যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনে দেশটির সেনাদের সহায়তা করা আফগানিস্তানের দোভাষীরা পরিবার নিয়ে বেকায়দায় রয়েছেন। আমেরিকার ভিসা প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে তাদের দিন কাটছে ভয়ের মধ্যে। কেউ কেউ স্পেশাল ইমিগ্রেন্ট ভিসা (এসআইভি) প্রোগ্রামের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তাদের মধ্যে একজন ওয়ালিদ ওমিদ হাবিবি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রোচেস্টারে এক মাস ধরে বাস করছেন তিনি।
ওয়ালিদ ওমিদ হাবিবি রোচেস্টারে থাকলেও তার মন পড়ে রয়েছে আফগানিস্তানে। যেখানে তার স্ত্রী, তিন সন্তান এবং মা দেশ ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য নিউ আরবকে ওয়ালিদ হাবিবি বলেন, আমি স্বশরীরে রোচেস্টারে আছি ঠিকই কিন্তু আমার মন পড়ে আছে আফগানিস্তানে। সেখানে আমার পরিবার হুমকির মধ্যে দিন পার করছে।
ওয়ালিদ হাবিবি সেইসব আফগানদের একজন যারা আফগানিস্তান থেকে স্পেশাল ইমিগ্রেন্ট ভিসা (এসআইভি) প্রোগ্রামের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে আসার সুযোগ পেয়েছেন।
এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষনা দেন। ফলে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের আগ্রাসনের ইতি ঘটতে যাচ্ছে।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তানে আগ্রাসন শুরু করে দেশটি। সন্ত্রাসীদের দমনের কথা বলে হামলা চালানো হলেও প্রায় ২০ বছরের মাথায় সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে একপ্রকার। এই মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় দোভাষীরা।
২০০২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের সঙ্গে হাজার হাজার আফগান দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন। বিশ্বের সর্বোচ্চ দারিদ্র্যের হার (এডিবির তথ্য অনুযায়ী ৪৭.৩ শতাংশ) এ দেশটিতে। যেখানে এ চাকরি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও লোভনীয় ছিল। ধারণা করা হয়, আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার কারণে প্রতি ৩৬ ঘণ্টায় একজন আফগানকে হত্যা করা হয়।
এই দোভাষীরা রুটিন অফিস ছাড়াও বিশেষ অভিযান এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে জিম্মি আলোচনায়ও অংশ নিতেন। তারা বলতে গেলে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের চোখ ও কান ছিলেন।
আফগান দোভাষীদের সহযোগিতা করে এমন পেশাদার সংগঠন ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রিটারসের চেয়ারম্যান রবার্ট ক্রুজ বলেন, দোভাষীদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে নেওয়া উচিত।
দোভাষীদের অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মতে, আফগানিস্তানের দোভাষী এবং যেসব স্থানীয়রা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। একইসঙ্গে তাদের দাবি, এসব দোভাষীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। এসময়ের মধ্যে যেকোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক তৎপরতার হাত থেকে দোভাষীদের বাঁচাতে তাদের গুয়াম দ্বীপে স্থানান্তর করা যেতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল রিফিউজি অ্যাসিস্ট্যান্স প্রজেক্ট (আইআরএপি)- এর পরামর্শক অ্যাডাম বেটস বলেন, অনেক মানুষকে দ্রুত স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে এসআইভি প্রোগ্রাম সেভাবে কাজ করে না। যদি আফগানিস্তানের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায় বা সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার আশঙ্কার মধ্যে এখন যদি দোভাষীরা আবেদন করেন তবে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে দুই বছর সময় লাগবে। ঝুঁকির মধ্যে থাকা আফগানদের জন্য এটা দ্রুত কোনো প্রক্রিয়া নয়।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে শত শত এসআইভি প্রোগ্রামের আওতায় আবেদনকারী নিহত হয়েছেন। যারা আবেদনের পর বিষয়টি সুরাহার অপেক্ষায় ছিলেন। সামনে এ হার আরও বাড়তে পারে।
বিপদগ্রস্ত দোভাষীদের সহায়তা করতে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৯ সালে দ্য স্পেশাল ইমিগ্রেন্ট ভিসা (এসআইভি) প্রোগ্রাম চালু করে। ভিসার পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় ৯ মাসের মতো সময় প্রয়োজন হয়। কখনো কখনো ভিসার পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে বছরের পর বছর লেগে যায়।
ওয়ালিদ হাবিবি এবং তার বাবা ২০০৭ সালে ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন। সব প্রক্রিয়া শেষে এ বছর তারা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিতে পেরেছেন।
এ ভিসার জন্য যোগ্য হতে হলে দোভাষীদের অবশ্যই তিনি যে বিপদগ্রস্ত তা প্রমাণ করতে হবে। আবেদন করলেই ভিসা মিলবে তাও কিন্তু নয়। দু বছর পর ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এমন ঘটনাও আছে।
এমন অনেকে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে কাজ করেননি কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করছেন তারাও রয়েছেন হুমকিতে। তাদেরও যেন নিরাপত্তার আওতায় আনা যায় সে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে আইআরএপি।
যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে বিপদে রয়েছেন আফগানিস্তানে দোভাষীরা।
আইআরএপির আইনজীবী জুলি কর্নফেল্ড বলেন, আমার এক ক্লায়েন্টের পরিবার সম্প্রতি তালেবানের গ্রেনেড হামলার শিকার হয়েছিল। পরে তারা আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে বাইডেনের ঘোষণা দেখছিলেন। তারা অপেক্ষায় ছিলেন বাইডেন আফগানদের নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু বলবেন। কিন্তু পুরো বক্তব্যে তিনি এমন কিছু বলেননি। ফলে আমার ক্লায়েন্ট এবং তার স্ত্রী হতাশ হয়ে পড়েন।
তিনি আরও বলেন, ঝুঁকির মধ্যে থাকা আফগানদের ইমিগ্রেশন ভিসা মডেলের বাইরে অন্য কোনো পন্থায় স্থানান্তর করা যায় কি-না তা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে হবে। দূতাবাসে তাদের কর্মী সংখ্যা বাড়ানো উচিত। যেখানে প্রায় ৭০ হাজার দোভাষী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা আফগানিস্তান ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
‘এ ভিসা তাদের একমাত্র আশার আলো। আমরা তাদের ভিসা নিয়ে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে রেখেছি। স্বাভাবিকভাবেই তাদের অনেকেই এই ভিসা পাবেন না’, যোগ করেন জুলি কর্নফেল্ড।
নিউইয়র্কে পুনর্বাসিত দোভাষীদের নিয়ে কাজ করা কিপিং আওয়ার হোপের নির্বাহী পরিচালক এলেন স্মিথ অভিবাসীদের প্রতি আমেরিকানদের আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
২০১৪ সাল থেকে নিউইয়র্কের রোচেস্টারে পুনর্বাসিত দোভাষীদের নিয়ে কাজ করা স্মিথ বলেন, আমরা পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর প্রেমে পড়ে গেছি। আমরা নতুন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছি তাদের কল্যাণে। তাদের মাধ্যমে আমরা ইসলাম সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছি এবং অনেক অভিন্নতা খুঁজে পেয়েছি যা আমরা আগে জানতাম না। আমরা একে অপরের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করছি। পরিবারগুলো এখানে একটি সম্প্রদায় তৈরি করেছে এবং তারা আমাদের সম্প্রদায়কে সমৃদ্ধ করছে। এটা এমন বিষয় যা সাত বছর আগে কেউ ভাবেওনি।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা আফগানিস্তানে আগ্রাসন শুরু করে। এরপর মাঝে কেটে গেছে প্রায় ১৯ বছর। ২০ বছরের মাথায় দেশটি থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেনা প্রত্যাহারের পর দেশটিতে আদৌ শান্তি ফিরে আসে কি-না তা এখন দেখার বিষয়।