মেহেরপুরে আবারও বেপোরোয়া করোনা। কয়েক মাস সাইলেন্ট থাকার পর যেন আবারও নবরুপে ভয়ঙ্কর হচ্ছে কোভিড-১৯। হু হু করে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। গত ২ সপ্তাহে শনাক্ত হয়েছে ৪৫জন করোনা রোগী।
যেখানে জানুয়ারিতে ছিল ১৫ জন, ফেব্রয়ারিতে ছিল মাত্র ১ জন তারপর থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত ছিল শূণ্য।
জেলা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য মতে গত ১৩ মার্চ থেকে এপর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪৫ জন। এদের মধ্যে সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৮ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছে ৩১ জন। এদের মধ্যে মেহেরপুর সদরে ২৩ জন ও গাংনীতে ৮ জন। গত বছর ২২ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে জেলায় প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। এর পর থেকে এপর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮০৯ জন। এদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে ১৭ জন, সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৭’শ জন ও অন্যত্র চলে গেছে ৬১ জন।
সারাদেশের তুলনায় মেহেরপুরের করোনার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে স্বাস্থ্যবিভাগ, পুলিশ, জেলা প্রসাশন। জনচলাচল সীমিত করার পাশাপাশি মাস্ক ব্যাবহার নিশ্চিতে কঠোর হচ্ছে প্রশাসন। সাথে কাজ করছে জেলা পুলিশের একাধিক দল। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে ফের মাইকিং করেছে শুরু করেছে পৌরসভাও। ভ্যাকসিন কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে।
মেহেরপুরে এ পর্যন্ত ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে ১৭ হাজার ৩’শ ৩৩ জন এবং রেজিস্ট্রেশন করেছে ২২ হাজারের উপরে। মেহেরপুরে টিকা এসেছে ১৯ হাজার ডোজ। বাকিগুলো ও দ্বিতীয় ডোজ টিকা কবে নাগাদ আসবে সে বিষয়ে কোন তথ্য নেই সিভিল সার্জন অফিসে।
এদিকে, দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পুনরায় বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব অফিস ও কারখানা অর্ধেক জনবল দ্বারা পরিচালনা, উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা, জনসমাগম সীমিত করা, গণপরিবহনে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনসহ ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি পুনরায় প্রস্তুত হচ্ছে মেহেরপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল। ২৪ ঘন্টা নিরবিছিন্ন অক্সিজেন সরবারাহের জন্য নতুন করে অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপনের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে ৩টি ভেন্টিলেটর।
করোনার যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলার সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি উল্লেখ করে হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, করোনা রোগীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে অলাদা ওয়ার্ড করা হয়েছে। আমরা সার্বক্ষনিক করোনা আক্রান্তদের শতভাগ চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
মেহেরপুর সিভিল সার্জন ডা. নাসির উদ্দিন জানান, হঠাৎ করেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের সবাইকে করোনা প্রতিরোধে সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। টিকা এসেছে বলে আত্মতুষ্টিতে ভোগা যাবে না। করোনা মহামারি প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে।
করোনা প্রতিরোধে জেলা পুলিশের কর্মকান্ড নিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) জামিরুল ইসলাম বলেন, করোনার শুরু থেকেই প্রতিরোধে কাজ করছে পুলিশ। পুলিশ সুপারের নির্দেশে সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পুলিশের একাধিক দল মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। মাস্ক বিতরণ, জনসমাবেশ নিয়ন্ত্রন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনসাধারণকে তাগাদা দিচ্ছে।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ মুনসুর আলম খান বলেন, করোনা প্রতিরোধে আবারও আমরা জনসচেতনতার ওপর জোর দিচ্ছি। ১৮ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে জেলা প্রশাসনের একাধিক টিম। সেই সাথে জনসাধারণকে নিজে থেকেই সচেতন হতে হবে, পাশাপাশি করোনা প্রতিরোধে গণমাধ্যমকর্মীরা আগে যেভাবে সহযোগীতা করেছে এবারো তাদের সহযোগীতা নিয়ে মেহেরপুরের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবো।
করোনার এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করাটাও এখন বড় চেলেঞ্জ। নতুন করে সব কিছু সীমিত করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। বাসে যাত্রি অর্ধেক করা, জনসমাবেশ নিষিদ্ধ, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অর্ধেক জনবল ইত্যাদি পুনরায় চালু করা যেন প্রশাসন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর জন্য কঠিন।
সরকারি ১৮টি নির্দেশনাগুলো হলো:
১. সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ যেকোনো উপলক্ষে জনসমাগম সীমিত করার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে উচ্চ সংক্রমণ এলাকায় জনসমাগম নিষিদ্ধ থাকবে।
২. মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।
৩. পর্যটন, বিনোদন কেন্দ্র, সিনেমা হল, থিয়েটার হলে জনসমাগম সীমিত করতে হবে এবং সব ধরনের মেলা আয়োজন নিরুৎসাহিত করা হবে।
৪. গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং ধারণক্ষমতার অর্ধেকের বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না।
৫. সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আন্তজেলা যান চলাচল সীমিত করতে হবে, প্রয়োজনে বন্ধ করতে হবে।
৬. বিদেশফেরত যাত্রীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে।
৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী খোলা ও উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেচাকেনা করতে হবে।
৮. স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে।
৯. শপিং মলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বাধ্যতামূলক।
১০. দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে।
১১. অপ্রয়োজনে রাত ১০টার পর ঘর থেকে বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
১২. প্রয়োজনে বাইরে গেলে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে মাস্ক না পরলে বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১৩. করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা করোনার লক্ষণ রয়েছে এমন ব্যক্তির আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা অন্যদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে।
১৪. জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস, প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা ৫০ শতাংশ লোকবল দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা, অসুস্থ, ৫৫ বছরের অধিক বয়সী ব্যক্তিদের বাসায় থেকে কাজের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৫. সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ, কর্মশালা যথাসম্ভব অনলাইনে আয়োজন করতে হবে।
১৬. সশরীরে উপস্থিত হতে হয় এমন যেকোনো ধরনের গণপরীক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে।
১৭. হোটেল, রেস্তোরাঁয় ধারণক্ষমতার অর্ধেক মানুষ প্রবেশ করতে পারবে।
১৮. কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ ও অবস্থানের পুরোটা সময়ই বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।