উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা যেমন নিষ্পেষিত তেমনি রাষ্ট্র কর্তৃকও অবহেলিত দলিত সম্প্রদায়। বাংলাদেশের সংবিধান সকল নাগরিকের সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করলেও দলিত জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তার প্রয়োগে অনেক বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। জন্মগত ও পেশাগত কারণেই তাদের মূল জনস্রোত থেকে আলাদা করে রেখেছে। স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দলিত যুব সমাজের অংশগ্রহণ নাই বললেই চলে।
অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়ার ক্ষেত্রে দলিত যুবসমাজ মূল ধারার সাথে তাদের সম্পৃক্ত করতে পারেনা বা সম্পৃক্ত হতে দেওয়া হয় না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌর পরিষদের মত তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন উন্নয়ন কমিটি গুলোতেও দলিত যুব সমাজের কোন প্রতিনিধি থাকে না।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ভোটাধিকার প্রয়োগ, শিক্ষা গ্রহণ, চাকরি বা ব্যবসাসহ স্থায়ী ভাবে বসবাসের অধিকার থাকলেও অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী হয়ে বেঁচে থাকতে হয় দলিতদের। এই বৈষম্যের শিকার হয়ে দলিত যুব সমাজের মধ্যে এক ধরণের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কেউ বিপথে পা বাড়াই আবার কেউ উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখে। কেউ কেউ একত্র হয়ে নিজেদের গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে।
গাংনী উপজেলায় আছে একটি উন্নয়ন সংস্থা যার নাম ‘দলিত হরিজন উন্নয়ন সংস্থা’। সেখানে সভাপতি হিসেবে অশোক চন্দ্র বিশ্বাস এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাধন কুমার দাস নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
সভাপতি অশোক চন্দ্র বিশ্বাস জানান, হরিজনদের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তার মধ্যে-দলিত হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা, অল্প শিক্ষিতদের কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেওয়া, নিরক্ষরদের বিভিন্ন হাতের কাজ সেখানো ও তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করা, মহিলাদের বিভিন্ন কর্মমুখী শিক্ষা লভের সুযোগ করে দেওয়া, বাল্য বিবাহের সকল কুফল বর্ণনা ও রোধের ব্যবস্থা করা, সকলকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে সাহায্য করা, রাষ্ট্র প্রদত্ত বিভিন্ন রকমের সহায়তাগুলো কি এবং তা কি ভাবে কার মাধ্যমে পাওয়া যায় সে বিষয়ে ধারণা প্রদান করা, সামাজিক সমস্যার সমাধানের প্রশ্নে স্থানীয় মেম্বর চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে সমাধানের চেষ্টা করা, অসচ্ছল ছাত্র ছাত্রীদের আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা, শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং সর্বশেষ দলিত হরিচরণ পূর্ব পুরুষদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে উদ্বুদ্ধ করা ও সার্বিক সহয়তা প্রদান করা।
মেহেরপুরের সুইপার কলোনির ২৮ জন যুবক একত্র হয়ে তৈরি করেছে হরিজন বালক পূজা কমিটি। অজয় বাসফোর, সঞ্জয়, জয়, রঞ্জিত, দীপক, গোপি, রনি, রানা, জনি ভূঁইমালি, বিপ্লব, প্রদীপ, শাওন সুরেন, বলবীর, কার্তিক, বিশাল, কৃষ্ণা, জুয়েলসহ একঝাঁক যুবক এই সংগঠনের সাথে কাজ করছে। তারা অভিন্ন ভাবে জানান, এই কমিটির মাধ্যমে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকেন। নিজেদের মাসিক চাঁদা, বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান সংগ্রহ করে ফান্ড তৈরি করেছেন। এই ফান্ড থেকে তারা বাৎসরিক ভিত্তিতে লোন প্রদান করে থাকে। হাঁস, মুরগি, ছাগল পালন বাঁশের কাজের সাথে জড়িতদের ব্যবসায়ী উপকরণ ক্রয়সহ নানান কাজে উদ্যোক্তাদের এই ঋণ দেওয়া হয়। একই সাথে ডিজে(উঔ) ডান্স ক্লাব ও ডি (উ) স্টাইল ক্লাব নামে দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এর মাধ্যমে এক দিকে তাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ যেমন ঘটছে তেমনি বিভিন্ন স্থানে প্রোগ্রাম করে আর্থিক ভাবেও সুবিধা পাচ্ছে।
গাংনী উপজেলার বামন্দিতে রয়েছে “বামন্দি বেদ সম্প্রদায় হস্তশিল্প সমবায় সমিতি”। হরে কৃষ্ণ আদিবাসী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নান্টু কুমারের নেতৃত্বে চলছে এই সংগঠনটি। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিষয় নয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়েও কাজ করে সংগঠনটি। আনন্দ স্কুল পরিচালনা, মন্দির ভিত্তিক পাঠাগার নিয়েও বর্তমানে কাজ চলছে।
নাগরিক সমাজের বিভিন্ন জনের মত দলিত জনগোষ্ঠীর লোকায়িত ধর্ম গুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। উচ্চবর্ণের নিপীড়ন ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। বলরাম হাড়ি’র দর্শন কে ধারণ করতে হবে। যুবসমাজ উন্নয়নের একটি বড় শক্তি তা সে যে সম্পদায়েরই হোক না কেন। তাদেরকে সকল উন্নয়ন ভাবনায় যুক্ত করতে হবে।
স্থানীয় উন্নয়ন ভাবনায় দলিত যুব সমাজের অংশ গ্রহণ প্রশ্নে মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল আমিন (ধুমকেতু) বলেন, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের মূল ধারার সাথে সংযুক্ত করা। একই সাথে সিভিল সোসাইটির ব্যক্তিবর্গকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। উৎপাদনের মূলধারা কৃষি কাজে দলিত জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে।