পৌর এলাকার ৯টি ডিলারের বিক্রয় কেন্দ্র চত্বরে রাত ১০টা থেকে পরের দিনের ওএমএসের চাল আটা নিতে দুস্থ পরিবারের নারী পুরুষ লাইনে দাঁড়ায়। মেহেরপুর পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডের ওএমএস ডিলার নীলমনি হল সড়কের আক্তারুজ্জামান সুমন। রোববার রাত ৩টায় সুমনের বিক্রয় কেন্দ্রের সামনে রোববার রাত ৩টায় অর্ধশত নারীকে শীতে জবু থবু হয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করতে দেখা যায়। তাদের অবস্থানের দৃশ্যধারণ করলে দু‘জন মহিলা তেড়ে আসে ছবি তোলার প্রতিবাদ জানিয়ে।
এসময় আমার পক্ষ নিয়ে ওই মহিলাদের রুখে দিয়ে এক যুবতী বলেন- ‘মশার কামড় খেয়ে শীতে সারারাত বসে থাকছি লাইনের চাল কিনতে। তাতে আমাদের মান সম্মান যাচ্ছেনা। সাংবাদিকদের কাজ সাংবাদিকরা করুক। সাংবাদিকরাতো জেগে থাকে আমাদের জন্যই’। সাথে সাথে থেমে গেল দৃশ্য ধারণের প্রতিবাদ। মনে মনে কুর্ণিশ জানালাম ওই সাহসি যুবতীকে।
ওএমএসের চাল-আটা পেতে ভোক্তারা মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গি আক্রান্ত হবার আশংকা উপেক্ষা করে সারারাত ডিলারের পয়েন্টে অবস্থান করেও চাল আটা পাচ্ছেনা। খালি হাতেই ফিরে যাচ্ছেন অনেক নারী পুরুষ। অনেকে সারারাত খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করায় ঠান্ডজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। রেশনিং কার্ড পদ্ধতিতে জেলার প্রতিটি মানুষের জন্য ক, খ ও গ শেণিতে কার্ডের মাধ্যমে ওএমএস চাল আটা দেবার বাদি সব শ্রেণির মানুষের।
দ্রব্যমূল্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের মানুষেরা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মিলছে না কিছুতেই। মানুষের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয় সেজন্য সরকার খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওএমএসের বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে সুলভ মূল্যে চাল ও আটা বিক্রি করছে। সপ্তাহের রোববার থেকে বৃহস্পতিবার এই পাঁচদিন ওএমএস ডিলার পয়েন্টে সুলভ মূল্যে চাল আটা বিক্রি করা হয়। তবে তা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল বলছেন ভোক্তাসহ সব শ্রেণির মানুষ। খোলা বাজারে মোটা চালের কেজি ৬০ টাকা। সে চাল খাদ্য অধিদপ্তরের ওএমএসের (ওপেন মার্কেট সেল) মাধ্যমে ৩০ টাকায় কেনা যায় বলে লাইন দির্ঘ হচ্ছে। অন্যদিকে বাজারে আটার কেজি ৭৫ টাকা। লাইনে ১৮ টাকা কেজি পাওয়া যায়। তাও দুদিন আগে কেজিতে ৬ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এখন লাইনে কিনতে হচ্ছে ২৪ টাকা কেজি দামে। তাও প্রতি ডিলার চাহিদার চাল আটা দিতে পারছেনা।
ওএমএসর ডিলারদের বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে সরেজমিন রোববার সারারাত ঘুরে দেখা গেছে রাত ৯টা থেকে মানুষ অবস্থান নিচ্ছে চাল আটা পাবার জন্য। যদিও পরের দিন সকাল ৯টায় চাল-আটা দেওয়া শুরুর সময়। রাত ৯টায় মেহেরপুর জেলা শহরের চার নম্বর ওয়ার্ডের ডিলার ফারুক হোসেনের বিক্রয় কেন্দ্রের নিকট দেখা যায় খোলা আকাশের নিচে একটি গাছের গোড়ায় সিমেন্টের খালি বস্তা পেড়ে খন্ড খন্ড হয়ে শুয়ে বসে আছে অনেক নারী। রেহেনা খাতুন নামে মধ্য বয়সী এক মহিলা জানান- সারারাত তারা ৩ কেজি আটা অথবা ৫ কেজি চালের জন্য অপেক্ষা করবেন। সকাল ৯টায় তাদের চাল আটা দেয়া হবে। রাত ১২টার মধ্যে শতাধিক নারী চলে আসবে এই চাল আটা নিতে। যারা সকালে আসবেন তারা নিশ্চিত নন চাল আটা পাবার বিষয়ে।।
মধ্যরাতে এসে লাইনে জায়গা না পেয়ে অনেকেই খালি হাতেই বাড়ি ফিরছেন। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ডিলারের বিক্রয় কেন্দ্রে রাত ৩টায় আসেন মাসুরা খাতুন নামের শহরের মাঠ পাড়ার এক মহিলা। লম্বা লাইন দেখে ক্ষোভ ঝাড়তে ঝাড়তে তাকে বাড়ি ফিরে যেতে দেখা গেল। ভিড় দেখেও অনেকে থেকে যাচ্ছে যদি অবস্থান করে চাল আটা মেলে আশায়। কিন্তু মিলছেনা।
শহরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ডিলার শামীম জাহাঙ্গীর সেন্টুর বিক্রয় কেন্দ্রে সোমবার সকাল ৮টায় গিয়ে দেখা যায়- ওএমএসের চাল ও আটা কিনতে মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মতো। সকলের চোখে মুখে সারারাত জাগার ক্লান্তির ছাপ। তাদের কেউ কেউ রোববার দিবাগত রাত ৯টা থেকে লাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেখান থেকে চাল ও আটা কেনা রুপালী বেগম জানান- তিনি বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তাকে রাত ৯টায় লাইনে পাঠানো হয় ওই বাসাবাড়ি থেকে। যখন তিনি আসেন তখন তার সামনে জনা কুড়ি নারী পুরুষ ছিলো। তিনি বলেন- সারারাত ঘুমহীন লাইনে থেকে বাসাবাড়িতে কাজ করতে কষ্ট হয়। তিনি আরও জানান- বাজার থেকে ৫ কেজি চাল আর ৫ কেজি আটা কিনতে যে টাকা লাগে তার থেকে ওএমএস কেনায় সাশ্রয় হয় অর্ধেক। তিনি যে বাসাবাড়িতে থাকেন তিনি মধ্যম আয়ের সম্ভ্রান্ত মানুষ বলে জানান।
বাজারে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষ একটু কম দামে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি থেকে চাল ও আটা কিনছিলেন। সাধারণ মানুষের কম দামে আটা কেনার সেই সুযোগও এখন সংকুচিত হয়ে আসছে। কারণ, ওএমএসের আটার দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
লাইনে থেকেও চাল না পাওয়া এক রিকশাচালক জানান, শুধু শহরের নয়, গ্রাম থেকেও এখানে ওএমএসের চাল-আটা নিতে আসছে মানুষ। বিশেষ করে গত এক মাস থেকে নতুন নতুন মুখ আসছে। এখন গ্রাম পর্যায়েও খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি করা দরকার।
সরকারের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন- শুধু নিম্ন আয়ের নয় মধ্যম ও উচ্চ মধ্যম শ্রেনির মানুষেরও ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। এজন্য ক, খ ও গ শ্রেনির কার্ডের মাধ্যমে রেশনিং পদ্ধতিতে চাল, ডাল, আটা, চিনি দেয়া উচিৎ। এই কর্মকর্তা আরও বলেছেন- অনেক পরিবারে অভাব থাকলেও তারা লাইনে দাঁড়িয়ে ওএমএস সুবিধা নিতে পারছে না।
জানতে চাইলে ২ নম্বর ওয়ার্ডের ডিলার শামীম জাহাঙ্গীর সেন্টু জানান- ‘আমরা ২০০ জনকে দিতে পারি, কিন্তু মানুষ আসেন তিন শর বেশি। সরকারিভাবে যে চাল বরাদ্ধ পাওয়া যায় ৫ কেজি করে ১১১ জনকে দেয়া যায়। আটার চাহিদা বেশী থাকার কারনে ৫ কেজির স্থলে ৩ কেজি করে ১৮৫ জনের কাছে বিক্রি করা হয়। এক মাস ধরে অনেক নতুন মুখের মানুষ আসছেন, যারা কখনও চালের জন্য শহরে আসেননি। এই কারণেই অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়েও চাল আটা পাচ্ছেনা।’