মেহেরপুর জেলা সমবায় কর্মকর্তা প্রভাস চন্দ্র বালার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ভুয়া বিল ভাউচারসহ অফিসের অধিক মূল্যে কম্পিউটার ও আসবাবপত্র ক্রয়সহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
সরকারি নিয়মনীতি ভঙ্গ করে অফিসের অন্যান্য স্টাফদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দিনের পর দিন অনিয়ম আর দুর্নীতি করে যাচ্ছেন জেলা সমবায় কর্মকর্তা।
প্রভাস চন্দ্র বালা দিনের পর দিন শুধূ অনিয়ম ও দুনীতিই নয়, নিজেকে জেলা কর্মকর্তা পরিচয়ের চেয়ে দলীয় পরিচয় দিতেই বেশী স্বাচ্ছন্দবোধ করে থাকেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রভাস চন্দ্র বালা মেহেরপুর জেলা সমবায় কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। জেলা কর্মকর্তার দায়িত্ব নেবার পর থেকেই সমবায় সমিতি অনুমোদনে উৎকোচ গ্রহণ, কম্পিউটার না কিনেই ভূঁয়া বিল ভাউচার করে অর্থ আত্মসাৎ, আসবাবপত্র ও কম্পিউটার মেরামত না করে ভূঁয়া বিল ভাউচার, প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতা না দিয়ে লক্ষ-লক্ষ টাকা আত্নসাতের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
অফিস সূত্র জানিয়েছে, ২০২১-২০২২ অর্র্থ বছরে কম্পিউটারের টোনার ক্রয় বাবদ ২৫ হাজার টাকা, কম্পিউটার মেরামত বাবদ ৪০ হাজার টাকা, আবাবপত্র ক্রয় বাবদ ৬০ হাজার, আসবাবপত্র মেরামত বাবদ ৩৫ হাজার টাকা, কম্পিউটার ক্রয় বাবাদ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা, মনোহরি বাবদ ১ লাখ ৬০ হাজার, ইন্টারনেট বিল বাবদ ৩৫ হাজার টাকা, উদ্ভাবনী বাবদ ৪২ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণ বাবদ ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা, অন্যান্য মেরামত বাবদ ১৫ হাজার টাকাসহ মোট ৯ লাখ ৭২ হাজার টাকার বিল ভাউচার দাখিল করেছেন।
২০২২-২৩ অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে সে ইন্টারনেট বিল বাবদ ১৫ হাজার টাকা, কম্পিউটারের টোনার বাবদ ২০ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণ বাবদ ৪৫ হাজার টাকা, অন্যান্য মনোহরি বাবদ ১৫ হাজার টাকা, আসবাবপত্র মেরামত বাবদ ১৫ হাজার টাকা, কম্পিউটার মেরামত বাবাদ ১৫ হাজার টাকা, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদ ১৫ হাজার টাকা, অফিস সরঞ্জাম বাবদ ৫০ হাজার টাকা ও আসবাবপত্র ক্রয় বাবদ ২৫ হাজার টাকা বীল ভাউচার করে মোট ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
একটি সূত্র মতে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটে ৩ টি মডেম না কিনেও বীল ভাউছার করা হেেছ। কর্মকর্তা কর্মচারীদের টেবিলের গ্লাস ৩ বার কেনার ভূঁয়া বীল ভাউচার, নিম্নমানের একটা কোর আই থ্রী ডেক্সটপ, ১ টা ল্যাপটপ কিনে দাম দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অথচ, সেখানে কেনা হয়েছে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা মুল্যের দুটি নিম্ন মানের কম্পিউটার। উদ্ভাবনী বিষয়ে কোনো কিছু না করেই পকেটস্থ করা হয়েছে ৪২ হাজার টাকা।
ক্ষুদ্র সমবায়ীদের ২ দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হলেও দুই দিনের যায়গায় মাত্র একদিনের খাবার দেওয়া হয়েছে। জনপ্রতি ৫ শ টাকা করে খাবার দেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে দেওয়া হয়েছে ২০০ টাকা মূল্যের নিম্নমানের খাবার। অন্যান্য মনোহরি খাতের পুরো অর্থই আত্মসাৎ করেছে বলে জানিয়েছেন অফিসের একটি সূত্র। ওই সূত্রটি জানান, ৬০ হাজার টাকা মূল্যের নিম্নমানের আসবাবপত্র ক্রয় দেখিয়ে আবার সেই আসবাবপত্র একই বছরে মেরামত বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। অফিসের সামনে একটি বাগান রয়েছে বাঁশের রেলিং দিয়ে ঘেরা। ওই ফুলবাগানে কয়েকটি কুকুরশোঁকা ও পাতাবাহার ফুল গাছ আছে। সেই বাগানের পরিচর্যা বাবদ মোটা অংকের ব্যায় দেখানো হয়েছে।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা প্রভাস চন্দ্র বালার কাছে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রশ্নের জবাবে বলেন, কি কি বিষয়ে জানতে চান আমার কাছে দিয়ে যান আমি দেখে তারপর জবাবগুলো দেবো।
বদলী এবং শাস্তির ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অফিসের একাধিক স্টাফ জানান, স্যার এখানে যোগদানের পর থেকে অফিসটাকে দুর্নীতী ও অনিয়মের আখড়া বানিয়ে ফেলেছেন। তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে গেলে তিনি খোঁজ নেন এই কর্মকর্তা বা কর্মচারী আগে কোন রাজনীতি করতেন এবং এখন কোন রাজনীতি করেন। তার কথার বাইরে কোনো কিছু বলতে গেলেই তাকে জামায়াত বিএনপি বানিয়ে মানুষিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এছাড়া নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়।
সূত্র মতে জানা গেছে, অফিসের আসবাবপত্র একবার ক্রয় করে সেই আসবাবপত্র তিনবার ক্রয় দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে ভাতা দেওয়া হয়নি। এছাড়া প্রশিক্ষনার্থীদের খাবার দেওয়া হয়েছে অতি নিম্নমানের বলে অভিযোগ উঠেছে। এবিষয়ে তিনি বলেছেন এই অভিযোগ সঠিক নয়। আমি অফিসে রান্না করে তাদের খাইয়েছি। প্রশিক্ষণার্থীদের খাবারের জন্য ৫০০ টাকা বরাদ্দ থাকলেও সেখানে দেড় থেকে ২০০ টাকার খাবার দেওয়া হয়েছে। খাবারের বাকী টাকা প্রভাস চন্দ্র বালা পকেটস্থ করেছেন।
প্রভাস চন্দ্র বালা শুধু দুর্নীতিতেই পটু নয়, তার বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়মের পাহাড়। সমবায়ীদের ২৫ জন সদস্যের ৫ দিনের আইজিএ এর আওতায় ৩ টি প্রশিক্ষণ হলেও বাদ দেওয়া হয়েছে গাংনী উপজেলাকে। প্রশিক্ষণগুলোতে কোর্স পরিচালক, কোর্স সমন্বয়কারী ও বক্তা এই তিন ব্যক্তি আলাদা আলাদা হওয়ার কথা থাকলেও জেলা সমবায় আফিসার নিজেই অনিয়ম করে দায়ীত্ব পালন করেন এবং তিন বিষয়ের সম্মানিভাতা একাই গ্রহণ করেন।
জাতীয় শুদ্ধাচার পুরুস্কার প্রদান নীতিমালা ২০২১ অনুযায়ী জেলা সমবায় কার্যালয়ে কর্মচারীদের মধ্যে ২ জন ও জেলাধীন উপজেলা সমবায় উপজেলা সমবায় অফিসারদের মধ্যে থেকে একজনকে জাতীয় শুদ্ধাচার চর্চার পুরস্কার প্রদানের বিধান থাকলেও তিনি এই বিধান অমান্য করেন। তিনি তিনজনের পরিবর্তে দুজনকে এই পুরুস্কার প্রদান করেন। জেলা সমবায় কার্যালয়ের সহকারী প্রশিক্ষক রোকনুজ্জামান ও অফিস সহায়ক শাহিন আহমেদকে এই পুরুস্কারে ভূষিত করেন। কোনো কর্মচারীর নুন্যতম ৮০ নং না পেলে এই পুরুস্কারের জন্য বিবেচিত হবেনা না। ৮০ নং না পাওয়ার খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে তিন উপজেলার অফিসারদের এই পুরুস্কার থেকে বঞ্চিত করেছেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি মৎস্য সমবায় সমিতি লিঃ এর সভাপতি বলেন, জেলা সমবায় কর্মকর্তা প্রভাস চন্দ্র বালা সমবায় সমিতি অনুমোদন নিতে কমপক্ষে ৫হাজার হতে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নেন। যার কাছে যেমন পান তেমন টাকা নেন। অর্থাৎ টাকা ছাড়া সেবা মেলেনা এ অফিসে।
গাংনীর কুমারীডাঙ্গা মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির সভাপতি কামাল হোসেন জানান, জেলা সমবায় কর্মকর্তার দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট। আমাদের মাঝে মাঝে অফিসে প্রশিক্ষণের নামে ডাকে। সেখানে গেলে আমাদের কাছ থেকে ১শ, ২শ টাকা নিয়ে আমাদের নাস্তা দেই। অফিসে কি আমাদের জন্য নাস্তাও থাকেনা। প্রশ্ন করেন তিনি।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, গাংনী উপজেলা শিক্ষক কর্মচারী কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি: এঁর ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচন ২২ উপলক্ষে সংগঠনটির আবেদন অনুযায়ী গাংনী উপজেলা কর্মকর্তা জেলা কর্মকর্তাকে আবেদনটি ফরোয়ার্ড করেন। জেলা কর্মকর্তা উপজেলা কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি অনুমোদন করে চিঠি পাঠান। অথচ, ফেমাস সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লি: নামের একটি সংগঠনের ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্বাচন ২০২২ উপলক্ষে সমবায় অফিসের কারোর নাম উল্লেখ না করে ওই সংগঠনের তিন সদস্যের তালিকা দিয়ে আবেদন করেন। সদর উপজেলা কর্মকর্তা সেটি যাচাই বাছাই না করেই ফরোয়াডিং করেন জেলা কার্যালয়ে। জেলা অফিসার প্রভাস চন্দ্র বালা সেই কমিটি অনুমোদন করেন। উল্লেখ্য, ফেমাস সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতিটি শিবির পরিচালিত একটি সংগঠণ। এতদ্বসত্তেও এই নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা কমিটি জেলা কর্মকর্তাকে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে পাশ করেছেন বলে জানা গেছে।
দুর্নীতি এবং অনিয়ম প্রসঙ্গে জেলা সমবায় কর্মকর্তা প্রভাস চন্দ্র বালা তেমন কোনো সদ্দুত্তর দিতে পারেননি। কিছু অনিয়ম হতে পারে বলে তিনি স্বীকার করেন। ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে ক্ষতিয়ে দেখবেন বলে সময় চান। তার কথাতে কিভাবে সাংবাদিকদের ম্যানেজ করা যায় সে বিষয়টিই ফুটে ওঠে।
এ ব্যাপারে বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ের যুগ্ম নিবন্ধক মিজানুর রহমান বলেন, এসব তথ্য আমার জানা ছিলনা। বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য পেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।