নানা ধরনের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, জনবল-সংকটসহ নানা সমস্যা নিয়ে মেহেরপুর জেলায় মৎস্য সপ্তাহ ২০২২ পালিত হচ্ছে।
গতকাল শনিবার সকাল ১০ টার সময় মেহেরপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে এক মতবিনিমিয় সভার মধ্য দিয়ে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২২ উদ্বোধন করা হয়েছে।
মেহেরপুর জেলা মৎস্য অফিসার রোকনুজ্জামানের সভাপতিত্বে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জেলা মৎস্য অফিসার রোকনুজ্জামান বলেন, মেহেরপুর জেলায় ১৩ হাজার ৯৯৫ মেট্রিক টন মাছের চাহিদা থাকলেও সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১৩ হাজার ৮২২ মেট্রিক টন মাছ।
জেলায় এ বছর ১৭৩ মেট্রিক টন মাছের ঘাটতি থাকলেও অন্যান্য বছরেও ঘাটতি থেকে যায়। গত বছর এই মাছে ঘাটতি ছিল প্রায় সাড়ে ৪শ মেট্রিক টন।
এদিকে মেহেরপুরে সরকারীভাবে দুটি পোনা রেনু উৎপাদন কেন্দ্র থাকলেও সেগুলো কাজে আসছেনা মৎস্য চাষীদের। মেহেরপুর মৎস্য অফিস চত্তরের হ্যাচারীটি আইরনের কারনে ও গাংনীর হ্যাচারীটি দীর্ঘদিন পড়ে থাকার কারণে অকেজো হয়ে গেছে এমন অভিযোগে রেনু পোনা উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে মেহেরপুর সরকারী হ্যাচারির ৮টি পুকুরে মাছ চাষ করে সরকারী ফান্ডে সামান্য অর্থ জমা দিয়ে পকেট ভারী করছেন দায়ীত্বে থাকা কর্মকর্তারা।
এদিকে গাংনী সরকারী হ্যাচারিটির যায়গা বেহাত হয়ে পড়লেও জেলা ও গাংনী উপজেলা মৎস্য অফিস রয়েছে উদাসিন। গাংনী সরকারী হ্যাচারিটি যেমন কর্তৃপক্ষের অযত্ন আর অবহেলায় বিলিন হতে চলেছে। সেই সাথে এক শ্রেনীর অসাধু লোকজন সেটি দখল নিতেও মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফলে বেহাত হয়ে পড়েছে মৎস্য হ্যাচারিটি।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, জেলা মৎস্য অফিসার, একজন অফিস সহকারী ও একজন অফিস সহায়ক (এমএলএসএস) দিয়েই চলছে মেহেরপুর জেলা মৎস্য অফিসের কার্যক্রম। অফিসের সিনিয়র সহকারী পরিচালক, সহকারী পরিচালক, উপসহকারী প্রকৌশলী, হিসাব রক্ষক ও অফিস সহকারীর পদগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ শুণ্য রয়েছে।
এছাড়া সদর উপজেলা মৎস্য অফিসের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার, গাংনী উপজেলা মৎস্য অফিসের সহকারী মৎস্য অফিসার, উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ অফিসার, ফিল্ড অফিসার ও মুজিবনগর উপজেলা মৎস্য অফিসের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসারের পদ দীর্ঘদিন যাবৎ শুণ্য রয়েছে।
সূত্রটি আরো জানায়, মেহেরপুর সদর উপজেলায় ৭টি, গাংনী উপজেলায় ২ টি ও মুজিবনগর উপজেলায় ১ টি বীল বাওড়সহ ৫৭৯২.০৮ হেক্টর আয়তনের ৫৩৮৭ টি জলাশয় রয়েছে।
এদিকে মেহেরপুর জেলা মৎস্য অফিস সংলগ্ন ১০ একর জমির উপর গড়ে ওঠা মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারটিতে এখন রেনু ও পোনা উৎপাদন হয়না। দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে পোনা উৎপাদন। পানিতে অতিরিক্ত আইরন থাকায় কারন দেখিয়ে খামারটি বন্ধ রাখা হয়েছে। এখানে বীজ রেনু পোনা উৎপাদন করা সম্ভব নয় বলে জানালেন জেলা মৎস্য অফিসার।
তবে খামার ব্যবস্থাপক ইকবাল শরীফ বলেন, এখানেও পোনা উৎপাদন করা হয়ে থাকে। তবে সেটি লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৭ শতাংশ। তিনি বলেন, ২০২১-২২ অর্থ বছরে এই খামারের রেনু ও পোনা জন্য সরকারী বর্দ্দা ছিল ৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা। সেখানে আমি রেনু ও পোনা বিক্রি করে সরকারী কোষাগারে ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৬০০ টাকা জমা দিয়েছি।
অপরদিকে গাংনী উপজেলা মৎস্য অফিসের তত্বাবধানে গ্রামীণ মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারটির কোনো খোঁজ খবর নেননা মৎস্য অফিসের কর্মকর্তারা। মৎস্য অফিসের অবহেলা আর অবব্যবস্থাপনার জন্য খামারটি এখন বেহাত হয়ে রয়েছে। অথচ, এক সময় এই সরকারী হ্যাচারী দুটি থেকে জেলার মৎস্য চাষীদের রেনু পোনার চাহিদার অধিকাংশই দেওয়া হতো।
মৎস্য হ্যাচারি দুটির আবাসিক ভবনসহ বিভিন্ন উপকরণ ও মেসিনগুলো খোঁজ খবর ও লোকবল না থাকায় ভবন ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। এছাড়া, পুকুরের পাড়গুলোও ভেঙে গেছে। বছরের বেশির ভাগ সময় পুকুরগুলোয় পানি-সংকট থাকে।
গাংনী উপজেলার ষোলটাকা গ্রামের মাছ চাষী জাফিরুল ইসলাম জানান, আমার ৭ টি পুকুর আছে। আমি যশোর চাঁচড়া থেকে রেনু পোনা নিয়ে আসতে হয়।
একই গ্রামের আব্দুল মুনতাজ আলী বলেন, সরকারীভাবে রেনু পেলে এলাকার অনেক মাছ চাষীর সময় ও খরচ বাচানো যেতো। এছাড়া মান সম্মত রেনু পোনা পেতাম।
মাছ চাষী আব্দুল মতিন বলেন, আমার প্রায় ২৫ টি পুকুর রয়েছে। আমি যশোর ও ময়মনসিংহ থেকে রেনু পোনা এনে চাষ করি। মেহেরপুর জেলাতে দুটি সরকারী মৎস্য হ্যাচারি রয়েছে। অথচ, সেখানে পোনা উৎপাদন করা হয়না।
ময়নাল হোসেন ও আব্দুল হালিম জানান, জেলায় মাছের চাহিদার সিংহভাগ ষোলটাকা গ্রামে উৎপাদিত হয়। মৎস্য গ্রাম খ্যাত ষোলটাকা গ্রামে প্রায় ৩ হাজার পুকুর রয়েছে। এখানকার সব মাছ চাষী যশোর ও ময়মনসিংহ থেকে রেনু পোনা কিনে এনে চাষ করছেন। জেলার সরকারী মৎস্য হ্যাচারি দুটি থেকে মাছ চাষীদের অধিকাংশ চাহিদাই মেটানো সম্ভব। মৎস্য অধিদপ্তরের অবহেলা আর অব্যবস্থাপনার জন্য হ্যাচারি দুটিতে আজ রেনু পোনা উৎপাদন বন্ধ। জেলার হাজার হাজার মৎস্য চাষী রেনু পোনা নিয়ে বেকায়দায়।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক, কয়েকজন মাছ চাষী বলেন, প্রকৃত মাছ চাষিরা সরকারী পোনা পায়না। চাষি নন এমন লোকও সরকারী পোনা পাচ্ছেন। মৎস্য অফিসের এসব অনিয়ম ও জনবল সংকট দূর হলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে এবং সরকারী হ্যাচারি দুটি ঐতিহ্য ফিরে আসবে বলে মনে করছেন তারা।
মেহেরপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: রোকনুজ্জামান বলেন, জনবল সংকটের কারনে, জেলা মৎস্য অফিসের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সব কাজ সুচারুরুপে করা সম্ভব হচ্ছেনা। জেলা মৎস্য অফিসের এই জনবল-সংকটসহ নানা সমস্যার কথা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।