মেহেরপুরের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। যে অফিসের নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে উপ-সহকারী পরিচালক সকলে ঘুষ ছাড়া যেন কিছুই বোঝেন না। নতুন পাসপোর্ট কিংবা নবায়ন, সকল পাসপোর্ট আবেদনকারীর থেকেই নেওয়া হয় ঘুষ। আর সব কিছুর মূল নিয়ন্ত্রক পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো: বিপ্লব হোসেন। দীর্ঘ ৯ বছর মেহেরপুর পাসপোর্ট অফিস কর্মরত থাকায় সে মুকুটহীন বসে পরিণত হয়েছেন।
উপ-সহকারী পরিচালক জাকির হোসেনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগীতায় বিপ্লব হোসেন এ কাজগুলো করে থাকেন। এমনটিই বলেছেন পাসপোর্ট করতে আসা কয়েকজন সেবা গ্রহীতা।
গতকাল বুধবার ১০ (আগষ্ট) মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে মেহেরপুরে প্রতিদিনের একটি টিম দুই ঘন্টার অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে, উপ-সহ পরিচালক জাকির হোসেন সাংবাদিকদের এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নিজেই এডিসি’র মোবাইল ফোনে কল দিয়ে বলেন আমাকে এখনি এডিসির সাথে দেখা করতে যেতে বলছেন বলে তিনি অফিস থেকে চলে যান।
মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস সূত্র জানায়, গত জুলাই মাসে ১৬১৮ টি ও চলতি আগষ্ট মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত ৮৪৭ টি পাসপোর্ট আবেদন করেছে। এসব আবেদনরে মধ্যে ৩০ শতাংশই পুরানো পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন। সে হিসেবে ধারণা করা যায় প্রতি মাসে কোটি টাকার উপরে এখানে গ্রাহকদের কাছে ঘুষ নিয়ে ভাগবাটোয়ারা করা হয়।
সদর উপজেলার আশরাফপুর গ্রামের দুলু হোসেনে বলেন, আমার ছেলের পাসপোর্ট করতে দিয়েছি। সকালের দিকে বিপ্লব স্যারের কাছে আবেদন জমা দিয়েছি। আবারো কয়েকদিন পর আসতে হবে। তাই বিপ্লব স্যারের সাথে দেড় হাজার টাকায় চুক্তি হয়েছে। আজকেই ফিঙ্গার করে দেবে।
একই কথা জানালেন, আমঝুপি গ্রামের সোহান। তিনি বলেন, সকালের দিকে বিপ্লব স্যারকে যারা একটু টাকা বেশী দিয়েছেন তাদের সকাল সকাল ফিঙ্গার প্রিন্ট করে দিয়েছেন। আমি প্রথমে দিতে চাইনি। পরে এখানকার একজন দালাল বললেন বিপ্লব স্যারের সাথে চুক্তি না করলে ঘুরে ঘুরেও ফিঙ্গার প্রিন্ট হবেনা।
এদিকে আরেক ভুক্তভোগী গাংনী উপজেলার জিয়া। তিনি বলেন, সকালে আবেদন জমা দিতে এসেই অফিসের গেটের আনসার সদস্য বলেন, এক হাজার টাকা দিয়ে আবেদন জমা দিতে হবে। না হলে জীবনেও আপনি পাসপোর্ট পাবেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিচ্ছন্নতাকর্মী বিপ্লব হোসেনের ইশারা ছাড়া নড়ে না পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের আবেদনপত্রের ফাইল। বিপ্লব হোসনের “ওকে” থাকলেই আবেদন ফাইল উপ-সহপরিচালক জাকির হোসেন দ্রুত গতিতে স্বাক্ষর করেন। আর এজন্য প্রতি আবেদন ফাইলে নেওয়া হয় দেড় হাজার ১০ হাজার টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। এমন অভিযোগ পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের। তারা বলেছেন, নতুন আবেদনকারীর কাছ থেকে দেড় হাজার থেকে শুরু করে ৪/৫ হাজার টাকা নেন। পুরানো পাসপোর্ট নবায়ন করতে এলে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ও নাম ও বয়স সংশোধনী করতে এলে তাদের কাছ থেকে ৪০ থেকে ৮০ হাজ্রা টাকা অতিরিক্ত নিয়ে থাকেন বিপ্লব হোসেন।
তবে পরিচ্ছন্নকর্মী বিপ্লব হোসেন বলেছেন, এই টাকার ভাগ আমার একার নয়। ঢাকা অফিস পর্যন্ত দিতে হয় আমাকে। পরিচ্ছন্ন কর্মী বিপ্লব হোসেনের মাধ্যমে এভাবেই প্রতিদিন শত শত পাসপোর্ট আবেদন থেকে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটি এখন ঘুষ ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
পাসপোর্ট করতে আসা কয়েকজন আবেদনকারী জানান, যেসব আবেদনপত্রের ফাইলে বিপ্লব হোসেনের কোনো “ওকে” থাকে না সেসব ফাইল বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ফেরত দেওয়া হয়। অন্যদিকে সব নিয়ম মেনে পাসপোর্ট আবেদন করেপাসপোর্ট প্রাপ্তির তারিখ অতিবাহিত হলেও পাসপোর্ট আবেদনকারীরা মাসের পর মাস ঘুরেওতাদের পাসপোর্ট পায়নি বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
এমনি এক ভূক্তভোগী মেহেরপুর সদর উপজেলার ময়মারিগ্রামের ইউনুস আলীর ছেলে মিয়ারুল ইসলাম। তিনি জানান, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পাসপোর্ট নবায়ন করতে দিয়েছি। প্রায় চার মাস আমাকে ঘুরাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি ইজিবাইক চালক। মালয়েশিয়া কলিং খোলায় আমি পাসপোর্ট করতে আসি। এই অফিসে এসেই অফিসারের রুমে গেলে তিনি বিপ্লব স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। আমি বিপ্লব স্যারের সাথে যোগাযোগ করলে সে আমার আবেদনপত্রটি জমা করে নেন। কয়েকদিন পর খোঁজ নিলে সে বলে এটি ঠিক করতে ৪০ হাজার টাকা লাগবে। আপনার আবেদনে অনেক সমস্যা আছে। আমি তাকে টাকা দিতে চাইনি। সে আমাকে এত পরিমান ঘুরিয়েছে। এই অফিসে ঘুরতে ঘুরতে আমার পায়ের স্যান্ডেল ও জামা ছিড়েগেছে। কিন্তু আমাকে পাসপোর্টের কোনো তথ্য বিপ্লব স্যার এখনো দেইনি। এসময় মিয়ারুলকে বারবার থামানোর চেষ্টা করছিলেন উপ-সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন।
আরেক ভূক্তভোগী গাংনী উপজেলার শিশিরপাড়া গ্রামের মোস্তাক হোসেন। তার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা দাবী করে না পেয়ে তাকে শুধু ঘুরিয়েছেতা নয়। অবশেষে বলেছে বিপ্লব হোসেন বলেছেন, আমি পাসপোর্ট করে না দিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও করে দিতে পারবেনা। চলতি বছরের ১১ এপ্রিল নাম ও জন্ম তারিখ সংশোধনী দিয়ে পাসপোর্ট নবায়ন করতে দেন মোস্তাক হোসেন।
মোস্তাক হোসেন বলেন, ওই সময় একটি দেশ থেকে আমার একটি ভিসা এসেছিল। আমি তাকে বলেছিলাম আমার ভিসা হয়ে গেছে। একটু জরুরী ভিত্তিত্বে করতে হলে কি করতে হবে, যদি পরামর্শ দিতেন। বিপ্লব আমার কাছে জানতে চান ভিসা লাগাতে কত দিয়েছেন। আমি সরলভাবে উত্তর দিয়েছিলাম, দেড় লাখ। একথা শুনে বিপ্লব স্যার আমাকে বলেন ওখানে দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন। এই অফিসে ৮০ হাজার টাকা দিতে হবে। তার সেই দাবী পুরণ না করাই প্রায় ৪ মাস আমাকে ঘুরাচ্ছে বিপ্লব। আমি মেহেরপুর পুলিশ সুপারকে ও সাংবাদিক সম্মেলন করবো বলে জানালে সে ফোনে আমাকে সরাসরি হুমকীও দেই।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, বিপ্লব হোসেন পরিচ্ছন্ন কর্মী পদে এই পাসপোর্ট অফিসে ২৮/০৫/২০১৩ সালে যোগদান করেন। সে সর্বসাকুল্যে ১৬ হাজার টাকা বেতনে চাকুরী করলেও শহরের অভিজাত ভবনে ভাড়া নিয়ে বসবাস করে থাকেন। দীর্ঘদিন যাবৎ একই অফিসে চাকুরীর সুবাদে পুরো অফিসকেই জিম্মি করে ফেলেছেন তিনি। পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন ৪-৫ টি কম্পিউটার দোকান গড়ে উঠেছে এখানে। এসব কম্পিউটার দোকানকে কেন্দ্র করেও স্থানীয় দালাল ও কম্পিউটার মালিকদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। আর এই দালাল সিন্ডিকেটদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালকসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গোপন আঁতাত রয়েছে। দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সুকৌশলে আদায় করা হয় ঘুষ বাণিজ্যের টাকা। জেলা থেকে প্রতিদিন গড়ে একশ পাসপোর্ট আবেদন জমা হয় পাসপোর্ট অফিসে। এ আবেদনগুলি কম্পিউটারের দোকান থেকে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আবেদনের সময় দোকান মালিক ও দালালরা
আবেদনকারীদের কাছ থেকে ব্যাংকের নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন। পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীরা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের সঙ্গে খারাপ আচরণসহ নানাভাবে হয়রানি করারও অভিযোগ করেন তারা।
মেহেরপুর জেলা জজ আদালতের আইনজীবী নারগিছ খাতুনও ছিলেন পাসপোর্ট অফিসে। তিনি মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, গ্রাহকদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে এ অফিসে। পাসপোর্ট অফিস থেকে বিভিন্ন ভুল ধরে সংশোধন করতে এফিডেভিডের জন্যও পাঠানো হয়।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে মেহেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মী বিপ্লব ভুল করেছে। এবারের মত মাফ করে দেন এবং সংবাদ প্রকাশ করেন না বলে অনুরোধ করে বলেন আমি তার বদলির ব্যবস্থা করছি।