুই শতাধিক অনলাইন জুয়ার নাম পরিচয় উঠে আসছে। ইতোমধ্যে মেহেরপুর প্রতিদিনে এনিয়ে ‘অনলাইন জুয়ার দূর্গ’ ক্যাটাগরি ভিত্তিক ধারাবাহিক ৯টি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত এজেন্টরা রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। বিপরীত দিকে অনলাইন জুয়া খেলে নি:স্ব হচ্ছেন হাজার হাজার তরুণ। আর এসকল টাকা অবৈধভাবে ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে রাশিয়ায় পাচার করছেন এসকল অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত এজেন্টরা।
এসব এজেন্টদের মধ্যে রয়েছেন জনপ্রতিনিধি, ছাত্র নেতা, শিক্ষক, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভসহ উঠতি বয়সের তরুণরা।
মেহেরপুর প্রতিদিন এসকল অনলাইন জুয়ার এজেন্টদের মুখোশ উন্মোচন করতে কাজ করছে। ধারাবাহিকভাবে তাদের সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। বাকিদেরও সংবাদ প্রকাশের জন্য অনুসন্ধান অব্যহত রয়েছে। (চলবে…)
অনলাইন জুয়ার সংবাদগুলো পড়ুন
ধরাছোঁয়ার বাইরে অনলাইন জুয়ার অন্যতম চার হোতা মুকুল-জামান-নুরুল-মাদার
অনলাইন জুয়ার হোতা নুরুল ও জামানকে শোকজ
মেহেরপুরের অনলাইন জুয়ার শীর্ষ এজেন্ট শামিম অধরা
মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার দূর্গে হানা
মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার মাস্টারমাইণ্ড প্রসেনজিৎ সহযোগীসহ আটক
অনলাইন জুয়ার এজেন্ট শামিমকে নিম্ম আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ
মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার আরেক এজেন্ট সাদ্দাম আটক
অনলাইন জুয়ার এজেন্ট প্রসেনজিতের সহযোগীদের আদালতে জবাবনবন্দী প্রদান
অনলাইন জুয়ার খপ্পরে মেহেরপুরের অর্ধশত তরুণ