ডাক্তার আবু তাহের সিদ্দিক। একজন এমবিবিএস চিকিৎসক। অস্ত্রপাচার করার কোনো অভিজ্ঞতা ও বৈধতা না থাকলেও তার ক্লিনিকে সবধরনের সিজারিয়ন অপারেশন করে থাকেন তিনি।অবৈধভাবে রোগীর অপারেশনের মত জটিল একটি কাজ করলেও প্রশাসনিকভাবে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়না কখনো। ফলে এলাকার শত শত রোগী মৃত্যু অথবা চিরদিনের জন্য পঙ্গু হচ্ছেন তার অপচিকিৎসায়। চিকিৎসাসেবার নামে এই চিকিৎসক ক্লিনিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। সেবার পরিবর্তে অর্থের পেছনে ছুটছেন তিনি। সরকারি হাসপাতাল থেকে দালালদের মাধ্যমে রোগী ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সরেজমিনের দেখা গেছে, পুরনো ও নিম্নমানের যন্ত্রপাতি, অদক্ষ সেবিকা, টেকনিশিয়ান ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকলেও প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে মেহেরপুরে তাহের ক্লিনিক-১ ও গাংনী উপজেলা শহরে তাহের ক্লিনিক-২ নামে ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলছে।
অভিযোগ উঠেছে, ক্লিনিক স্থাপনের কোনো আইন না মেনেই সিভিল সার্জনকে ‘ম্যানেজ’ করে এই দুটি ক্লিনিক গড়ে উঠেছে।
অভিযোগ উঠেছে ডা. আবু তাহের শুধুমাত্র মেডিকেল অফিসার হলেও ক্লিনিকে বসে সব ধরনের অপারেশন করে থাকেন। যদিও একজন এনেসথেসিয়া চিকিৎসক দিয়ে অপারেশনের আগে অজ্ঞান করার কথা। কিন্তু ডা. আবু তাহের সিদ্দিক এনেসথেসিয়ার কাজটিও নিজে করে থাকেন।
ক্লিনিকে সেবিকাদের ডিপ্লোমাধারী সনদ থাকার কথা থাকলেও ওই ক্লিনিকের সেবিকা নেই। ক্লিনিকে লক্কড়-ঝক্কড় ১০০ এমএল এক্স-রে মেশিন দিয়ে চলছে এক্স-রের কাজ। এক্স-রে টেকনিশানও অদক্ষ লোক। টেকনিশিয়ান আহম্মেদ হুসাইনের কোনো একাডেমিক সনদ না থাকলেও বহাল তবিয়তেই নামমাত্র বেতনে অনেকদিন ধরে চাকরি করে আসছেন।
অদক্ষ প্যাথলজি টেকনিশিয়ান দিয়ে বিভিন্ন টেস্ট করে থাকেন।
এদিকে, ডা. আবু তাহেরের ভুল অপারেশনের শিকার হয়ে গাংনী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। এছাড়া অনেকে এখন পঙ্গু জীবনযাপন করছেন।
মেহেরপুরে তাহের ক্লিনিকের এই দুটি শাখাতে একের পর এক রোগীর মৃত্যু ঘটনা ঘটলেও কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ভুল অপারেশনে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন রুগীর মৃত্যু হলেও অজ্ঞাত কারণে বারবারই পার পেয়ে যাচ্ছে ডাক্তার আবু তাহের। এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষের উদাসিনতাকেই দায়ি করছে ভুক্তভুগী পরিবারের সদস্যরা।
তাহের ক্লিনিক গাংনী ২ শাখায় ভুল চিকিৎসায় গাংনী উপজেলার হেমায়েতপুর গ্রামের আখতারুল ইসলামের স্ত্রী সাইফুন্নেসা(২৫) মারা গেছে।
গত শনিবার প্রসব বেদনা নিয়ে ডা. আবু তাহের সিদ্দিক এর শরণাপন্ন হয়ে সিজারিয়ান অপারেশন করেন সাইফুন্নেসা(২৫)। আজ মঙ্গলবার {১৬ এপ্রিল} সকাল ৮টার দিকে ওই রোগীর মৃত্যু হয়।
সাইফুন নেছার ভাইয়ের ছেলে ফিরোজ জানান, অপারেশনের পর থেকেই আমার ফুপুর রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরে গাংনী থেকে দ্রুত মেহেরপুর তাহের ক্লিনিকে নিয়ে যান ডা. আবু তাহের সিদ্দীক। পরে মেহেরপুর তাহের ক্লিনিকে ৫ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পরেও রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। তড়িঘড়ি করে পরিবারের লোকজনকে ম্যানেজ করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পুনরায় অপারেশন করার পর রোগীর মৃত্যু হয়।
তাহের ক্লিনিক ২ এর ম্যানেজার মামুনুর রশিদ জানান, ডা. আবু তাহের সিদ্দীকী নিজেই এনেসথেসিয়া ও সিজারিয়ান অপারেশন করেছেন।
এ বিষয়ে ডা. আবু তাহের সিদ্দিক জানান, সিজারিয়ান অপারেশন ভুল ছিল না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
মেহেরপুর জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার মহি উদ্দিন জানান, ঘটনাটি শোনার পর গাংনী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু তারা কোন প্রকার তথ্য দেননি আসলে কি কারন দেননি এটা আমার জানা নেই।
গাংনী থানার ওসি তাজুল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, ২০১২ সালে গাংনী উপজেলার কসবা গ্রামের জাকারিয়া হোসেনের স্ত্রী রাজিয়া খাতুন নামে একজন প্রসূতি মাকে অপারেশন করে সন্তান হওয়ার পর নাড়ি সেলাই না করেই পেট সেলাই করে দেন ডাক্তার আবু তাহের। ১ ঘণ্টা পর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। পরে তাকে দ্বিতীয়বার পেটের সেলাই খুলে নতুন করে সেলাই দিয়ে দেন। এর পর পরই রাজিয়া খাতুন মারা যান।
একই বছরে গাংনীর চৌগাছা গ্রামের মৃত আলম হোসেনের স্ত্রী রিজিয়া খাতুন তার পেটে সমস্যা দেখা দেওযায় তাহের ক্লিনিকে ভর্তি হন। তার পেটে অ্যাপ্যান্ডিসাইটস হয়েছে বলে প্রতিবেদন দিয়ে তার অপারেশন করেন ডা. আবু তাহের।
কিন্তু ডা. তাহেরের অর্থলোভের কারণে অ্যাপ্যান্ডিসাইটস না হলেও তাকে অপারেশন করেন। পরে বিষয়টি নিয়ে এলাকার লোকজন ক্লিনিকে গেলে ডাক্তার আবু তাহের ক্ষমা চেয়ে তার চিকিৎসার ব্যয় বহন করেন।
২০১৯ সালে গাংনী উপজেলার হিজলবাড়িয়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে এবং একই উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া ইউনিয়নের রামদেবপুর গ্রামের সাইফুল ইসলামের স্ত্রী রিমা খাতুন তাহের ক্লিনিকে সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করেন।এনেসথেসিয়া ছাড়াই ডাক্তার আবু তাকে সিজার করেন। ওই দিন সকাল বেলা ১২ টার দিকে সিজার করে সন্তান প্রসব করার পর রাত ৮ টার দিকে প্রচন্ড রক্ত ক্ষরনে মারা যান রিমা খাতুন।
২০১৫ সালে গাংনী উপজেলার গাঁড়াডোব গ্রামের হাফিজুর রহমান নামের এক ব্যক্তি তাহের ক্লিনিকের মেহেরপুর শাখায় অস্ত্রপচারের পরপরই মৃত্যু হয়।
মৃত হাফিজুর রহমানের মেয়ে নিলুফা খাতুন জানান, অস্ত্রপচার শেষে আমার বাবাকে বেডে নিয়ে আসে। এর পরপরই তার মৃত্যু হয়। ঘটনা ধামাচাপা দিতে দ্রুত নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স যোগে লাশ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন ক্লিনিক মালিক ডা. আবু তাহের।
২০১৩ সালে গাংনী তাহের ক্লিনিক ২ এ মায়া খাতুন (৩৩) পিত্তথলিতে পাথর অপারেশনের পর তার মৃত্যু হয়। মায়া পিতা রেজাউল হক জানান, ডাক্তার আবু তাহেরের ভুল অপারেশনের কারনে তার মেয়ে মায়ার মৃত্যু হয়।
২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাহের ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসার বলি হন মেহেরপুর সদর উপজেলার গোভিপুর গ্রামের মৃত হারান হাল সানার ছেলে আব্দুল খালেক (৫০)। ঐ ঘটনায় রোগীর স্বজন ও ক্ষুদ্ধ জনতা ক্লিনিক ভাংচুর করে । এ ঘটনায় নিহতের মেয়ে পারিভন খাতুন অভিযোগ করে বলেছিলেন, ডা. তাহের নিজেই অজ্ঞান করা ইনজেকশন দিয়ে তার বাবাকে মেরে ফেলেছে।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বনানীপাড়ার ফরিদুল ইসলাম হৃদয়ের স্ত্রী জেসমিন খাতুনের একদিনের নবজাতক এক শিশুর তাহের ক্লিনিকের মালিক ও চিকিৎসক আবু তাহের অপারেশন করে মলদ্বারের পথ তৈরি করতে গিয়ে শিশুর প্রসাবের নালি কেটে ফেলেন। ফলে নবজাতকের স্বাভাবিক মূত্রনালী দিয়ে যে প্রসাব হচ্ছিলো, সেটা মলদ্বার দিয়ে হচ্ছিল। ভুল অপারেশনের কারণে মলদ্বারেও মারাত্মক ইনফেকশন হয়ে শিশুটির জীবন সংকটাপন্ন। পরে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন নবজাতককে দেখে ঢাকা পিজি হাসপাতালে রেফার করেন।