ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর (বরখাস্ত) মোহাম্মদ ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী মো. জাহিদের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে দুইটি করে পৃথক চারটি মামলা দায়ের করেছে র্যাব।
মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর চকবাজার থানায় র্যাব বাদী হয়ে এ চারটি মামলা দায়ের করে।
এদিকে পুরান ঢাকার এলাকায় চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক আধিপত্য ও দখলদারিত্বের নিয়ন্ত্রণে ইরফান সেলিম ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সেন্টার গড়ে তোলেন। পুরান ঢাকার চাঁন সরদার দাদা বাড়ি থেকে সামান্য দূরে চকবাজারের চক সার্কুলার রোডে মদীনা আশিক টাওয়ারের ছাদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছিলেন ইরফান।
কন্ট্রোল রুমে ছিল অত্যাধুনিক নেটওয়ার্কিং সিস্টেমের ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) ডিভাইস। মদীনা আশিক টাওয়ারে এবং বাসার চার তলার নিজস্ব কক্ষে স্থাপন করেছিলেন ওয়াকিটকি বেজ স্টেশন। ইরফান ও তার সহযোগিরা ওয়াকিটকির মাধ্যমে চার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় যোগাযোগ করতেন। চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক আধিপত্য, দখলদারিত্ব ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সব ধরনের আলোচনার জন্য তার এবং বাহিনীর সদস্যদের জন্য ৩৮টি ওয়াকিটকি ব্যবহার করা হতো।
র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই-তিন বছর আগেই পুরান ঢাকায় নিজস্ব বাহিনীর মধ্যে যোগযোগ চালাতে এই ওয়ারলেস নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা তার বাসায় স্থাপন করেন ইরফান সেলিম। গত কাউন্সিলর নির্বাচনের আগে মদীনা আশিক টাওয়ারের ১৭ তলায় ইরফানের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ভিএইচএফ ডিভাইস ও একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন এন্টেনা স্থাপন করেন। এসব ডিভাইস বিদেশ থেকে অবৈধ পন্থায় দেশে নিয়ে আসেন ইরফান। ভিএইচএফ ডিভাইসের মাধ্যমে কালো রঙের ওয়াকিটকি সেট ব্যবহার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কোনো অনুমোদন ও লাইসেন্স ছিল না। নিজের আধিপত্য ও চাঁদাবাজি চালাতে অবৈধভাবে ওয়াকিটকি ব্যবহার করছিলেন ইরফান ও তার ক্যাডাররা।
র্যাব সূত্র জানায়, ইরফানের নিজস্ব ওয়্যালেস ওয়াকিটকি নেটওয়ার্কে যোগাযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শনাক্ত করতে পারতো না। এই অবৈধ সুযোগটি নিয়ে ইরফান অপকর্মের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজি করতেন। এর জন্য ইফরান একটি ক্যাডার বাহিনী তৈরি করেন। প্রত্যেকের কাছে ছিল অবৈধ অস্ত্র। এর মাধ্যমে পুরান ঢাকার জনমানুষের মধ্যে ভীতি প্রতিষ্ঠা করে রাখতেন। এর জন্য চক সার্কুলার রোডে মদীনা আশিক টাওয়ারের টপ ফ্লোরে ইরফানের একটি টর্চার সেল রয়েছে। যারা তার মতের বিরুদ্ধে যেতেন, তাদের ওই টর্চার সেলে এনে নির্যাতন চালাতেন এবং ভয়ভীতি দেখাতেন।
ইরফানের দেহরক্ষী ছিলেন ১২ জন। এদের মধ্যে জাহিদুল ইসলাম ছিলেন চকবাজারের একজন ত্রাস। দেহরক্ষীদের সবার সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র থাকতো বলেও তথ্য রয়েছে। আধিপত্যের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ ও হাজী সেলিমের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য বেতনভুক্ত আরো ৩৫ জন ক্যাডার রয়েছে বলেও জানায় র্যাবের কর্মকর্তারারা।
র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, ইরফান প্রতি রাতেই মদ্যপান করে তার দুইটি বিদেশি কুকুর ও দেহরক্ষীদের সঙ্গে নিয়ে চকবাজার এলাকায় চক্কর দিতেন। পুরান ঢাকায় তাদের চলাচলে একটা আতঙ্ক বিরাজ করলেও ভয়ে কেউ কিছুই বলতেন না। পুরান ঢাকায় বিভিন্ন জমি দখলের বিষয় কিছু তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে র্যাব। হাজী সেলিম ও তার ছেলোরা পুরান ঢাকার কোনো জমি দখলের ক্ষেত্রে নিজেদের বেতনভুক্ত ক্যাডারের পাশাপাশি স্থানীয় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার করতেন। তাদের দখলদারিত্বে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ও সহায়তার জন্য চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) উপহারও দিয়েছেন তারা।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইয়ংয়ের পরিচালক লেফট্যানেন্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘নিজ বাসা ও তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ের উপরে ভিএইচএফ ওয়াকিটকি বেজ স্টেশনটি মূলত এলাকায় চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য নিজের খরচে অবৈধভাবে এটি স্থাপন করেছিলেন ইরফান সেলিম।’
তিনি বলেন, ইরফানের বাসা থেকে জব্দ হওয়া দুইটি বিদেশি পিস্তল ও মাদকদ্রব্যের বিষয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় র্যাব বাদী হয়ে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুইটি এবং দেহরক্ষী জাহিদের বিরুদ্ধে একই আইনে দুইটি করে মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর ও হত্যার হুমকির ঘটনায় ইরফান সেলিমসহ তার দেহরক্ষী জাহিদুল ইসলাম, গাড়িচালক মিজানুর রহমান, মদীনা গ্রুপের প্রটোকল কর্মকর্তা এবি সিদ্দিক দিপু ও অজ্ঞাতনামা তিন জনসহ মোট সাত জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী লেফট্যানেন্ট। ওই রাতেই হাজী সেলিমের গাড়িচালক মিজানুরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন ২৬ অক্টোবর দুপুরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে পুরান ঢাকার চকবাজারে চান সরদার দাদা বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ইরফানকে গ্রেফতার করে র্যাব।
অভিযানে অবৈধ দুইটি অস্ত্র, মদ, বিয়ার, ৩৮টি ওয়াকিটকি ও ভিএইএফ ডিভাইসযুক্ত ওয়াকিটকি বেজ স্টেশন জব্দ করা হয়। এরপর মদ্যপান ও বেআইনিভাবে ওয়াকিটকি রাখার দায়ে ইরফানকে ১৮ মাসের সাজা দেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তার দেহরক্ষী জাহিদুলকে বেআইনি ওয়াকিটকি ব্যবহারের জন্য ছয় মাসের করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।