মেহেরপুরে চলতি মৌসুমে পাট চাষ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা সমস্যায় উৎপাদন বিপর্যয়ের শঙ্কা ন্যায্যমুল্য না পাওয়া পোকার আক্রমণসহ বিভিন্ন সমস্যা যেন পিছু ছাড়ছে কৃষকদের। পাট চাষে মৌসুমের শুরুতে দেশব্যাপী চলা দাবদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে তুলনামূলক ভাবে পাট বেড়েছে কম, আর আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ছোট ছোট পাট গাছেই ধরেছে ফুল ও ফল। বৃষ্টি না হওয়ায় সেই সঙ্গে মরছে গাছও। এর মাঝে বেড়ে ওঠা পাটে শেষ সময়ে এসে দেখা দিয়েছে পানির সমস্যা। অনাবৃষ্টির কারনে খাল, বিল ও পুকুর ডোবাই পানি না থাকায় পাট পঁচানো নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। স্যালোমেশিনে পানি দিয়ে পাট পঁচানো হলেও পাটের দাম না পাওয়ায় খরচের অর্ধেক টাকাও উঠছেনা চাষিদের।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আষাঢ়ের ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে চাষিদের জমি থেকে পাট কেটে জাগ দেয়ার কথা। সেই জমিতে আবার আউশ ধানের চারা রোপন করা হয়। অথচ খাল বিল ও কাজলা নদীতে পানি না থাকায় পাট পঁচানো সম্ভব হচ্চেনা। পাট নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। জমি থেকে পাট কাটতে না পারায় ধানের আবাদও করতে পারছেননা চাষিরা। ফলে ধানের আবাদ থেকে পিছিয়ে পড়ছেন অনেকেই। আবার অনে কৃষক চাষ করে শেষ পাট গাছে তিড়িং পোকার আক্রমণের সাথে যোগ হয়েছে জমি থেকে ওঠে আসা লবণাক্ততা। যার ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দুর্বল হয়ে মরে যাচ্ছে পাট গাছ। আর বাকি গুলোতে তিড়িং পোকার আক্রমনে পাতা শুন্য হয়ে যাচ্ছে গাছ। যেখানে প্রতিটি পাট গাছ বেড়ে ওঠে ৮ থেকে ১০ ফুট উচ্চতায়। সেখানে অনাবৃষ্টির কারনে পাট সেভাবে বেড়ে উঠতে পারেনি। ৪ থকে ৫ ফুট হওয়ার সময় পাট গাছ মরে যাচ্ছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগী কৃষকরা।
কৃষকরা বলছেন, পোকার আক্রমণ ও আবাদি জমিতে লবণাক্ততা থেকে রক্ষা পেতে কৃষি বিভাগের পরমর্শ নির্দেশনা মানার পরও মিলছে না কোন সমাধান। ফলে এবছরেও অনেকটাই নিশ্চিত দাম ও ফলন বিপর্যয়ের কারনে পড়তে হবে লোকশানে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে মেহেরপুরের তিনটি উপজেলায় ১৬ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। এতে জেলায় এবছর ২লক্ষ ৪০ হাজার ৬৩৬ বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আগামও রোপনকৃত সব পাটই প্রায় মেচিওউর হয়ে গেছে তারপরও আবহাওয়া পরিবর্তনের কারনে এমনটি ঘটছে। এজন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
গাংনী উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের পাট চাষি হাবিবুর রহমান ও আব্দুল আলিম বলেন,এবছর পাট চাষ করে বিপদে পড়ে গেছি। শুরুর দিকে ছিলো প্রচন্ড রোদ সাথে ছিলোনা উপর বৃষ্টি। যার ফলে পাট উচ্চতায় এমনিতেই দেড় দুই ফিট কমে গেছে। সেচের জন্যও গুনতে হয়েছে বাড়তি খরচ। আর এখন শুরু হয়েছে তিড়িং পোকার আক্রমন ও পাটের জমিতে লবন ওঠে আসা। যে কারনে পাটের উৎপাদন তিন ভাগের এক ভাগই কমে যাবে।
নওয়াপাড়া গ্রামের পাট চাষি সাহাবুদ্দিন বলেন, এবার পাট চাষে খরচ বেশি হয়েছে। বিপরীতে পাটের অবস্থা তুলনামূলক খারাপ। তারপরও অধিক পরিচর্যার কারনে মাঠে থাকা পাট কোন মতে টিকে আছে। কম সময়ের মধ্যে পাট কাটা শুরু হয়ে যাবে। পানির অভাবে পাট কাটতে পারছিনা। এবছর ধলার বিল ও কাজলা নদীতেও পানি নেই। তাই পাট জমিতেই পড়ে আছে। এসময় মাটির নিচ থেকে লবণ বের হয়ে জমির অর্ধেক পাট মরে লাল হয়ে শুকাতে শুরু করেছে। সেচ দেয়া বলেন আর কিটনাশক প্রয়োগ করা। কত কিছুই না করলাম, তাতে কোন লাভ হয়নি। মধ্যে থেকে খরচ করাটাই লোকসান। গত বছরেও দাম না পেয়ে পাটের আবাদে লোকসান করেছি, এবার পাট চাষে করে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
মাইলমারি গ্রামের পাট চাষি আকবার আলী জানান, এমনিতেই বৃষ্টির অভাবে এবার পাট বুনতে একটু দেরি হয়েছে। তারপরে বেড়েছে কম। আর শেষ সময় পাটক্ষেতগুলোতে হানা দিয়েছে তিড়িং পোকায়। পাটের ডগা-কাণ্ড ও পাতা কেটে ফেলেছে পোকাগুলো। যার ফলে মাঠে এ পাট এখনো এক মাস থাকলেও কোন লাভ হবে না। মণ প্রতি ১০ থেকে ১২ কেজি করে ফলণ কমে যাবে। তারপর বতর্মান বাজারে আবার পাটের দাম কম। যেখানে এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করে ফসল ঘরে তুলতে প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হবে। সেখানে সমুলে পাট পাওয়া যাবে ১০ থেকে ১২ মণ। আমাদের অঞ্চলে পাটের দাম নেই। বর্তমানে প্রতিবেল কাচাঁ পাট বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা বেল। এতে উৎপাদনের অর্ধেক টাকাও উঠছেনা। যার ফলে এবছরেও পাট চাষে লোকশানে পড়তে হবে। পাট নিয়ে এমন হতাশার গল্প শোনান, ধলা গ্রামের ইদ্রিস আলী, সামসুল আলম, হান্নান আলীও মেছের মন্ডল। তারা জানান এমনটি চলতে থাকলে আর আগামীতে পাট চাষ করবেন না।
পাট ব্যাবসায়ী মহিবুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ১৯”শ থেকে ২ হাজার টাকা পযর্ন্ত। তাছাড়া বিশ্ব বাজারে পাটের চাহিদা কম থাকাই স্থানীয় বাজারে চাহিদা কমে গেছে পাটের। আমাদের জেলায় অধিকাংশ পাট ব্যাবসায়ীর গোডাউনেই রয়েছে পুরানো পাট। তার উপর আবার যদি নতুন পাট বাজারে আসে। এমনিতেই পাটের বতর্মান বাজারদর আরো কিছুটা কমে যাবে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের উপ পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, বর্তমানে জেলায় যে সকল জমিতে পাট কেটে আউশ ধানের আবাদ করা হয় সেসকল অধিকাংশ পাট প্রায় মেচিউর হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে পাট কাটা ও জাগ দেয়া শুরু হয়ে গেছে। এ শেষ সময়টিতে মাটির নিচ থেকে লবণাক্ততা বের হওয়ার কারনে অনেক জমির পাট মারা যাচ্ছে। আবার তিড়িং পোকায় পাটের পাতা ও ডোগা কাটছে। এ থেকে পাটকে রক্ষার জন্য জেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া এখন বৃষ্টির সময়, পর্যাপ্ত বৃষ্টি পাত হলে তিড়িং পোকার আক্রমণ ও লবণাক্ততার কারনে পাট মরে যাওয়ার হাত থেকে কৃষকরা রক্ষা পাবে। এছাড়াও পাটের জমিতেই একটি অংশে গর্ত করে সেখঅনে পাট পঁচনের ব্যবস্থা করতে চাষিদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।