ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে উচ্ছ্বাস। ঈদ মানে উৎসব। আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা। প্রতি বছর ঈদ নতুন নতুন আবহ নিয়ে ফিরে এলেও পুরনো আবেশটা ঠিকই রয়ে যায় স্মৃতির পাতায়। আমি বাড়ি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মেহেরপুর জেলায়।
জন্ম সেখানে এবং বেড়ে উঠা সেখানে। স্মৃতিময় মেহেরপুরে কেমন কেটেছে চার দশক আগের ঈদের আনন্দের দিনগুলো? সে সম্পর্কে কিছু কথা আজকের আলোচনায় ঈদের সেই চিত্র তুলে ধরতে চাই।
আমার বাড়ি মেহেরপুরের বাসস্ট্যান্ড পাড়ায়। মেহেরপুরে সেসময়ে প্রধান ঈদের জামাত হতো দুটি। একটি পুরানো ঈদগাহ মাঠে (মেহেরপুর কলেজ ও পুরানো গোরস্থানের পাশে) এবং আরেকটি মেহেরপুর হাইস্কুলের পাশের মাঠে। এখন যেখানে মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ। এই মাঠে মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক ও সংসদ সদস্যসহ অন্যরা ঈদের নামাজ পড়তেন। বর্তমানে শহরের প্রধান জামাত হয় ওয়াপদা রোডের কাছে মেহেরপুর পৌর ঈদগাহ মাঠে।
সেসময় ঈদ উপলক্ষে আয়োজন করা হতো মেহেরপুরে ভৈরব নদে নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, হাডুডু ও ফুটবল খেলার। খুবই উৎসবমুখর ছিল বিবাহিত ও অবিবাহিতদের কাবাডি বা ফুটবল খেলার। গ্রামীণ সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব সংস্কৃতিও হারিয়ে গেছে অনেকটা। আমাদের সময়ে মেহেরপুরে জনপ্রিয় খেলা ছিল লাঠিখেলা ও হাডুডু। ঈদের দিন ও মহররমের দিনে হতো লাঠিখেলা ও হাডুডু।
পুরানো লোকদের মুখে শুনেছি লাঠিখেলা ও হাডুডু খেলা দেখতে হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে আসতো। পিপাসিত মানুষদের মিষ্টি পানি খাওয়ানোর জন্য কুয়াতে বস্তা ভর্তি চিনি দেয়া হতো। আর মানুষ সেই পানি উঠিয়ে তৃপ্তি সহকারে খেতো আর লাঠিখেলা ও হাডুডু খেলা দেখতো।
ছোটবেলায় আমরা ঈদের দিন ভোরে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা সুন্দর করে ঝাড়ু দিতাম। এটা আমাদের একটি পবিত্র দায়িত্ব মনে করতাম। ঈদগাহে যাওয়া লোকজন এই কাজের প্রশংসা করতেন এবং আমাদের জন্য দোয়া করতেন। সেসময়ে আমাদের এলাকায় একদল ছেলেরা সারা রোজার মাসে রাত দু‘টা থেকে লোকজনকে উঠানোর জন্য মাইকে গজল গাইতো এবং বলতো উঠন ভাই-বোনেরা সেহেরী খাওয়ার সময় হয়েছে। উঠুন।
একাত্তরের ঈদের কথা মনে পড়লে কষ্ট লাগে। আমার বড় চাচা শেখ নঈমউদ্দিনের পরিবার ছিলো ভারতের নদীয়ার বড় আন্দুলিয়া গ্রামে এবং আমার আব্বা মেহেরপুর শহর সংগ্রাম পরিষদের সদস্য রইসউদ্দিন শেখ তার পরিবার নিয়ে প্রথমে বাগোয়ানে ও পরে গাংনীর আজান গ্রামে অত্মগোপন করে ছিলো। সেসময়ে আমাদের ঈদের সময় কেটেছে আজান গ্রামে ।
সে সময়ে মেহেরপুরের অনেক মানুষ ভারতে শরনার্থী শিবিরে কষ্টের মধ্যে ঈদ উদযাপন করেছে। দেশ স্বাধীনের পর মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে।
মনে পড়ে, সেসময়ে আমার আব্বা খুব সকালে গরুর গোস্ত কিনতে যেতেন। নতুন সাবান দিয়ে গোসল করে নতুন পোশাক পরে সকলকে ডাকাডাকি করে দলবেঁধে জায়নামাজ ও বিছানোর চাদর নিয়ে ঈদগাহ মাঠে যেতাম এবং নামাজ শেষে কুলাকুলি করতাম। ঈদগাহ মাঠ থেকে ফেরার পথে পুরানো গোরস্থানে আমার দাদা রহেল শেখ ও তার বাবা থান্ডু শেখ এবং দাদিসহ অন্য সকল আত্মীয়দের জন্য দোয়া করতাম। মনে পড়ে ইমাম সাহেব বার বার বলতেন, আপনারা কবর জেয়ারত না করে কেউ বাড়ি যাবেন না।
ঈদের দিন কাটতো আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ঘুরে। মনে পড়ে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ঈদের দিনে একটি পাগলামি করেছিলাম। সেবার দল বেঁধে চুয়াডাঙ্গার রূপছায়া সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম।
ঈদের চাঁদ দেখা নিয়েও আনন্দ উৎসাহের শেষ ছিল না। চাঁদ দেখা গেলেই পাড়া-মহল্লায় চলত সবাইকে ঈদের খবর জানানোর মিছিল। চাঁদ রাতটা যেন কিছুতেই শেষ হতে চাইত না উত্তেজনায়। ঈদের দিন সকাল হলেই গোসল করে লুকিয়ে রাখা জামাটা পরতাম। প্রচলিত ধারণা ছিল ঈদের নতুন জামা কাউকে দেখানো যাবে না। কেউ আগেভাগে দেখে ফেললে যে আনন্দটাই মাটি! সেই সময়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য ঈদকার্ড ও নানা রকম ভিউকার্ডের প্রচলন ছিল। ঈদের দিন শিশু-কিশোররা মিলে নানা রকম স্টিকার, ভিউকার্ডের পসরা সাজিয়ে বসতেন।
এর মাধ্যমে দুই পয়সা লাভ নয় উদ্দেশ্য ছিল আনন্দ ভাগাভাগি করা। ঈদ মানেই একটু বাড়তি স্বাধীনতা। এইদিন বন্ধুদের সঙ্গে সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ালেও থাকত না বাবা-মায়ের চোখ রাঙানি। বন্ধুরা মিলে সালামির টাকা নিয়ে ভিড় জমাতাম খেলনার দোকানগুলোতে।
মনে পড়ে, আমার আব্বা ঈদের দিন সন্ধ্যায় সপরিবারে তার বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। ঈদের পরের দিন নানার বাড়ি মুজিবনগরের বাগোয়ান গ্রামে যেতাম। নানা-নানি ও মামাদের সাথে চমৎকার সময় কাটতো। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিলো না।
আমরা সাইকেলে চড়ে অথবা অনেক সময়ে পায়ে হেটে আশরাফপুরের ভিতর দিয়ে রসিকপুর হয়ে ভৈরব নদ পার হয়ে বাগোয়ান গ্রামে যেতাম। আমার নানা ফুলবাস শেখ জমিদার কেদারনাথ বাবুর কর্মচারি ছিলেন। যার নামে কেদারগঞ্জ হয়েছে। নানা ফুলবাস শেখের মুখে শুনেছি কেদারনাথ বাবুর মেয়ে রূপচর্চা করতে ডাবের পানি দিয়ে গোসল করতেন।
সেসময়ের ঈদের মজাই ছিলো আলাদা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই মজা যেন আর নেই। এখানকার ঈদ মানে অনেকের কাছে দায়িত্ববোধ ও আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তবে যারা প্রকৃত ধার্মিক হিসেবে নিজে গড়ে তুলেছেন তাদের কাছে ঈদের গুরুত্ব অন্য রকম। তারা এক মাস রোজা পালন করে ঈদের দিন প্রকৃত আনন্দ খঁজে পায়। আসুন আমরা ঈদের আদর্শকে ধারণ করি। ধর্মনুসারে জীবন যাপন করি এবং গরীব দুঃখিদের সাথে নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিই।
লেখক: সাপ্তহিক মুক্তিবাণীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক