মেহেরপুর জেলা থেকে দুই শতাধিক এজেন্ট অনলাইন জুয়া সাইটের মাধ্যমে রাশিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছেন শত শত কোটি টাকা। আর এই অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত মেহেরপুরের সরকার দলীয় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, মুজিবনগরের একজন প্রভাবশালী নেতা, সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন শীর্ষ নেতা, প্রশাসনের দু একজন কর্মকর্তা, স্কুল ও কলেজের কয়েকজন শিক্ষক, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেলস প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেনীর প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি।
মেহেরপুর প্রতিদিনের এ পর্বের অনুসন্ধানে থাকছে আরো এক মাস্টার এজেন্ট পলাশের আদ্যপান্ত।
নিয়োগ দালালি করে বহু মানুষের কাছে থেকে নেওয়া অর্ধকোটি টাকা ঋণগ্রস্থ হয়ে পালিয়ে বেড়ানো ধান্দাবাজ নামে পরিচিত পলাশ এখন নিজেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। শোধ করেছেন বিভিন্ন জনের পাওনা টাকাও। দুটি ইটভাটায় অর্ধকোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করে পার্টনার হয়েছেন। মেহেরপুর শহরের কোর্ট সড়কে কোটি টাকা বিনিয়োগ করে থাই ও গ্লাসের দোকান দিয়েছেন। এলাকাতে কিছু জমিও কিনেছেন। আর এসব কিছুই হয়েছে অবৈধ অনলাইন জুয়ার বদৌলতে।
পলাশ মেহেরপুর সদর উপজেলার টুঙ্গী গ্রামের শরিফুল ইসলামের ছেলে। ২০২০ সালের করোনা মহামারির সময়ে যখন অনলাইন জুয়া ছড়িয়ে পড়ে পলাশও তখন অনলাইন জুয়ায় নিজেকে জড়ান। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে গড়ে তোলেন নিজের একটি বলয়। নিজের স্বার্থে এমন কোন কাজ নেই যা পলাশ করতে পারেন না। সাংবাদিক ও পুলিশ ম্যানেজের নামে অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত নিকট থেকে চাঁদা তুলে তা আত্মসাৎ করাতেও পটু এই পলাশ। এছাড়া অনলাইন জুয়ার চ্যানেল বিক্রির নামেও বিভিন্ন জনের কাছে থেকে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। পলাশ মেহেরপুর পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা বিভাগের দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার আসামিও। মামলার আসামি হলেও এলাকায় সে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়।
মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধান ও তার স্বীকারোক্তিতে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরির জন্য এলাকায় ছেলেদের নিয়োগ দেওয়ার নাম করে বহু মানুষের সাথে টাকা নেন পলাশ। চাকরি দেওয়া তো দুরের কথা টাকাও ফেরত দিতে পারেন না। পরবর্তিতে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট পেয়ে দ্রুত তার দিন বদলাতে থাকে। বনে যান অনলাইন জুয়ার ওয়ান এক্স বেটের অন্যতম মাস্টার এজেন্ট। তার এজেন্ট চ্যানেল চালানোর জন্য নিয়োগ দেন সাদ্দাম, আসিফ, আশিক, ইজারুলের ছেলে সুমন ও কটার ছেলে সবুজসহ বেশ কয়েকজন যুবককে। প্রত্যেককে মোটা অংকের বেতন দিয়ে থাকেন এসকল কার্যক্রম পরিচালনা করা জন্য।
সাংবাদিকদের ম্যানেজ করার জন্য ওয়ান এক্স বেটের কান্ট্রি ডিরেক্টর যার ছদ্ম নাম টম। তার নির্দেশে পলাশকে সাড়ে ৮ লাখ টাকা দেওয়া হয় সাংবাদিকদের ম্যানেজ করতে। সেখান থেকে পলাশ এক সাংবাদিককে ৭লাখ দিয়ে বাকিটা আত্মসাতের জন্য নিজে রেখেছিলেন। পরে টমের নির্দেশে জামিনের জন্য মাহফুজুর রহমান নবাবের বাবাকে দিয়েছিলেন এক লাখ টাকা। বাকি ৫০ হাজার সে আত্মসাৎ করেছে। এছাড়াও সে পুলিশকে ম্যানেজ করার জন্য ঢাকার কোন এক ঢাকার কোন অভিযাত ব্যবসায়ীকেও ১০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। আরো এক মাস্টার এজেন্ট গাড়াডোব গ্রামের আনোয়ার হোসাইনের কাছে থেকেও পলাশ পুলিশ ও সাংবাদিকদের ম্যানেজ করার কথা বলে ৩ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে।
মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধানি টিম সম্প্রতি টুঙ্গীতে পলাশের খোঁজ খবর নিতে গিয়ে পলাশের বাড়ির পাশের একটি মাঁচাতে স্থানীয়দের সাথে গল্প মাতে টিমটি। এসময় আকষ্মিকভাবে পলাশ সেখানে হাজির হয়ে নিরালায় কথা বলার প্রস্তাব দেয় আমাদের অনুসন্ধানি টিমকে। গ্রামের একটি চায়ের দোকানের পাশে দাড়িয়ে কথা হয় পলাশের সাথে।
এসময় পলাশকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথমে সব কিছু অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করে বলেন, নিয়োগ বাণিজ্য করার সময় প্রায় অর্ধকোটি টাকা ঋণগ্রস্থ হয়ে যায়। পরে ওয়ান এক্স বেটের একটি চ্যানেল নিয়ে প্রায় কোটি খানেক টাকা আয় করেছি। সব দেনার টাকা শোধ করেছি। দুটি ইটভাটাতে বিনিয়োগ করলেও তিনি একটি ইটভাটায় ১৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন বলে স্বীকার করেন। শহরের কোর্ট সড়কে প্রায় কোটি টাকা বিনিয়োগ করে নাবিলা এন্টারপ্রাইজ নামে গ্লাস ও থাইয়ের দোকান দিলেও তিনি স্বীকার করেছেন সেখানে ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এছাড়া তার হাতে নগৎ কিছু অর্থ আছে।
তার সাথে যখন মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধানি টিম কথা বলছিলেন তখন এলাকার বেশকিছু তরুণ ছেলে সেখানে জড়ো হয়। পরে জানা যায় তারা সকলেই পলাশের লোকজন।
পরে বিভিন্নভাবে পলাশের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অনলাইন জুয়ার মাস্টার এজেন্ট কোমরপুরের মাদার আলী ও স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা মিলে অনলাইন জুয়ার এজেন্টদের কাছে থেকে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা উঠিয়েছিলেন শুধুমাত্র পুলিশকে ম্যানেজ করার জন্য যাতে পুলিশ তাদের গ্রেফতার না করে।
জানা গেছে, তারা পুলিশকে পুলিশ ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হয়। ফলশ্রুতিতে পুলিশ ‘অনলাইন জুয়ার দূর্গ’ ভাঙতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে এবং প্রায় ডজন খানেক এজেন্টকে গ্রেফতার করেছে। পলাশও এজেন্ট হিসেবে ওই চাঁদার ভাগ হিসেবে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তবে ওই টাকা কে আত্মসাৎ করেছে তারা কেউ জানে না।
আরো জানা গেছে, তারপরপরই মেহেরপুর শহরের এক সাংবাদিকের চাপে পড়ে তার বাড়িতে প্রথম দফায় ৬লাখ ৮০ হাজার এবং পরে আরো ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন যাতে কোন সাংবাদিক নিউজ না করে। টাকা দেওয়ার সময় ওই সাংবাদিকের বাড়িতে পলাশও গিয়েছিলেন। তবে ওই সাংবাদিকের দাবি ছিলো ২০ লাখ টাকা। টাকা কম হওয়াতে প্রথমে ওই সাংবাদিক ক্ষোভ প্রকাশ করে টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে তা গ্রহণ করেন বলে জানা গেছে।
মেহেরপুর ডিবি পুলিশের ওসি সাইফুল আলম এর আগে মেহেরপুর প্রতিদিনকে জানিয়েছিলেন, পুলিশ সুপারের নির্দেশে মেহেরপুরে অবৈধ ই ট্রানজেকশনের মাধমে বিদেশে টাকা পাঠানোর অনলাইন জুয়ার এজেন্টদের গ্রেফতারে অভিযান চলবে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট হয়ে রাতারাতিই কোটিপতি বনে গেছেন অনেকে। জুয়াড়িরা বিভিন্ন অ্যাপস ও সাইট ব্যবহার করে অনলাইনে বিভিন্ন গেমিং বেটিং বা বাজি খেলার সাইটে জুয়ায় মেতে উঠেছে।
বিট কয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার (ক্রিপ্টোকারেনসি) মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলা হয়। অবৈধ পন্থায় ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচার লেনদেনে দুই বছরে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে অনুমান করছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই টাকা পাচার হয়েছে বলে জানান সংস্থ্যাগুলো।
রাশিয়া থেকে পরিচালিত এসব অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপস তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত। এসব জুয়ার সাইট ও অ্যাপস ভার্চুয়ালি জুয়া খেলায় একেকটি এজেন্টের মাধ্যমে মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টেগেশন সেল অনলাইন জুয়া চক্রের ডজন খানেক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। ইতোমধ্যে জেলার অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত জুয়াড়িদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছেন তারা। অনলাইন জুয়া বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও তারা কাজ শুরু করেছেন।
জানা গেছে, অনলাইনে জুয়া খেলা পরিচালনার জন্য (ওয়ানএক্সবিট, মেল বেট, লাইন বেট, বেট উইনারসহ ২৩০ টি সাইটের মাধ্যমে এই জুয়া খেলা পরিচালিত হচ্ছে।
সুত্রটি জানান, মেহেরপুর জেলার অনলাইন জুয়ার এই চক্রটির মাধ্যমে প্রতিমাসে ৩৮০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। সে হিসেবে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। যেটি অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে যাচ্ছে বিদেশে। মেহেরপুরে জেলা শহরসহ মুজিবনগর এলাকার তরুণদের বড় অংশই এখন জুয়ার সাইট পরিচালনায় যুক্ত।
একজন জুয়াড়ি মোবাইল নম্বর, ইমেইলের মাধ্যমে এই বেটিং সাইট ওপেন করেন। অ্যাকাউন্টের বিপরীতে একটি ই-ওয়ালেট তৈরি হয় যাকে জুয়াড়িরা ইউএসডিটি বলে। শুরুতে এর ব্যালান্স শূন্য থাকে। ওয়ালেটে ব্যালান্স যোগ করার জন্য অনেক মাধ্যম রয়েছে। এর মধ্যে বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায় এবং ট্রাস্ট এজিয়াটা অন্যতম।
এগুলোর যেকোনো একটি বেছে নিলে সেখানে একটি এজেন্ট নাম্বার দেখায় যেখানে ন্যূনতম ৫০০ টাকা দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে ই-ওয়ালেট বা ইউএসডিটি ব্যালান্স যুক্ত হয়ে যায়। এ টাকা অথবা ব্যালান্স দিয়ে তিনি পরবর্তীতে জুয়া খেলতে পারেন। প্রতিটি এজেন্ট আগে ৬শতাংশ কমিশন পেতেন। এখন চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাওয়ায় এজেন্ট ধরে রাখতে তারা ৯ শতাংশ কমিশন পায়।
অনলাইন জুয়া নিয়ে মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধান অব্যহত রয়েছে। অনুসন্ধানে অনলাইন জুয়ার নানা চমকপ্রদ তথ্য মেহেরপুর প্রতিদিনে আসছে। ধারাবাহিকভাবে তা পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। (চলবে…)
অনলাইন জুয়ার সব খবর
মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার দূর্গে হানা
অনলাইন জুয়ার খপ্পরে মেহেরপুরের অর্ধশত তরুণ
মেহেরপুরের অনলাইন জুয়ার শীর্ষ এজেন্ট শামিম অধরা
মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার আরো চার হোতা আটক
ধরাছোঁয়ার বাইরে অনলাইন জুয়ার অন্যতম চার হোতা মুকুল-জামান-নুরুল-মাদার
মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার মাস্টারমাইণ্ড প্রসেনজিৎ সহযোগীসহ আটক
অনলাইন জুয়ার এজেন্ট প্রসেনজিতের সহযোগীদের আদালতে জবাবনবন্দী প্রদান
মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার আরেক এজেন্ট সাদ্দাম আটক
অনলাইন জুয়ার হোতা নুরুল ও জামানকে শোকজ
অনলাইন জুয়ার এজেন্ট শামিমকে নিম্ম আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ