কাঠ ফাটা রোদ আর ভয়ানক গরমে পুড়ছে মেহেরপুর জেলার মানুষ। প্রচন্ড দাবদাহে নাভিশ্বাস উঠেছে প্রাণীকুলেও। এই পরিস্থিতিতে ফ্যানের বাতাসও গরম হয়ে পড়ছে। ফলে ঘরের ভেতরেও টেকা দায়। প্রকৃতির রুদ্ররূপে দুঃসহ জীবনযাপন করছে মানুষ। সব মিলে ওষ্ঠাগত প্রাণ। কয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টি না হলে জনজীবন আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।
মৌসুমের এই তাপদাহ আগামী ঈদের আগে কমার লক্ষণ নেই বলেই জানালো চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক আবহাওয়া অধিদপ্তর।
গতকাল শনিবার বিকাল ৩ টার সময় চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিস মেহেরপুরের তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবং বাতাসের আর্দতা রেকর্ড করেছে ১৬ শতাংস। এটাই চলতি মৌসুমে দেশের সর্ব্বোচ্চ তাপমাত্রা বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অফিস।
চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান বলেন, ঈদের আগ পর্যন্ত আবহাওয়া পরিবর্তণের কোনো লক্ষণ নেই। একই আবহাওয়া বিরাজ করতে পারে। তবে, কয়েকদিন পর একটু একটুু করে গরম কমতে পারে।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত কোনো এলাকার তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হলে সেখানে মৃদু দাবদাহ শুরু হয়। এটি ৩৮ ডিগ্রি পার হলে তা পরিণত হয় মাঝারি দাবদাহে। আর ৪০ ডিগ্রি পার হলে সেটাকে তীব্র দাবদাহ বলা হয়। যদি ৪২ ডিগ্রি পার হয়, সেটা অতি তীব্র দাবদাহে রূপ নেয়। শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা মেহেরপুরে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এই গরমে দিন মজুর শ্রমিক, হতদরিদ্র রিকশাচালক, শ্রমজীবি থেকে শুরু করে পথচারি কেউই বাদ নেই; হাসফাঁস করছেন সবাই। এ অবস্থায় মেহেরপুরের খেটে খাওয়া মানুষের ত্রাহিদশা।
স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তীব্র গরমে ফুটপাতের ভ্রাম্যমান লেবু ও আখের শরবতের দোকানগুলোতে ব্যাপক ভিড় লক্ষ করা গেছে।
গাংনী বাজারের পাখি ভ্যান চালক, আব্দুর রহিম বলেন, ১০/১২ দিন থেকে ভ্যাপসা গরমে ঠিকমত ভ্যান চালাতে পারছিনা। বার বার পানি ও শরবত খাচ্ছি। খুব কষ্ট হচ্ছে এই গরমে ভ্যান চালাতে।
পাখি ভ্যান চালক মিন্টু হোসেন বলেন, মানুষ বাইরে বের হচ্ছেনা। তাই ভাড়াও হচ্ছেনা। সারাদিন অনেক কষ্ট করে ভাড়া মারলেও দিন শেষে হাট বাজার করার টাকা মিলছেনা।
দিনমজুর কুবাদ শেখ বলেন, সকাল ১০ টা বাজলেই শুরু হচ্ছে অসহ্য গরম। এই গরমে কাজ করতে গেলে শরীর ঘামে ভীজে যাচ্ছে। বাজারে খুব লোকজন নেই। তাই কাজও পাচ্ছিনা।
সাহারবাটি গ্রামের ইঞ্জিন চালিত আলগামন চালক শরীফুল ইসলাম বলেন, এলাকার সবজী নিয়ে যায় মেহেরপুর কাঁচা মালের আড়তে। রাস্তার দুধারে আগে গাছ গাছালি ছিল। গাছ গাছালির ছায়ায় ঠান্ডায় ঠান্ডায় যেতে পারতাম। এখন রাস্তার দুপাশের সেই বড় বড় গাছ কেটে ফেলায় ওই রাস্তায় এক ধরণের ভাপ উঠছে। কোথাও দাড়ানোর কোনো অবস্থা নেই। মনে হচ্ছে মুখে আগুনের ফুলকি এসে লাগছে।
বাওট গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান বলেন, ভ্যানে করে মাছ ফেরি করে গ্রামে বিক্রি করি। টানা ভ্যাপসা গরমে জীবন যায় যায় অবস্থা। কোথাও একটু দাড়ানোর অবস্থা নেই। প্রচন্ড গরম থেকে রক্ষা পেতে পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে শরীর ভিজিয়ে ঠান্ডা করছি বারবার।
গাংনী উপজেলা পরিষদের মধ্যে আমবাগানের মধ্যে দেখা গেছে প্রচন্ড গরম থেকে বাঁচতে মানুষ গাছের ছায়ায় বসে প্রাণ জুড়াচ্ছে।
জেলার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা যায়, শিশুরা পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছে শরীর। শুধু মানুষ নয়, কুকুর ও পাখিরাও অল্প পানিতে শরীর জুড়িয়ে নিচ্ছে।
মেহেরপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাক্তার মকলেচুর রহমান বলেন, গরমের কারণে হাসপাতালে বেড়েছে ডাইরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। মেহেরপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে ৩৮৬ জন ডাইরিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্েরর আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাক্তার মারুফ বলেন, রোজাদারদের সেহরি ও ইফতারিতে বেশি করে পানি ও সরবত পান করতে হবে। যারা রোজাদার নন, তাদেরকে বেশি বেশি পানি ও রসালো ফল খাওায়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এছাড়া প্রচন্ড গরমে প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডাক্তার জমির মোহাম্মদ হাসিবুস সাত্তার বলেন, এই গরমে বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ। দাবদাহে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া পানিশূন্যতা থেকে ডায়রিয়াসহ টাইফয়েড ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। এমন অবস্থায় বিশুদ্ধ পানি পানের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এদিকে, চুয়াডাঙ্গাতেও তীব্র দাবদহে জ্বলছে জেলার মানুষ। শরীরে লাগছে ঝলসানো রোদের তাপ। দুপুর হতেই প্রয়োজন বিহীন কেউ বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। দাবদহের কারণে পিচ ঢালা রাস্তায়ও ধরেছে গলণ। টানা ১৪ দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। গতকাল শনিবার দুপুর ৩টায় চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা বেঁড়ে দাড়ায় ৪২.২ ডিগ্রি। তাপদহে ফসলের মাঠ ফেটে চৌঁচির । রোজাদার মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। প্রতিদিন এজেলায় গড়ে ১ ডিগ্রি করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা আবহাওয়া অফিস জানায়, চলতি মৌসুমেগতকাল শনিবার দেশের তীব্র সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। আগামি কয়েকদিন এই তাপমাত্রা অব্যাহত থাকবে। দ্রূত তাপমাত্রা কমা কিংবা বৃষ্টির পূর্বাভাস নেই। গতকাল শনিবার বেলা ৩টায় চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২.২ ডিগ্রি। বাতাসের আদ্রতা ১৬ শতাংশ। গত শুক্রবার এ-জেলায় ৪১.৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
এক টানা তীব্র দাবদহের কারণে রোজাদার মানুষেরা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এতে অনেকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। কৃষি জমিতে পানির অভাবে দেখা দিয়েছে ফাটল। এছাড়াও চলতি বোরো মৌসুমে ধান কাটতে পারছে না কৃষকেরা।
জেলার প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের সিনিয়র পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান জানান, চলতি মৌসুম গতকাল শনিবার বেলা ৩ টায় জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২.২ ডিগ্রি। শুক্রবার রেকর্ড করা হয়েছে ৪১.৭ ডিগ্রি। চলতি সপ্তাহেই তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি পাবার সম্ভবনার কথা জানান।