মেহেরপুরে প্রায় দুই সপ্তাহ যাবৎ নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প দিগুন দামে বিক্রি করছেন ভেন্ডাররা। ট্রেজারিতে স্ট্যাম্প সংকট থাকায় ভেণ্ডাররা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে সিণ্ডিকেটের মাধ্যমে দিগুণ দামে বিক্রি করছেন স্ট্যাম্প। ফলে গত দুই সপ্তাহ ধরে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থসহ নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
দ্বিগুণ দামে কালোবাজারে স্ট্যাম্প বিক্রির বিষয়ে জেলা প্রশাসক বললেন, এই বিষয়ে প্রশাসন পদক্ষেপ নেবে। ভেণ্ডারদের দাবী ট্রেজারি শাখা থেকেই কৃত্তিম সঙ্কট তৈরি করা হয়েছে। তবে আজ থেকে স্ট্যাম্প সরবরাহ স্বাভাবিক হবে বলে জানিয়েছে ট্রেজারি শাখা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহ যাবৎ মেহেরপুর জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে সরকারি ১০০ টাকা মূল্যের নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প সংকট দেখা দিয়েছে। স্ট্যাম্প ভেন্ডারিরা বারবার আবেদন করলেও জেলা প্রশাসন থেকে কোনো স্ট্যাম্প বরাদ্দ দিতে পারেনি। ভেন্ডার গুলোতে একশ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্প পাওয়া না গেলেও অসাধু কালোবাজারি ভেন্ডারিকে প্রকাশ্যে তিনশ টাকার স্ট্যাম্প ছয়শ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
সরেজমিনে গত মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মেহেরপুর সাররেজিস্ট্রি অফিস, নিমতলা আইনজীবী সমিতি চত্ত্বরম দলিল লেখক সমিতি চত্ত্বরে অবস্থান করে স্ট্যাম্প ভেন্ডার, দলিল লেখক ও গ্রাহকদের সাথে কথা বলে ভোগান্তির কথা জানা গেছে।
গাংনী উপজেলার গাঁড়াবাড়িয়া গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস এসেছিলেন মেহেরপুর সদর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে জমি রেজিস্ট্রি করতে। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত স্ট্যাম্প না পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভেন্ডারীদের খুপড়ি ঘরে। তিনি বলেন, জমি রেজিস্ট্রি করতে এসে এখন পর্যন্ত ১০০ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্প কিনতে পারিনি। এখানকার কোনো কোনো স্ট্যাম্প ভেন্ডারে পাইনি। তবে বিপ্লব পাল নামের এক স্ট্যাম্প ভেন্ডারে ৩০০ টাকা স্ট্যাম্প ৬০০ টাকা দাম বললো।
একই কথা বললেন ওই গ্রামের শুকুর আলী। তিনি বলেন, কোনো যায়গায় স্ট্যাম্প না পেয়ে বাপ্পি পাল নামের এক ভেন্ডারে গিয়ে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প ৫০০ টাকা দিয়ে কিনে জমি রেজিস্ট্রি করলাম। সদর উপজেলার শোলমারী গ্রামের তারিক হোসেন বলেন, ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প ৬০০ টাকা দিয়েও মেলাতে পারছিলাম না। পরে অনেক কষ্টে নিম তলার একটি যায়গা থেকে কালো বাজার থেকে ৬০০ টাকা দিয়ে স্ট্যাম্প কিনলাম।
খাইরুল স্ট্যাম্প ভেন্ডারের মালিক খাইরুল ইসলাম ক্যাংকর বলেন, প্রায় ২ সপ্তাহ মেহেরপুর ট্রেজারি থেকে আমাদের নন জুডিশীয়াল ১০০ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্প দিতে পারেনি। আমরা জমি ক্রেতা বিক্রেতাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়ছি। অথচ, কালোবাজারিদের কাছে স্ট্যাম্প মিলছে। তিনি প্রশ্ন করেন এটা কি করে সম্ভব হয়। একশ টাকার স্ট্যাম্প ৩ শ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এটা প্রশাসনের দেখা উচিৎ।
দলিল লেখক রুহুল আমিন বাবু বলেন, একশ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্প না পেয়ে ২০ টাকা ৫০ টাকার স্ট্যাম্প দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে আমরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি। আগে যেখানে ১০ পাতা লিখতে হতো এখন সেখানে ১৮/১৯ পাতা লিখতে হচ্ছে।
একই কথা জানালেন দলিল লেখক মতিউর রহমান মতি। তিনি বলেন, সময় লাগছে বেশী। আবার গ্রাহকদের কাছ থেকে নানা ধরণের কথা শুনতে হচ্ছে। ব্যাংকে গেলেও ব্যাংকের কর্মকর্তারা নানা কথা শুনাচ্ছেন।
প্রবীণ দলিল লেখক আব্দুল আজিজ জানান, আমি দীর্ঘদিন দলিল লিখছি। আমার জীবনে ২০০৮ সালে একবার স্ট্যাম্প ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। আর এ বছর ৪ মাসের মধ্যে ২ বার স্ট্যাম্প ঘাটতি দেখা গেলো। তিনি বলেন, ট্রেজারি শাখার বড়বাবু আরেফিন রেজা যোগদানের পর থেকেই এই সংকট তৈরী হয়েছে।
দলিল লেখকরা নাম প্রকাশ না শর্তে জানান, ১ লাখ টাকার দলিলে শুধু স্ট্যাম্প দেওয়া হতো ১৩ শ টাকার নগদ স্ট্যাম্প ও বাদ বাকী টাকা সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে চালান করা হতো। কিন্তু স্ট্যাম্প ঘাটতি হওয়ার কারণে, ২০০ টাকার স্ট্যাম্প দিতে হচ্ছে। বাকি ১৪ হাজার ৮০০ টাকা চালান করতে হচ্ছে। এর ফলে ১০ পাতার স্থলে ১৬ থেকে ১৮ পাতা দিতে হচ্ছে। এতে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের সাথে দলিল লেখকদের বাকবিতন্ডাসহ অষন্তোষ্ট তৈরী হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক জন ভেন্ডার বলেন, নতুন করে ভেণ্ডার লাইসেন্স নবায়ন করতে গেলে জেলা প্রশাসকের এলআর ফান্ডে ৫ হাজার টাকা করে জমা দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন ট্রেজারি শাখার বড় বাবু আরেফিন রেজা। অথচ এর আগে নবায়নের সময় ৫শ থেকে এক হাজার টাকা দিয়েছি। টাকা না দিলে ভেন্ডারী লাইসেন্স বাতিল ও নবায়ন না করারও হুমকী দিচ্ছেন। ট্রেজারী চালান করলেও স্ট্যাম্প দেবেনা বলেও হুমকী দিচ্ছেন। এটা জেলা প্রশাসক ও এনডিসির নির্দেশ বলেও স্ট্যাম্প ভেন্ডারদের জানান আরেফিন।
এ ব্যাপারে আরেফিন রেজাকে মেহেরপুর প্রতিদিন অফিস থেকে ফোন করা হলে প্রথমে দেখা করে বলবেন জানালেও পরে ফোন দিয়ে জানান, এডিএম স্যারের সাথে কথা বলেন। পরবর্তিতে আবারো ফোন দিয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা। এমনকি স্ট্যাম্প সংকটের ব্যাপারেও তিনি কিছুই জানেন না বলেও জানেন। তবে ট্রেজারিতে মাল (স্ট্যাম্প) ছিলো না, মাল এসেছে। আর সংকট থাকবে না।
মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ মুনসুর আলম খান বলেন, দু একদিনের মধ্যেই সংকট দুর হয়ে যাবে। আমরা চাহিদা দিয়েছিলাম। ইতোমধ্যে স্ট্যাম্প আমাদের ট্রেজারীতে এসে পৌছেছে। সংকটের কারন হিসেবে তিনি বলেছেন, বিজি প্রেসে স্ট্যাম্প ছাপা হয়। জেলাতে স্ট্যাম্পের চাহিদা বেড়েছে এবং বিজি প্রেস থেকে আসতে দেরি হয়েছে। এছাড়া কালোবাজারে স্ট্যাম্প বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। তবে এলআর ফাণ্ডের টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।