মেহেরপুরে মৎস্য চাষীদের নিরাপদ মাছ চাষ, পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও আর্থিকভাবে লাভবান করে বিপ্লব ঘটিয়েছে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন(পিকেএসএফ)। পুকুর ও পুকুর পাড়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে মাছ চাষ ও সবজি উৎপাদন করতে জেলার শতাধিক মৎস্য চাষিকে আর্থিক সহায়তা,কারিগরি প্রশিক্ষণসহ নানামুখি সহায়তা দিচ্ছে পিকেএসএফ-নামের এই প্রতিষ্ঠানটি। আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় পিএসকেএস মৎস্য খাতে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় রীতিমতো মৎস্য বিপ্লব ঘটেছে। স্বল্প খরচে অধিক লাভজনক হওয়ায় সাধারণ চাষ পদ্ধতির চেয়ে কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে মাছ চাষে মৎস্য চাষীদেরর আগ্রহ বাড়ছে, অন্যদিকে সাবলম্বী হচ্ছেন অনেক উপকারভোগীরা ।
স্বল্প সময়ে বড় মাছ উৎপাদন হওয়ায় বাণিজ্যিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন অনেকেই। এ পদ্ধতির ব্যপকতা তৈরীতে চাষীদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা করছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর সমন্বিত কৃষি ইউনিটভুক্ত মৎস্য খাত। কার্যক্রমটি দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করছে মেহেরপুর জেলার পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি (পিএসকেএস) নামক একটি বেসরকারি সংস্থা।
জানা গেছে, সারা দেশে সমন্বিত কৃষি ইউনিটভুক্ত মৎস্য খাতের বিপ্লব ঘটাতে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ২০১৩-১৪ অর্থবছরে একটি কার্যক্রম চালু করে। মেহেরপুর অঞ্চলে কার্যক্রম(প্রোগ্রাম) বাস্তবায়ন করছে পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি (পিএসকেএস)। এরই আওতায় মেহেরপুর জেলায় মৎস্য চাষীদের মাধ্যমে কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে মাছ মোটাতাজাকরণের ১৩০ টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সুফলভোগীদের মাঝে মাছ চাষের সব উপকরণ বিতরণের পাশাপাশি মৎস্য চাষীদের মাছ চাষ বিষয়ক প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস, মৎস্য সেবা ও পরামর্শ কেন্দ্র বাস্তবায়ন, মৎস্য সপ্তাহ উদযাপন সহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি (পিএসকেএস)।
গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের মৎস্য চাষী কিবরিয়া জানান, ছোট মাছ বিক্রি করে আগে যে পরিমাণ টাকা আয় হতো তাতে আমার লোকসান হতো। পরে পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতির কারিগরি কর্মকর্তার পরামর্শে কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে মাছ মোটাতাজাকরণ শুরু করি। এর জন্য আমাকে পোনা সহায়তা দিয়েছে এবং বিভিন্ন উপকরণ দিয়েছে। সব সময় পরামর্শ দিয়েও সহায়তা করছে। আমার পুকুরে ৩ থেকে ৪ কেজি ওজনের মাছ রয়েছে। ৫০ শতাংশ পুকুরে এ বছর দেড় থেকে ২ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হবে বলেও জানান এই মৎস্য চাষী।
সুফলভোগী মৎস্য চাষী ওবাইদুর রহমান জানান, বাজারে সব সময়ই বড় মাছের চাহিদা অনেকাংশে বেশি। ফলে দামও ভাল। আমার এক বিঘা পুকুরে বড় মাছ তৈরী করেছি। ২ কেজির নিচের ওজনের মাছ বিক্রি করলে দাম কম হয়। তাই ৩ থেকে ৪ কেজি ওজনের মাছ বিক্রি করি ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।
জোড়পুকুরিয়া গ্রামের মৎস্য চাষী হাসান ও নাহিদ জানান, আধা কেজি ওজনের মাছের মূল্য ১৩০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। এই ওজনের মাছ মোটাতাজা করে বিক্রি করা হলে অনেক ভাল দাম পাওয়া যাচ্ছে। এতে দাম ভাল পাওয়ার পাশাপাশি পুকুরে খাবারও কম লাগে। বড় মাছের প্রয়োজন হলেই এলাকার বিভিন্ন মানুষ আমাদের সাথে মাছ কিনে নিয়ে তাদের বড় মাছের চাহিদা পূরণ করেন।
পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতির মৎস্য কর্মকর্তা সাঈদ-উর-রহমান জানান, গতানুগতিক মাছ চাষের পরিবর্তে আমরা আদর্শ মৎস্য চাষের পরামর্শ দিয়ে থাকি । কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে আধা কেজি ওজনের কার্প জাতীয় মাছ পুকুরে পরিমিত ঘনত্বে মজুদ করে এবং নিয়মিত সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগের মাধ্যমে চাষ করে দেড় বছরে পাঁচ কেজি থেকে ছয় কেজি ওজনের মাছ উৎপাদন করাই কার্প ফ্যাটেনিং বা মাছ মোটাতাজাকরণ । বাজারে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, কমন কার্প প্রভৃতি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই জাতীয় মাছ দ্রত বড় হয়, রোগাক্রান্ত কম হয়, খাদ্য ও জায়গার জন্য একে অপরের প্রতিযোগী নয়, পানির সব স্তর থেকে প্রাকৃতিক খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। তাই পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে এবং এসব মাছ খেতেও সুস্বাদু।
কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তিতে সাধারণত বড় আকারের যেমন ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের কার্প জাতীয় মাছ পুকুরে মজুদ করা হয়। এতে প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করে নয় থেকে দশ মাসেই মাছ বাজারজাত করা হয়, যা মেহেরপুর জেলার মৎস্য চাষীদের কাছে ছিল অকল্পনীয় । কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় গ্রামীণ মহিলাদের সম্পৃক্ত করে ছোট আকারের জলাশয়ে শিং, মাগুর, গুলশা মাছ চাষ বৃদ্ধির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। বর্তমান বাজারে ছোট মাছের পাশাপাশি বড় মাছের চাহিদা ও মূল্য অনেক বেশি। জেলায় বড় মাছের চাহিদা পূরণ করে বাইরের জেলাতে মাছ বিক্রি শুরু করেছেন চাষীরা। এতে অধিক মুনাফা আয় করে সাবলম্বী হচ্ছেন অনেকেই।
কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে পুকুরে পাতলা করে মাছ চাষ করা হয়। এ পদ্ধতিতে বিঘা প্রতি ১২০ থেকে ১৫০টি রুই মাছ, কাতলা ৪০টি, মৃগেল ৭০ টি, কমন কার্প ৩০ টি ও সিলভার কার্প ২০টি করে চাষ করা হয়। সাধারণভাবে যে পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হয় এর তুলনায় এ পদ্ধতিতে পাঁচ-ছয় গুণ বেশি মাছ উৎপাদন করা হয়।
কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে বছর শেষে বিঘা প্রতি ১০০০-১২০০ কেজি মাছের উৎপাদন পাওয়া যায়। মাছ বড় হওয়ার কারণে এসব মাছ প্রতি কেজি ৩০০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রয় হয়ে থাকে। এতে বিঘা প্রতি দেড় থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত মাছ বিক্রয় করা সম্ভব হয়। মৎস্য চাষীরা ছোট মাছ উৎপাদন করে বিঘা প্রতি এক বছরে ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকার মাছ বিক্রয় করতে পারেন। কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদন করে দুই থেকে তিন গুণ বেশি লাভ করা সম্ভব হচ্ছে।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলা মৎস্য স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি জেলা। জেলায় ছোট বড় ৯০৬৫ জন মৎস্য চাষী রয়েছে। এ সকল মৎস্য চাষী প্রতি বছর ১৩ হাজার ৫৯০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করে। জেলায় মাছের চাহিদা রয়েছে ১৩ হাজার ৯৯৫ মেট্রিক টন। জেলায় পুকুর রয়েছে ৫ হাজার ৩৬৫ টি। এর মধ্যে শুধু গাংনী উপজেলাতেই পুকুর রয়েছে ৩ হাজার ৭১৩টি। মৎস্য চাষী রয়েছে ৪০০০ অধিক। উপজেলায় ৬ হাজার ২২১ মেট্রিক টন মাছ শুধুমাত্র গাংনী উপজেলাতেই উৎপাদন হয়ে থাকে। এ উৎপাদনে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর আর্থিক সহায়তা প্রকল্প বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে।
পিএসকেএস-এর পরিচালক (কর্মসূচি) মোহাঃ কামরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ । এদেশের জনগনের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদান, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি কৃষক বা খামারির দক্ষতা উন্নয়নে পিএসকেএস পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর সহায়তায় কৃষি, মৎস্য ও প্রণিসম্পদ খাতে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে । এরই ধারাবাহিকতায় মেহেরপুরের গাংনী উপজেলাতে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে । আমরা সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছি ।
মেহেরপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ রোকনুজ্জামান জানান, জেলায় চাহিদা ও উৎপাদন মোটামুটি সমান সমান। বাইরের জেলা থেকে মাছের প্রত্যাশা করে না। কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে মাছ মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের আওতায় পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) অর্থ দিয়ে জেলার মৎস্য চাষিদের সহায়তা করে আসছে। অনেক মৎস্য চাষী পিকেএসএফ এর প্রণোদনা পেয়ে মাছ মোটাতাজাকরণ করে লাভবান হচ্ছে। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের বেসরকারী সংস্থা (এনজিও) গুলোও মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে নানা কর্মকান্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে । দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি এনজিও গুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলেও জানান তিনি ।