দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জনপ্রিয় একটি পত্রিকার নাম মেহেরপুর প্রতিদিন। জন্ম ২০১৮ সালের ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ। সাত বছর পেরিয়ে অষ্টম বর্ষে পা রাখলো। পত্রিকাটি চলচিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) তালিকাভুক্ত এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধিত একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল।
সভ্যতার বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। সংবাদপত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো জনসাধারণকে সমাজের বিভিন্ন বিষয় অবহিত করা। স্থানীয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর সংবাদ প্রকাশ করা অন্যতম বিষয়। এছাড়া বিনোদন খেলাধুলা শিক্ষা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েও প্রতিদিনের বিশেষ আয়োজন থাকে সংবাদপত্রে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী একটি ছোট্ট জেলার নাম মেহেরপুর। অবিভক্ত ভারতবর্ষের মহকুমা শহর এটি। এই জনপদে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার ইতিহাস নিয়ে আছে মিশ্র জনশ্রুতি। শিল্প সাহিত্য নিয়ে কাজ করেছেন স্বনামধন্য লেখক, কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগণ। কৃষিভিত্তিক এই জনপদে শিল্প কলকারখানা তৈরি হয়নি । পত্রিকা ছাপার জন্য একটি প্রিন্টং মেশিন (ছাপাখানা) এখনো পর্যন্ত নেই। বিজ্ঞাপন নামক যে খাদ্যের মাধ্যমে গণমাধ্যম বেঁচে থাকে সেটা জোগান দেয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান মেহেরপুরে গড়ে ওঠেনি। সেকারণে নিকট অতীতের বেশ কিছু পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। সাপ্তাহিক পরিচয় দৈনিক আজম, পাক্ষিক পশ্চিমাঞ্চল, সাপ্তাহিক মুজিবনগর, দৈনিক মেহেরপুর এর মত পত্রিকাগুলো বেশিদিন টিকে থাকতে পারিনি। এরই মধ্যে মেহেরপুর প্রতিদিন পত্রিকার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা দেখলাম খুবই সচেতনভাবে। যদিও বেড়ে ওঠা দুই ধরনের, একটি কাঠামোগত অপরটি যোগ্য হয়ে। সাত বছরের মধ্যে তেমন কোন দুর্যোগ দুর্বিপাক ছাড়া নিরবচ্ছিন্নভাবে পাঠকদের হাতে পত্রিকাটি তুলে দিতে সক্ষম হয়েছে কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে সংবাদ পরিবেশনে সত্যনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ, তথ্য নির্ভর এবং বিশ্বাসযোগ্যতার কতটা প্রমাণ দিতে পেরেছে সেটা পাঠকদের বিচার্য বিষয়।
এতগুলো প্রতিকূল বাস্তবতা থাকা সত্ত্বেও মেহেরপুর প্রতিদিনের প্রকাশক এম. এ. এস ইমন এর পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সত্যিই একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহসিকতার পরিচয় বহন করে।
পত্রিকার নামকরণের ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। কারণ মেহেরপুর প্রতিদিন ইতোমধ্যেই একটি বৃহত্তর অঞ্চলে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অনুসন্ধানী সংবাদ পরিবেশন পত্রিকাটিকে একটি বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এখানে উল্লেখ করতেই হয়, বছর দুয়েক আগে পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখে মেহেরপুর আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে স্যুয়োমটো জারি করেছে কয়েকটি। যেগুলো পরবর্তীতে নিয়মিত মামলায় পরিনত হয়। আদালতের নজরে আসার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা উপকার পেয়েছেন অনেকেই।
মেহেরপুর প্রতিদিনের অনলাইন পোর্টালটিও তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধিত। এটি ছাড়া মেহেরপুরে একটি অনলাইন পোর্টালও নিবন্ধিত নয়। তাৎক্ষণিক সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মেহেরপুরসহ কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ এবং চুয়াডাঙ্গায় একঝাঁক তরুণ সংবাদকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সংবাদের গুরুত্ব বিবেচনায় লাইভ প্রচার হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের ভিডিও কনটেন্টেকেও ইদানীং গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
টক-শো মেহেরপুর প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য কর্মসূচির একটি। ‘মুক্ত কথা’, ‘সংবাদ বিশ্লেষণ’ অনুষ্ঠান দুটির বয়স প্রায় ছয় বছর। সাম্প্রতিক সময়ে ‘প্রগতি’ ও ‘সাতকাহন’ নামে আরো দুটি অনুষ্ঠান সংযোজিত হয়েছে। প্রগতি’র সঞ্চালক আইটি বিশেষজ্ঞ মুন্সী জাহাঙ্গীর জিন্নাত এবং সাতকাহন সঞ্চালনা করেন শিক্ষক কবি হাসান রুদ্র। পত্রিকা কার্যালয়ে একটি সাউন্ড প্রুফ স্টুডিও আছে। সেখান থেকে অতিথিদের উপস্থিতিতে লাইভ এবং জুমের মাধ্যমেও অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়ে থাকে। সমসাময়িক বিষয়, রাজনীতি, শিক্ষা, কৃষি, শিল্প সংস্কৃতি, ক্রিড়া,ব্যবসা-বানিজ্য উদ্যোক্তা, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, অ্যাডভেঞ্চার সহ নানা বিষয় নিয়ে অতিথিরা আলোচনা করে থাকেন। এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার অতিথির সাথে এই আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। রাজনীতিবিদ, লেখক, কৃষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ নানা পেশার মানুষ যেমন অতিথি হিসেবে কথা বলেছেন তমনি অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা নিয়ে স্টুডিওতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশের একমাত্র দুইবারের এভারেস্ট বিজয়ী মাউন্টেনার এম এ মুহিত।
মেহেরপুর প্রতিদিন এর সম্পাদকীয় নীতি নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। রাষ্ট্র কাঠামোতে যদি স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব থেকে থাকে তাহলে সংবাদপত্রের যথাযথ ভূমিকা পালন করা খুবই কঠিন। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় প্রতিনিয়ত। এমপি-মন্ত্রী মেয়র-চেয়ারম্যান ডিসি-পুলিশ প্রশাসন সরকারি দলের নেতাদের লাল চোখ দেখতে হয়। বিগত দশ বছরে মেহেরপুরের মন্ত্রী দদুলের নির্লজ্জ প্রভাবকে উপেক্ষা করে মেহেরপুর প্রতিদিন যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে তা পত্রিকার পাঠক ও সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। সম্পাদক ইয়াদুল মোমিনের নেতৃত্বে গঠিত সম্পাদকীয় বোর্ড সকল প্রকার অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। সক্ষমতার আরেকটি অন্যতম কারণ পত্রিকার প্রকাশক এম.এ.এস ইমন যিনি স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রশ্নে সম্পাদকীয় নীতিতে কোনপ্রকার হস্তক্ষেপ করেননি। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে প্রতিষ্ঠান যেমন মামলার আসামী হয়েছে ঠিক তেমনি সেই মামলায় বিজয়ী হয়ে মেহেরপুর আদালতে বাদীর বিরুদ্ধে মানহানীর মানিস্যুট মামলা করেছে কর্তৃপক্ষ। যা এখনো চলমান আছে। আরেকটি সংবাদকে কেন্দ্র করে বাদী হিসেবে খুলনা সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইব্যুনালে সাতজনকে আসামী করে মামলা চলমান। ঢাকা সিএমএম আদালত গতবছর আরেকটি মামলা ডিসচার্জ করে দিলে মেহেরপুর প্রতিদিনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ঐ মামলার বাদীর বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা ও হয়রানি করার জন্য মেহেরপুর আদালতে মানহানী মানিসুটের আরেকটি মামলা দায়ের করেন। সেটিও চলমান আছে। এভাবেই মামলা, হুমকি-ধামকি মোকাবিলা করে দিন-মাস-বছর পাড়ি দিয়ে মেহেরপুর প্রতিদিনের অষ্টম বর্ষে পদার্পণ।
মেহেরপুর প্রতিদিনে কিছু উল্লেখযোগ্য আলোচিত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তারমধ্যে অনলাইন জুয়া, মাদক, প্রতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তির দুর্নীতি, হোটেল আটলান্টিকা কাণ্ড অন্যতম। এছাড়া করোনা মহামারীর সময় বিশেষ বুলেটিন অনলাইন ও প্রিন্ট পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নিয়মিত ডাক্তারদের নিয়ে টক-শো করাসহ পত্রিকার পক্ষ থেকে পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস, সেনিটাইজার এবং মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
মেহেরপুর প্রতিদিন ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২৩ আয়োজনটি ছিল বেশ জমজমাট। সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা চিন্তা করে যুবকদেও খেলার মাঠে ফিরে আসার আহবান জানানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য। টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার সাথে সাথেই উদ্দেশ্য পূরণ হলো। গাংনী মুজিবনগর এবং সদরে বিভিন্ন ইউনিয়ন ভিত্তিক টুর্নামেন্ট শুরু হয়ে গেল। কোনো উদ্যোগ যখন সফল হয় সেখানে ভাললাগাও থাকে অনেক। একটি কথা এখানে বলতেই হয়, মেহেরপুর প্রতিদিন ফুটবল টুর্নামেন্টটি আয়োজনে বড় বাধা ছিলো মন্ত্রী দোদুল। তৎকালীন ডিসি আজিজুল ইসলামকে খেলার অনুমতি নিতে নিষেধ করেছিলেন তিনি। কিন্ত তার কথা উপেক্ষা করে অনুমতি দিয়েছিলেন ডিসি আজিজুল ইসলাম। এছাড়াও পত্রিকার নানা উদ্যোগের বিপরীতে অবস্থান ছিলো দোদুলের। ছায়া’কেও ভয় পাওয়ার মতো সবকিছুতে না বলা স্বভাব ছিল তার। ৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের তীর্থভূমি খ্যাত মুজিবনগরকে উপলক্ষ করে এই জনপদে যে উন্নয়ন হওয়া উচিত ছিল তার কিছুই না করে অবৈধভাবে নিজের এবং পরিবারের অর্থনৈনিক উন্নতি নিয়েই ব্যস্ত ছিল। (বিষয়টি এই লেখার সাথে অপ্রাসঙ্গিক হওয়া সত্বেও লিখতে বাধ্য হলাম,,, দুঃখ প্রকাশ করছি)
মেহেরপুর প্রতিদিনের নিজস্ব একটি কার্যালয় আছে, শহরের মল্লিকপাড়ায় অবস্থিত। প্রায় দুই হাজার স্কয়ার ফিটের অফিসটিতে আছে সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দুটি কক্ষ, সাউণ্ড প্রুফ ডিজিটাল স্টুডিও, সার্কুলেশন ও নিউজ ডেস্কসহ অতিথিদের বসবার জায়গা।
পত্রিকাটির সাথে বর্তমানে যারা কাজ করছেন – অফিসে ডেস্ক ইনচার্জ সাকিব হাসান রুদ্র, নিউজ ডেস্ক পলাশ আহমেদ, তুহিন খান, ডিজাইনার লিমন হোসেন ও রাফি হাসান, অফিস সহকারী আহসান। সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন – গাংনী উপজেলায় আকতারুজ্জামান আকতার, জুলফিকার আলি কানন, কামরুল ইসলাম। মুজিবনগরে মুস্তাফিজুর রহমান শের খান ও সানোয়ার হোসেন ডালিম। আমঝুপিতে শহিদুল ইসলাম, বারাদিতে সাইফুল ইসলাম বাবু, ঝিনাইদহে- শাহানুর আলম, তাপস কুন্ড এবং অরিত্র কুন্ড। চুয়াডাঙ্গায়- সাকিব দর্শনায় মামুন ও ফরহাদ হোসেন দামুড়হুদায় রকিবুল হাসান কোটচাঁদপুরে মঈন। জীবননগরে এটিএম মাজেদুল ইসলাম মিল্টন, দামুড়হুদায় রাকিবুল হোসেন তোতা, কুষ্টিয়ায় জামাল উদ্দিন। বিগত বছরগুলোতে আরও ৩০/৩৫ জন সাংবাদিক বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন।
আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়ে থাকে। সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক অধিকার অর্জন ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সংবাদপত্রের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, তাকে যদি ‘সংবাদপত্রবিহীন সরকার’ এবং ‘সরাকারবিহীন সংবাদপত্র’ এ দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রকেই বেছে নেবেন।”
সংবাদপত্র নিয়ে এমন ভাবনার বিপরীতে আমাদের দেশে অনেক মালিককে দেখা যায় কালো টাকাকে সাদা করার জন্য পত্রিকাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। আবার অনেক সৃজনশীল সৎ মানুষ আছেন যারা একটি পত্রিকা বের করতে ভয় পান। কালোটাকার দৌরাত্ম্যের অসম যুদ্ধে তারা হেরে যাবেন এই ভেবে এক পা আগালেও দশ পা পিছিয়ে আসেন। সংবাদপত্রের সাথে ক্ষমতাবানদের স্বার্থের দন্দ মোকাবিলা করতে হলে দরকার প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের পক্ষে থাকা। সাধারণ জনমতের কাছে যেকোনো অপশক্তি পরাস্ত হতে বাধ্য। মেহেরপুর প্রতিদিন এই শক্তিকেই ধারণ এবং সকল প্রতিকুলতাকে জয় করে জনগণের স্বার্থে চলতে থাক অবিরাম অবিরত, এটাই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রত্যাশা।
লেখক: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, মেহেরপুর প্রতিদিন