করোনা ভাইরাস প্রকোপের আগে থেকেই পাবজি ও ফ্রি ফায়ার গেমস নামক অনলাইন গেমসে তরুণ সমাজের আসক্তির বিষয়ে অধিক খবর প্রচার হতে দেখা গেছে।
করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় এই প্রকোপ আরও বেশি দেখা যাচ্ছে। স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে বাড়িতেই অবস্থান করতে হচ্ছে এবং বাড়িতে অবস্থান করার শর্তে অনেক বাবা-মা’ই সন্তানের এমন গেমস খেলাকে মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু অজান্তেই সন্তানের পড়ালেখার আগ্রহকে একেবারেই নষ্ট করে দিচ্ছেন বাবা-মা নিজেরাই।
অতীতে বিভিন্ন ছুটিতে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন লেখকের লেখা উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গল্প, কবিতার বই ইত্যাদি পড়তে দেখা গেলেও এখন তা কালেভদ্রে দু’এক জনকে দেখা যায়।
বেশিরভাগ শিক্ষার্থী-ই এখন মোবাইলে তাদের অবসর সময় গুলো পার করছেন।
অনেক বাবা-মাকে দেখা যায় ছোট বাচ্চারা খাওয়া দাওয়া না করলে, মোবাইলে বা টিভিতে কার্টুন লাগিয়ে দেয়, এতে সন্তানের খাওয়া দাওয়ার মাধ্যমে পুষ্টি হলেও তার মস্তিষ্কের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে সেদিকে বাবা-মায়ের নজর একেবারেই নেই।
আগে বিকালে ছেলে-মেয়েরা ক্রিকেট, ফুটবল, গোল্লাছুট, হা-ডু-ডু, দাড়িয়াবান্ধা, গাদন খেলাসহ হরেক রকমের খেলা খেলতে দেখা যেতো, কিন্তু আধুনিকতার স্পর্শে এখন এগুলো আর দেখা যায় না। নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা তো এখন অনেক খেলার নাম-ই জানে না। কারণ তারা এখন মোবাইলে গেমসে আসক্ত, তাই শারীরিক কসরতের খেলাটা তাদেরকে খুব একটা আকর্ষণ করে না, ফলে শারীরিক ব্যায়ামের একটা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
প্রযুক্তি আমাদের জন্য যেমন সুফল বয়ে এনেছে ঠিক তেমনি কুফলও বয়ে এনেছে, দরকার শুধু সঠিক ব্যবহারের। কিন্তু ব্যবহারের সব রকম সুযোগ যখন শিক্ষার্থীদের হাতে চলে আসে তখন তাদের অবচেতন মনেই তারা সেই সুযোগ ব্যবহার করে ভুল পথে পা বাড়ায় এবং ক্রমেই তার মূল্যবান সময়গুলো ফেসবুক, ইউটিউব, পাবজি, ফ্রি-ফায়ার ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে হেলায় নষ্ট করে ফেলে।
একটি সময় ছিল যখন সন্ধ্যার পর বাবা, মা, দাদা, দাদী, নানা, নানী এরা সবাই বাচ্চাদের বিভিন্ন কেচ্ছা বা গল্প শোনাতো কিন্তু এখন বাবা-মায়ের সময় কই? শহরে তো বটেই এখন পল্লীগ্রামেও ভিনদেশী অপসংস্কৃতি প্রবেশ করেছে। এখনকার মায়েরা সন্তানদের আর রাজা-রাণীর গল্প, ভূতের গল্প, রাক্ষস রাজার বা শেয়াল-কুমিরের গল্প শোনায় না। এ যুগের মায়েরা এখন সন্ধ্যার পর থেকেই ভিনদেশী টিভি সিরিয়াল দেখতে বসে পড়েন। এতে করে মা নিজের ক্ষতি তো করছেনই পাশাপাশি ক্ষতি করছেন নিজের সন্তানের।
এখন স্কুল মাঠে ছেলেরা আর ফুটবল ক্রিকেট খেলতে যায় না, এখন তারা মাঠে যায় ঠিকই কিন্তু ক্রিকেট বা ফুটবল খেলতে নয় মাঠের এক কোনায় বসে দলবেঁধে মোবাইলে গেমস খেলতে। আপনি হয়তো তাদের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছেন এবং তাদের গেমস খেলার বিষয়টি লক্ষ্য করছেন, কিন্তু তাতে কী? তারা কিন্তু আপনাকে মোটেও খেয়াল করছে না। ভাবটা এমন যে, যদি তাদের পাশে পারমাণবিক বোমাও নিক্ষেপ করা হয় তাতেও তাদের চৈতন্য হবে বলে মনে হয় না।
এ বিষয়ে কয়েকজন বাবা-মায়ের কাছে জানতে চাওয়া হলো যে, মাধ্যমিকে পড়া একটা ছাত্রকে তিনি কোন যুক্তিতে মোবাইল কিনে দিলেন? উত্তরটা ছিল চমকে যাওয়ার মতো। একজন বাবা বললেন, তার সন্তান তাকে বলেছে যে, এন্ড্রয়েড মোবাইল না কিনে দিলে ছেলে আত্মহত্যা করবেন! আর এই ভয়েই ভীত হয়ে বাবা তার ছেলেকে মোবাইল কিনে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
আরেকজন মা বললেন, ছেলে মোবাইল কিনে না দেওয়ায় খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছিলেন এমনকি ২ দিন নাকি না খেয়েও ছিলেন ফলে ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য বাবা বাধ্য হলেন মোবাইল কিনে দিতে। আর আরেকজন মা তো শখ করেই তার ছেলেকে মোবাইল কিনে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মেয়েদের খুব বেশী পীড়াপীড়ি করতে হয় না। তারা বাসায় রাখা তাদের মায়ের মোবাইলকেই নিজের মোবাইল বলে চালিয়ে নিতে পারে, কেননা মা মোবাইল সম্মন্ধে অতটা বিজ্ঞ নয়, তাই মেয়েরা হয় মায়ের সাথে টেলিভিশন দেখায় ব্যস্ত আর না হয় মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত।
এতকিছুর মধ্যে পড়ালেখার সময়টা বের করাই এখনকার ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ! কেননা তাদের পড়ালেখার সময় কই? এর কিছুটা দায়ভার অবশ্য শিক্ষাব্যবস্থার উপরেও বর্তায়, সৃজনশীল নামক শিক্ষাব্যবস্থার যাতা কলে শিক্ষার্থীরা নিষ্পেষিত। যে শিক্ষাব্যবস্থা দেশে প্রচলিত তার সম্পর্কে অধিকাংশ শিক্ষকরাই এখনো ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি, তাহলে শিক্ষার্থীদের অবস্থাটা কি বুঝতে পারছেন? এখনকার পদ্ধতিটা হচ্ছে বিদ্যা গেলানো আর সেই গিলে ফেলা বিদ্যা পরীক্ষার হলে উগলানো। শিক্ষার্থী কিন্তু পড়ালেখাটা হজম করতে পারে না।
শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার নতুবা মেকি শিক্ষিত শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে। একজন প্রকৃত মানবিক এবং খাঁটি শিক্ষার্থী কখনোই পাওয়া যাবে না।
সব শ্রেণির মাতৃকূল কিন্তু এমনটি নয়, কিছু বাবা-মা আছেন যারা তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই আশাবাদী কেননা তারা তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাড়িতে কোনো টেলিভিশনই রাখেননি! শুধু তাই-ই নয় সন্তানতো নয়-ই মা নিজের কাছেও কোনো এন্ড্রয়েড ফোন রাখেননি অথচ চাইলেই তারা এরোকম শতশত মোবাইল কিনতে পারেন।
আচ্ছা ঐ যে বাবা তার ছেলের আত্মহত্যার ভয়ে বা মা তার সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য মোবাইল কিনে দিলেন তাদের সন্তান কি আদতে এখনো বেঁচে আছে বলে আপনাদের মনে হয়? অনেকেই ভাবতে পারেন ছেলের আবার মৃত্যু হলো কিভাবে? আসলে শারীরিক মৃত্যুবরণই মৃত্যু নয়, আরেক শ্রেণির মৃত্যু হলো আত্মার। আসলে ঐ সকল বাবা-মা তাদের সন্তানের আত্মার মৃত্যু ঘটিয়েছেন।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন যে তাহলে এ থেকে বের হবার উপায় কী? উপায় আছে। আপনি আপনার যুগে ফিরে যান এবং নিজেকেই প্রশ্ন করুন উত্তর পেয়ে যাবেন। সন্তানকে নিজে বন্ধুর মতো সময় দিন উত্তম বন্ধু হয়ে উঠুন তাহলে তার আর বাইরের বন্ধুর প্রয়োজন হবে না।
কেননা আজকের সন্তানদের বাবা-মা নামক উত্তম বন্ধুর খুবই অভাব। নিজের সন্তানের খোঁজ খবর রাখুন কোথায় যায়, কী করে কার সাথে মিশে এগুলো খোঁজ নিন। আর যতটুকু সম্ভব নিজে সময় দিন। প্রযুক্তিকে যদি ব্যবহার করতেই হয় তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তার হাতে প্রযুক্তি দিতে পারেন তবে সেটা অবশ্যই উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর।
কেননা এর আগের সময়গুলো আপনার সন্তানের ভিত্তি ঠিক করার সময় এই সময়গুলোকে হেলায় নষ্ট হতে দেবেন না। আর উচ্চ মাধ্যমিকের পরে আপনার সন্তান নিজেই ভালো মন্দের বিচার করতে শিখে যাবে।
গেমস নামক এই মরণ ব্যাধি থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষার জন্য এখনই সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত এবং তা অত্যাবশকীয়।