মার্টিন কুপার সাহেব কী কাজটিই না করে গেছেন। আমাদের কালে তিনজন একসংগে থাকলেই হৈচৈ হতো আজ সেখানে তিরিশ জনের ঘরেও পিনপতন নীরবতা। হাতে মোবাইল, স্ক্রীনে চোখ, মনটা বিচরণ করছে ওয়েব দুনিয়ায়। এ দুনিয়া ভার্চুয়াল, বাস্তব থেকে অনেক দূরে। ঘোরলাগা জগতের মানুষ আজকাল ঘোরের মধ্যেই থাকে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই আজ ব্যবহার করছে স্মার্ট ফোন। একে প্রযুক্তিপ্রেমি বলা গেলেও বিজ্ঞান মনস্ক বলা যায় না। প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই মানুষ বিজ্ঞানমনষ্ক বা বিজ্ঞান সচেতন হয় না, তাকে সুশিক্ষিত হিসেবেও গন্য করা যায় না। একুশ শতকের অসম্ভবের সম্ভাবনার এই যুগে আমি এমন শিক্ষিত মানুষও দেখেছি যিনি চাঁদে মানুষ গেছে একথাটি বিশ্বাস করেন না। যে সমাজে শিক্ষার হার কম সে সমাজের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের মেহেরপুর এখনও কৃষিনির্ভর। প্রায় আট লক্ষ জনসংখা অধ্যুষিত মেহেরপুরে শিক্ষার হার ৬৭%। প্রকৃতপক্ষে এই হার আরও কম হবে। অর্থনৈতিক দিক থেকে অগ্রগতি হলেও শিক্ষায় বরাবরই পিছিয়ে আছি। তার মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষায় আরও পিছিয়ে। বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে মাধ্যমিকে মোট এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী ছিল ৪২.৮১ শতাংশ। এই হার কমতে কমতে ২০১৬ সালে ২৯.০৩ শতাংশে নেমে আসে। দু’বছর আগে দেখা গেছে, মাধ্যমিকে প্রায় ২২ শতাংশ ও উচ্চ-মাধ্যমিকে ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান পড়ছে। ২০২৪ সালে দেখা যাচ্ছে এসএসসিতে ২১.৮ শতাংশ এবং এইচএসসিতে ১৬.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান শাখায় পড়ছে। কারিগরী/বিএম শাখায় পড়ছে ১৮.৫ শতাংশ। স্পষ্টতই মেহেরপুরে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী দ্রুত কমছে। বিজ্ঞানের প্রতি এই অনাগ্রহ গ্রামাঞ্চলের স্কুল-কলেজগুলোতে আরও বেশি প্রকট।
২০২৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মেহেরপুর জেলায় বিজ্ঞান শাখায় পরীক্ষার্থী ছিল মাত্র ৬৮৯ জন। এদের মধ্যে পাস করেছে ৪৬৩ জন। অর্থ্যৎ পাসের হার ৬৭%। আর জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ৪৯জন। এইচএসসি এর সমমান কারিগরী/বিএম শাখায় পাসের হার ৭১.৯% এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে ১২ জন। তাহলে দেখা যাচ্ছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ বা গবেষক হওয়ার নিমিত্ত ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে এইচএসসি বিজ্ঞান ও কারিগরী শাখা থেকে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত মোট ৬১ জন এবং জিপিএ ৪ এর উপরে মুষ্টিমেয় আরও কয়েকজন। প্রচন্ড প্রতিযোগিতায় খুব অল্পসংখ্যকই যে টিকবে তা বলাই বাহুল্য। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা।
মেহেরপুর জেলায় বিজ্ঞান শিক্ষার হার নিয়ে আমি চিন্তিত। একসময় ১৪ বছর জেলা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমিটির আমি সেক্রেটারি ছিলাম। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে যা দেখেছি তা হচ্ছে-এক. শিক্ষার্থীদের অনীহা বা ভীতি; দুই. শিক্ষাদান প্রক্রিয়া; তিন. বিজ্ঞান শিক্ষার উপকরণ ও উপযোগী অবকাঠামোর অভাব; চার. উপযুক্ত যোগ্য শিক্ষকের অভাব; পাঁচ. সামাজিক সচেতনতার অভাব, ছয়. বিজ্ঞান শিক্ষাকে ব্যয়বহুল মনে করা, ইত্যাদি কারণে বিজ্ঞান শিক্ষার হার কমছে।
বিজ্ঞান মেলা আগে স্কুল-কলেজগুলোতে যেভাবে সাড়া ফেলতো এখন কিন্তু সেভাবে দেশের সর্বত্র হচ্ছে না। বছরে একবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ উদযাপন করা হয় বটে তবে তা পুরোটাই আমলানির্ভর-অনুষ্ঠানসর্বস্ব। সে আয়োজনে অব্যবস্থাপনা, সৃষ্টিশীলতার অভাব এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তি পর্যায়ে বা ছোট ছোট প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড বা অন্যান্য কাজ হচ্ছে কিন্তু দেশব্যাপী সরকারি পর্যায়ে বিজ্ঞান বিষয়কে সহজ, আনন্দময়, ব্যবহারিক চর্চা ও আকর্ষণীয় করার কোনো কর্মসূচি নেই । ফলে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে তরুণ প্রজন্ম।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য থেকে জানা যায় যে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ২৯ শতাংশে বিজ্ঞানাগার স্থাপন করা হয়নি। অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগার নেই। যেগুলোতে বিজ্ঞানাগার আছে, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিও আছে কিন্তু কেউ ব্যবহার করছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করতে করতে একেবারে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। প্র্যকটিক্যাল ক্লাস ছাড়াই যদি জিপিএ-৫ হয়ে যায় তাহলে শিক্ষার্থীরা ল্যাবরেটরিতে যাবে কেন?
একটি অঞ্চলে মেধার বিকাশ না হলে এর পরিণতি ভয়াবহ হয়। আমরা সেদিকেই ধাবিত হচ্ছি। একসময় হয়ত আমাদের ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা সৃষ্টি হবে না। অন্য জেলা বা অঞ্চলের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। তার ফল ভাল হবে না। সরকারি স্কুল-কলেজগুলোতে আমি দেখেছি বহিরাগত শিক্ষকেরা শুধুই চাকরী করেন, স্থানীয়রা চাকুরীর পাশাপাশি কিছুটা হলেও শিক্ষকতা করেন। স্কুল-কলেজে স্থানীয় শিক্ষকের সংখ্যা দিন দিন কমছে। স্বাস্থ্য বিভাগের বহিরাগত ডাক্তাররা চাকুরী করেন-পকেট স্ফীত করেন। কিন্তু আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা চাকুরীর পাশাপাশি চিকিৎসাসেবা দিয়ে মানুষকে সহায়তাও করেন। স্থানীয় হওয়ার কারণে তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত মানুষ থাকায় মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে মানুষকে নানাভাবে সেবা, সাহায্য ও সহযোগিতা করে থাকেন। তবে তাদের সংখ্যাও দিনে দিনে কমে আসছে। এমনটি সিভিল সার্ভিসের অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
১০/১৫ বছর আগেও দেখেছি প্রতি বছরই ২০/২৫ জন শিক্ষার্থীকে চিকিৎসা, প্রকৌশল বা বিজ্ঞান গবেষণা বা উচ্চ শিক্ষার কোন বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পেতে। কিন্তু এখন যা অবস্থা তাতে শংকিত না হয়ে পারছি না।
প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিষয়ে অতি সামান্য ধারণা লাভ করে। তাদের মধ্যে বিজ্ঞানমনষ্কতা তৈরি হয় মূলত মাধ্যমিক স্তরে গিয়ে। কিন্তু এ স্তরে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি অনাগ্রহ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিজ্ঞান শিক্ষায় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব ও পর্যাপ্ত ভৌতকাঠামো না থাকা একটি বড় কারণ। এশিয়া মহাদেশে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীনে বিজ্ঞানকে গুরুত্বসহকারে শেখানো হয়।
পৃথিবীর অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে পাঠিয়ে আনন্দের সাথে বিজ্ঞান পড়ানোর কৌশল অবলম্বন করা হয় যা আমাদের দেশে বেশি বেশি প্রয়োজন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একদিকে দেশপ্রেমের চর্চা হবে, অন্যদিকে অর্থ উপার্জন এবং সর্বোপরী শিক্ষা জীবনেই দেশের সমস্যা দূর করা ও দেশগঠনমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত করার সুযোগ পাবে। অবহেলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে উঠবে।
বিশ্বে চাকরির বাজার আগের চেয়ে অনেক দ্রুত বদলে যাচ্ছে এবং এখনকার অনেক চাকরির অস্তিত্ত্ব শিগগিরই অদৃশ্য হয়ে যাবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গবেষকরা বলছেন, আগামী পাঁচ বছরে বর্তমান চাকরির বাজার প্রায় এক-চতুর্থাংশ বদলে যাবে। এই পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হল নতুন প্রযুক্তির উত্থান বা অটোমেশন ।
বর্তমানে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়ন ও দ্রুত পরিবর্তনের সক্ষমতা বোঝাতে গিয়ে নিম্নোক্ত কথাটি স্মরণ করা যেতে পারে। “পাঁচ কোটি লোকের কাছে রেডিওর পৌঁছাতে সময় লেগেছে ৩৮ বছর, টেলিভিশনের ১৩ বছর। অথচ ইন্টারনেটের লেগেছে ৪ বছর। আইপডের জন্য সময়টা মাত্র ৩ বছর আর ফেসবুকের? মাত্র ২৪ মাস”। এরপর ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউটিউব ভিডিও প্ল্যাটফরম (YouTube) এর সময় লেগেছে ১৮ মাস এবং ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে এসেছে এ আই চ্যাটজিপিটি (ChatGPT) , যার ৫ কোটি লোকের কাছে পৌঁছাতে সময় লেগেছে মাত্র ১২ মাস। ‘কোডাক’ ক্যামেরা, মার্ফি রেডিও, এইচ এম টি ঘড়ি, এ্যাম্বাসেডর গাড়ি, প্রভৃতির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। একসময় দাপটের সাথেই এরা রাজত্ব করেছে। গুনে-মানে ভাল হলেও বছর বিশেকের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে গেছে। কারণ প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ এখন এক স্মার্ট ফোন দিয়েই দশ ডিভাইসের কাজ সারছে।
কারিগরি ও প্রযুক্তি জ্ঞান হল এমন এক প্রধান দক্ষতা যা নতুন চাকরির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিঁকে থাকার জন্য অবশ্যই অর্জন করতে হবে। এর অর্থ এই নয় যে প্রত্যেকেরই প্রোগ্রামিং ভাষা জানতে হবে বা মেশিন লার্নিং এর আদ্যোপান্ত সব বুঝতে হবে। বিবিসি বলছে- ভবিষ্যতে ‘স্টেম’ হবে চাকরির বাজারে প্রধান চাহিদা । ইংরেজি বর্ণমালার চারটি অক্ষর এস, টি, ই, এম – অর্থাৎ ‘স্টেম’ (STEM) এর পূর্ণ অর্থ হল সায়েন্স বা বিজ্ঞান, টেকনোলজি বা প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রকৌশল এবং ম্যাথম্যাটিকস বা গণিত। সুতরাং আপনি যদি ভাবেন আপনার সন্তানের স্কুলে কোন বিষয়গুলোয় ফোকাস করা উচিত, তাহলে এর উত্তর হবে: গণিত, কম্পিউটার সায়েন্স, এবং ন্যাচারাল সায়েন্সেস।
আমার মনে হয় আমাদের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা এমন সব গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি, ২০৩০ সালে সমাজে যাদের কোনো চাহিদাই থাকবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে; সৃজনশীলতা এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে হবে; শিক্ষাকে করতে হবে অ্যাকটিভিটিনির্ভর এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।
বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো নতুন নতুন প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি শ্রমবাজারে আমূল পরিবর্তন আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভাল খবর হল, নতুন প্রযুক্তি সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করবে। এতে একদিকে যেমন অনেক কর্মসংস্থানের খাত তৈরি হবে তেমন অনেক কর্মসংস্থান ধ্বংসও হয়ে যাবে। সুতরাং একটি ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে সফল হতে প্রতিনিয়ত নতুন দক্ষতা শিখে সক্ষমতা বাড়ানোর কোনও বিকল্প নেই।
বিজ্ঞান শিক্ষাকে আকর্ষনীয়, সহজবোধ্য ও জনপ্রিয় করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। কারণ বিশ্বায়ন ও বিজ্ঞানের এই যুগে বিজ্ঞান শিক্ষাকে আমরা কোনভাবেই অবহেলা করতে পারি না। বিজ্ঞান শিক্ষাকে অবহেলা করা মানে বিশ্বায়নের গতি থেকে ছিটকে পড়া। কাজেই ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট এবং এলাকার রাজনৈতিক, সামাজিক নেতৃত্ব-সকলের বিষয়টি গুরত্বসহকারে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ।