জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের মেহেরপুরের বাড়ি এখন জনশূন্য। দুর্দান্ত প্রতাবশালী ফরহাদের বিরুদ্ধে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তার নিজ আসনের সব শ্রেণির মানুষ।
গত ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত শহরের প্রাণকেন্দ্রে মন্ত্রীর বাড়ির সামনে কাঠাতিনেক খোলা জায়গা ছাড়িয়ে বাইরে প্রধান সড়কের পাশে অগণিত প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলের সারি থাকতো। মন্ত্রীর কারণে বাড়িটিতে কোন রাত নামতো না। দলীয় কার্যক্রম ছাড়াও সামাজিক কার্যক্রম আর দেনদরবারের নারী পুরুষের ভিড় লেগে থাকতো। বাড়িটিতে হাজিরা না দিলে মন্ত্রীর আস্থা হারিয়ে যেত। জেলা প্রশাসন পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীও হাজিরা দিতে বাধ্য হতেন। নাহলে তাকে হতে হতো হয়রানীর শিকার।
জেলাজুড়ে সরকারি কর্মকর্তা, দলীয় নেতা-কর্মীকে উঠতো বসতে হতো মন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনাতে। আহা- সেই বাড়ি এখন শুনসান নিরবতা। ক্ষুব্ধ মানুষের ক্ষোভের চিহ্ন সেই বাড়ির সামনে। আর এইসব ক্ষোভের বহিপ্রকাশ- দলে মারাত্মকভাবে বিভাজন তৈরী করা। প্রশাসনকে অধিনস্ত কর্মচারীর মতো দেখা, দলে নেতৃত্ব সৃস্টি হতে না দেয়া। একক সিদ্ধান্তে সব কিছু করা, ট্রাক প্রতিকের প্রার্থী ও সমর্থকদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন, পরিবার ও নিকটাত্বীয়দের মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত করা, অনুগত না হলে কী প্রশাসন, কী সংবাদকর্মী বা দলীয় নেতা তাকে শকুনের দৃষ্টিতে দেখা, মিডিয়ার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর কেক কাটতে মধ্যরাতে সংবাদকর্মীকে তার বাড়িতে গিয়ে কেক কাটা ও মন্ত্রীর শুভকামনার ফুটেজ নিতে বাধ্য করা। রাস্ট্রের উন্নয়ন ঠিকেদারী কাজে সেজ ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুল ও দুলাভাই আবদুস সামাদ বাবলু বিশ^াসকে পাইয়ে দিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা মন্ত্রীর রাজত্বের পতন ঘটিয়েছে। চাউর আছে ৪ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হেফাজতে ছিল মন্ত্রী। এখন ঢাকাতেই আত্মগোপনে আছে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। সেই দাপটে মন্ত্রীর বাড়ির সামনে এখন নেই কোন জনমানব। বাড়ির পাশের গাছগুলোতেও পাখিরা বসছেনা। ক্ষুব্ধ মানুষের ক্ষোভের চিহ্ন বাড়িটি দেখতে গ্রাম থেকে মানুষ আসছে। অনেকে থুতু দিচ্ছেন বাড়ির আঙ্গিনায়। কেউ কেউ জায়গাটিতে জলবিয়োগও করছেন।
শনিবার সকাল ৮ টায় ও বেলা ১১টায় বাড়ির গেটে গিয়ে অনেক ডাকাডাকি করেও ভেতর থেকে কেউ কোন উত্তর দেননি। পাশের ব্যবসায়ীরাদের দু‘জন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান- এখন মন্ত্রীর বড়ভাই কথিত মুক্তিযোদ্ধা শহিদ সাদিক হোসেন বাবলু, মেজভাই শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকবাল হোসেন বুলবুল অবস্থান করছেন। তবে তারা কেউ বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেনা। নিকট স্বজনরা গোপনে আনাজপাতিসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে রাতের বেলা গোপনে দিয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকায় শিক্ষকতা ছেড়ে ২০১৪ সালে বিতর্কিত ভোটে এমপি এবং ২০১৮ সালে ফের বিতর্কিতভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী হন ফরহাদ হোসেন। ২০২৪ ৩য়বারের মতো আবারও বিতর্কিত ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী হন।
ফরহাদ হোসেন মন্ত্রী হয়ে মারাত্মক বেপরোয়া হয়ে পড়ে । জনপ্রশাসন মন্ত্রী হবার পরপরই তিনি নিয়োগ বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। মেহেরপুরের বারাদি ইউনিয়নের সচিব পদে কামরুজ্জামান নামে একজনকে নিয়োগ দিতে ৩৮ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া ফেসবুকে চরমভাবে ভাইরাল হয়। মেহেরপুর পৌর কলেজকে সরকারি করণে কলেজের নাম পরিবর্তণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রীর বাবার নামে ‘ছহিউদ্দীন ডিগ্রী কলেজ’ নাম করণ করে। এবং কলেজ থেকে ২৫ লাখ টাকা নেয়ার কথা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য ছিলো স্মরণ কালের।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর প্রচার হবার সাথে সাথে বিক্ষুদ্ধ জনতা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে। মন্ত্রী পরিচালিত দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পর মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। এসময় মন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি পুলিশের কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয় মেহেরপুর জেলা জামাতের সহকারী সেক্রেটারি তারিক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। মন্ত্রীর বাড়ির সামনের অংশে যখন ভাংচুর শুরু হয় তখন ঝিঁঝি পোকারাও ডাক বন্ধ করে দিয়েছে। সামনের ভেটুল গাছটিসহ আশপাশের গাছগুলোতে আশ্রয়ে থাকা পাখিরাও হামলাকারীদের প্রতিরোধে হাঁক ডাক, চিৎকার করা বন্ধ করে দেয়। এসময় ত্রাণকর্তা হয়ে ক্রসফায়ারের নামে নিহত তারিক মোহাম্মদের ভাই মোহাম্মদ তাওফিকুল ইসলাম বুক আগলে ক্ষুব্ধ জনতাকে প্রতিরোধ করে আগুণ নিয়ন্ত্রণে আনে।
তাওফিকুল ইসলাম শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন মেহেরপুর পৌর কমিটির সভাপতি। মন্ত্রীর নির্দেশে যেখানে বন্দুক যুদ্ধের নামে ভাইকে হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার কথা। সেখানে মন্ত্রীর বাড়ি রক্ষায় বুক আগলে প্রতিরোধ করে মেহেরপুরে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে তাওফিকুল ইসলাম।
মেহেরপু পৌর মেয়র ও জেলা যুবলীগের আহবায়ক মাহফুজুর রহমান রিটন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলো অথচ মেহেরপুর পৌরসভার দূর্ভাগ্য যে পৌরসভার উন্নয়নে জনপ্রশাসন মন্ত্রী নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তিনি আরও বলেন, কোন সরকারি ও সামাজিক অনুষ্ঠানে পৌর মেয়র হিসেবে আমাকে আমন্ত্রিত করা হলে সেই অনুষ্ঠানে হাজির হতেন না মন্ত্রী। তিনি যেসব অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন সেসব অনুষ্ঠানের ব্যানার থেকে আমার নাম বাদ দিয়ে নতুন করে ব্যানার করতে হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানকে। এজন্য বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে।
দলীয় দ্বন্দ্ব প্রশ্নে দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়াজান আলী বলেন, দির্ঘ প্রায় দেড়যুগ সবকিছু হয়েছে মন্ত্রীর ইচ্ছামতো, পদ বণ্টন হয়েছে মন্ত্রীর স্বজনদের মধ্যে। দলের কোন নেতা-কর্মীকে মূল্যায়ন করা হয়নি। আমরা সর্বশক্তিমানের কাছে বিচার প্রার্থণা করে আসছিলাম। প্রকৃতিই তার প্রতিশোধ নিয়েছে।