মেহেরপুরে কয়েকদিনের বৈরী আবহাওয়ার কারণে আশংকাজনকহারে ছড়িয়ে পড়েছে ডায়রিয়া ও স্বাসকষ্ট জনিত রোগ। শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া এ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। আবু জায়েদ নামের এক শিশু ডায়রিয়া ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ডায়রিয়া রোগিদের জন্য খাবার স্যালাইন সংকট না থাকলেও রয়েছে কলেরা স্যালাইন সংকট।
গত এক মাস ধরে ওষুধ সংকট থাকলেও চাহিদা অনুযায়ি হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ করা হয়নি। ফলে বাইরে থেকে রোগিদেরকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। প্রচণ্ড শীত ও কুয়াশার কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগির সংখ্যা বেড়েছে বলে হাসপাতাল সুত্র জানিয়েছে। তবে মারা যাওয়া শিশুর পরিবার ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বলে জানালেও বিষয়টি অস্বিকার করেছেন জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যানুযায়ি, মেহেরপুর জেলায় গত ২৪ ঘন্টায় ৮৮ জন শিশু বৃদ্ধ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে বহিঃবিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন আরো ২০০ জন। এর মধ্যে মেহেরপুর সদরে ৫৩জন, গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৯ জন ও মুজিবনগরে ৬জন ভর্তি রয়েছেন। এদের বেশির ভাগই শিশু। ভর্তিকৃত শিশুদের অধিকাংশরই বয়স পাঁচ বছরের নিচে। গত কয়েকদিন ধরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
জানাগেছে, গত শনিবার সন্ধায় অবু জায়েদ (২বছর) বয়সের এক শিশু জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। আবু জায়েদ গাংনীর ভাটপাড়া গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে।
মৃত আবু জায়েদের মা তামান্ন খাতুন জানান, এক সপ্তাহ আগে তার ছেলের বমি ও পাতলা পায়খানা নিয়ে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। তিনদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হয়ে উঠলে আবু জায়েদকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন। দুএকদিন যাবার পরে শুক্রবার রাত থেকে আবারও পাতলা পায়খানা, বমি ও জ্বর শুরু হয়। শনিবার সকালে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। দেয়া হয় ডায়রিয়ার চিকিৎসা। অবস্থা ক্রমশ অবনতি হলে সন্ধায় তাকে রেফার্ড করা হলে মেহেরপুর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক আবু জায়েদকে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে নয়টার দিকে তার মৃত্যু হয়। শিশু মৃত্যুর বিষয়ে সিভিল সার্জন বলেন, ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি হলেও শিশুটি অন্যান্য সমস্যা যেমন জ্বর ও খিচুনি ছিল যার কারনে তার কনভারসেশন হয়ে মারা যেতে পারে।
গাংনী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের ওয়ার্ডে জায়গা নেই। রোগিদের ঠাঁই হয়েছে মেঝেতে। এদেরকে চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্স । শিশু রোগিদের আর্তচিৎকারে হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। রোগির স্বজনরা জানালেন, হাসপাতাল থেকে খাবার স্যালাইন দেয়া হলেও বাইরে থেকে কলেরা স্যালাইন কিনতে হচ্ছে। গত দুই মাস যাবত গাংনী উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে কলেরা স্যালাইনের সংকট রয়েছে। বারবার চাহিদা দিলেও আজো কলেরা স্যালাইন সরবরাহ করছেন না ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এমনটি জানান স্টোর কীপার দবির উদ্দীন। তিনি আরো জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় ৩০০টি কলেরা স্যালাইন মজুদ ছিল জরুরী সেবার জন্য। সেগুলো ওয়ার্ডে দেয়ার পর আর কোন স্যালাইন অবশিষ্ট নেই। অল্প কিছু আছে তা অঞ্চল ভিক্তিক মহামারী মোকাবেলার জন্য রাখা হয়েছে।
গাংনী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি শিশু আড়পাড়া গ্রামের জান্নাতুল মাওয়ার বাবা সাবাদুল জানান, গত শনিবার ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হবার পর থেকে খাবার স্যালাইন দেয়া হয়। কিন্তু বাইরে থেকে কলেরা স্যালাইন কিনতে হচ্ছে। এখানে ডাক্তাররা রোগিদের প্রতি যত্নবান না। তবে নার্সদের কাছ থেকে কাঙ্খীত সেবাটি পাওয়া যাচ্ছে না। একই কথা জানালেন ইসলামপুরের শামীমার বাবা শাহিন আলম। চৌগাছা গ্রামের দুই বছর বয়সি মাসুমা ভর্তি রয়েছেন দুদিন।
তার বাবা আমানুর জানান, ভর্তির পর খাবার স্যালাইন হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাসপাতালের লোকজনের দায়িত্ব শেষ। রোগির অবস্থা খারাপ হলে বাইরে থেকে কলেরা স্যালাইন কিনতে হাতে স্লীপ ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। নার্সরা রোগির খোঁজ খবর নিলেও ডাক্তারদের দেখা মিলছে না। তবে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
কর্তব্যরত সেবীকারা জানান, রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। খাবার স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। কলেরা স্যালাইন সরবরাহ না থাকায় রোগীদের স্বজনকে বাইরে থেকে কিনতে বলা হচ্ছে। বয়ষ্করা খাবার স্যালাইন খেতে পারছে তাই তাদের বাইরে থেকে কলেরা স্যালাইন কেনা লাগছে না। কিন্তু শিশুরা খাবার স্যালাইন খেতে অনীহা করে । বাধ্য হয়েই কলেরা স্যালাইন কিনতে বলা হচ্ছে।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুপ্রভা রানী জানান, রোগীদের চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তার ও নার্সরা। স্যালাইন সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি জানান, কয়েকমাস যাবত কলেরা স্যালাইন সংকট রয়েছে। চাহিদা দেয়ার পরও কোন জবাব মেলেনি। তবে ডাক্তারদের অবহেলার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে জানান, চিকিৎসক সংকটের কারণে অনেক সময় সেবা দেয়ায় বিঘ্ন ঘটে।
মুজিবনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার তৌফিকুর রহমান জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওষুধ সরবরাহ রয়েছে। সেবা দানে কোন সমস্যা হচ্ছে না।
মেহেরপুর সিভিল সার্জন জওয়াহেরুল আনাম সিদ্দিকী জানান, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও কুয়াশার কারণে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। পর্যাপ্ত খাবার ও কলেরা স্যালাইন রয়েছে। গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কেন কলেরা স্যালাইন নেই তা দেখা হচ্ছে। রোগীদের স্বাস্থ্য সেবায় ডাক্তারদের কোন অবহেলা নেই। তবে কোথাও কোথাও ডাক্তার সংকটের কারণে সেবা দেয়াটা একটু কষ্টকর হয়ে দাড়িয়েছে বলেও জানান তিনি।