গা ঢাকা দিয়েছে এজেন্টরা, কৌশলে অন্যত্র থেকে চালানো হচ্ছে লেনদেন, সর্বস্ব হারাচ্ছেন জুয়া খেলোয়াড়রা
মেহেরপুর জেলা থেকে দুই শতাধিক এজেন্ট অনলাইন জুয়া সাইটের মাধ্যমে রাশিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছেন প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। আর এই অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত মেহেরপুরের সরকার দলীয় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, মুজিবনগরের একজন প্রভাবশালী ইউপি চেয়ারম্যান, সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন শীর্ষ নেতা, প্রশাসনের দু একজন কর্মকর্তা, স্কুল ও কলেজের কয়েকজন শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেনীর প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি।
কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা, কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং কয়েকজন সাংবাদিক নিয়মিত মাসোহারা নেন অনলাইন জুয়াড় সাথে জড়িত এজেন্টদের সাথে। তাদের মাসোহারা দিয়ে দেদারছে জুয়া খেলে কোটি বনে যাচ্ছেন এসব এজেন্টরা। আর পথে বসছেন হাজার হাজার তরুণসহ জুয়া খেলার জড়িত ব্যক্তিরা। মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধানীতে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সামাজিক মর্যাদার কারণে ক্ষতিগ্রস্থদের নাম পরিচয় দেওয়া হলো না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সঠিক নজরদারি না থাকায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতিদিনই কোটি টাকা পাচার হচ্ছে দেশের বাহিরে। এতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি বিপথে যাচ্ছেন তরুণ ও যুবকরা। গত এক মাসে শুধুমাত্র একটি সিম (এজেন্ট) থেকে লেনদেন হয়েছে এক কোটি ৪৩ লাখ টাকা। সম্প্রতি জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টেগেশন সেল যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে ইতোমধ্যে মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের বাদল হালদারের ছেলে নিমাই হালদার ও গোপালপুর দক্ষিণপাড়া এলাকার খলিলুর রহমানের ছেলে বদরুদ্দোজা ওরফে রয়েল (৩৬) ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তাদের কাছ থেকে এমন তথ্য জানতে পারে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টেগেশন সেল।
মেহেরপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে অনলাইন জুয়া নিয়ে অনুসন্ধান এবং কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে অনলাইন জুয়া নিয়ে উঠে এসেছে নানা তথ্য। সম্প্রতি সাইবার ক্রাইম বিভাগ একটি মামলা করেছেন।
মামলার এজাহারে জানা গেছে, বদরুদ্দোজা ওরফে রয়েলকে জিজ্ঞাসাবাদে সাইবার ক্রাইমকে জানিয়েছে, মেহেরপুর জেলাসহ বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার (ওয়ানএক্সবেট) এর মাষ্টার এজেন্ট কোমরপুর গ্রামের কোমরপুর গ্রামের সোনা গাইনের ছেলে মাহফুজুর রহমান ওরফে নবাব। এছাড়া এই সাইটের নবাবের নেতৃত্বে রয়েছে অনলাইন জুয়ার সাথে রয়েছে আরো ১৫ জন সাব এজেন্ট। যাদের নামে মামলাও হয়েছে। তারা হলেন, গোপালপুর গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে শিশির বিশ্বাস, বিল্লাল গড়াইয়ের ছেলে দিপু, কোমরপুর গ্রামের বিলু সর্দারের ছেলে শামীম, একই গ্রামের আনারুল মিয়ার ছেলে রুবেল, টঙ্গীর শরিফের ছেলে পলাশ, মুজিবনগরের শিবপুরের মৃত শাহাজুলের ছেলে বিজয়, একই গ্রামের জিনারুলের ছেলে লিপু গাজী, মোনাখালী গ্রামের আজহারুলের ছেলে মিলন, সাইদুর রহমান খোকনের ছেলে সাগর, কোমরপুর গ্রামের বাশার বিশ্বাসের ছেলে সজীব, ভাটপাড়া গ্রামের মৃত সিরাজ মণ্ডলের ছেলে বাবু, মেহেরপুর শহরের স্টেডিয়াম পাড়ার বখতিয়ার মাস্টারের ছেলে রুবেল, গাংনীর গাড়াডোব গ্রামের মৃত কিয়াম উদ্দিনের ছেলে আনোয়ার।
মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ও সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল একের পর এক অনলাইন জুঁয়ার দূর্গে হানা দেওয়া শুরু করেছেন।
মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে ইতোমধ্যে দুই জুয়াড়িকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করেছেন। বাকিদের আটক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এদিকে ডিবির অভিযানে ওই দুই জুয়াড়ি গ্রেফতারের পর বাকিরা এলাকা থেকে গাঁ ঢাকা দিয়েছে বলে জানান ডিবি পুলিশের একটি সুত্র।
গোয়েন্দা সংসস্থার মতে, মেহেরপুর জেলাতে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছেনা অনলাইন জুয়ার। রাতারাতিই কোটিপতি বনে যাচ্ছেন অনেকে। জুয়াড়িরা বিভিন্ন অ্যাপস ও সাইট ব্যবহার করে অনলাইনে বিভিন্ন গেমিং বেটিং বা বাজি খেলার সাইটে জুয়ায় মেতে উঠেছে।
বিট কয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার (ক্রিপ্টোকারেনসি) মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলা হয়। অবৈধ পন্থায় ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচার লেনদেনে দুই বছরে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে অনুমান করছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই টাকা পাচার হয়েছে বলে জানান সংস্থ্যাগুলো।
রাশিয়া থেকে পরিচালিত এসব অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপস তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত। এসব জুয়ার সাইট ও অ্যাপস ভার্চুয়ালি জুয়া খেলায় একেকটি এজেন্টের মাধ্যমে মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টেগেশন সেল অনলাইন জুয়া চক্রের দুই সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। ইতোমধ্যে জেলার অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত জুয়াড়িদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছেন। অনলাইন জুয়া বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও তারা কাজ শুরু করেছেন।
জানা গেছে, অনলাইনে জুয়া খেলা পরিচালনার জন্য (ওয়ানএক্সবিট, বেট ৩৬৫ ডটকম, প্লেবেট ৩৬৫ ডটকম, বিডিটি ১০ ডটকম, উইনস ৬৫ ডটকম ও বেটস্কোর২৪ ডটকমসহ ২৩০ টি সাইটের মাধ্যমে এই জুয়া খেলা পরিচালিত হচ্ছে।
সুত্রটি জানান, মেহেরপুর জেলার অনলাইন জুয়ার এই চক্রটির মাধ্যমে প্রতিমাসে ৩৮০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। সে হিসেবে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। যেটি অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে যাচ্ছে বিদেশে।
জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, রয়েল নামের ওই অনলাইন জুয়াড়িকে গ্রেফতারের পর দায়ের করা হয় মামলা। মামলাটি তদন্তের একপর্যায়ে এই চক্রের সদস্যদের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য, তাদের ২৩০টি জুয়ার সাইটের মালিক ও তাদের এজেন্ট সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া গেছে।
মেহেরপুরে জেলা শহরসহ মুজিবনগর এলাকার তরুণদের বড় অংশই এখন জুয়ার সাইট পরিচালনায় যুক্ত।
তিনি আরো জানান, একজন জুয়াড়ি মোবাইল নম্বর, ইমেইলের মাধ্যমে এই বেটিং সাইট ওপেন করেন। অ্যাকাউন্টের বিপরীতে একটি ই-ওয়ালেট তৈরি হয় যাকে জুয়াড়িরা ইউএসডিটি বলে। শুরুতে এর ব্যালান্স শূন্য থাকে। ওয়ালেটে ব্যালান্স যোগ করার জন্য অনেক মাধ্যম রয়েছে। এর মধ্যে বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায় এবং ট্রাস্ট এজিয়াটা অন্যতম। এগুলোর যেকোনো একটি বেছে নিলে সেখানে একটি এজেন্ট নাম্বার দেখায় যেখানে ন্যূনতম ৫০০ টাকা দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে ই-ওয়ালেট বা ইউএসডিটি ব্যালান্স যুক্ত হয়ে যায়। এ টাকা অথবা ব্যালান্স দিয়ে তিনি পরবর্তীতে জুয়া খেলতে পারেন। প্রতিটি এজেন্ট আগে ৬শতাংশ কমিশন পেতেন। এখন চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাওয়ায় এজেন্ট ধরে রাখতে তারা ৯ শতাংশ কমিশন পায়।
মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত দুই এজেন্টকে আটক করা হয়েছে। জড়িতদের আটকে অভিযান চলছে। অভিযানের পর থেকে এজেন্টরা গা ঢাকা দিয়েছেন।
এছাড়া মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধানেও উঠে এসেছে মেহেরপুর শহর, মুজিবনগরের কোমরপুর, গাংনী শহর, তেরাইল, সদরের সাহেবপুর, ইসলামপুরসহ বেশ কয়েকিট এলাকার দুই ডজন অনলাইন এজেন্টের তথ্য। পরবর্তি পর্বে থাকবে সে অনুসন্ধানের বিস্তারিত।