ঔষধ শিল্প বর্তমানে বাংলাদেশের একটি দ্রুত বিকাশমান শিল্পখাত। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প মূলত আমদানীর উপর নির্ভরশীল ছিল। যার ফলে উচ্চ মূল্যে ঔষধ ক্রয় করতে হত।
বাংলাদেশে বর্তমানে দেশের চাহিদার প্রায় ৯৮% ঔষধ দেশে উৎপাদিত হয় এবং শুধুমাত্র দেশে উচ্চ প্রযুক্তির ঔষধ প্রোডাক্ট আমদানি করা হয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ঔষধ আমদানীকারক দেশ হতে রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং সারা বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের ৫৪টি ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বিভিন্ন প্রকারের ঔষধ ও ঔষধের কাঁচামাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানী, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, কানাডা সহ ১৫৭টি দেশে রপ্তানি করছে।
সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও সার্বিক সহযোগিতায় ঔষধ রপ্তানির পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ হতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ম্যালেরিয়া, টিউবারকুলোসিস, ক্যান্সার, লেপ্রোসি-সংক্রান্ত; পেনিসিলিন এবং স্ট্রেপটোমাইসিন সহ অন্যান্য ঔষধ রপ্তানি করা হয়ে থাকে।
সাম্প্রতিক বৈশ্বিক মহামারীতে বাংলাদেশের ঔষধ কোম্পানীগুলো অন্তত ৩০ কোটি মূল্যের এন্টিকোভিড মেডিসিন দক্ষিণ এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকার দেশসমূহ সহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি করেছে।
বিগত ৫ বছরের ঔষধ রপ্তানীর তথ্য—২০১৮ সালে ১১৩ দেশে রপ্তানীর পরিমাণ ছিল ৩৫১৪.৩ কোটি, ২০১৯ সালে ১৪০ দেশে রপ্তানীর পরিমাণ ছিল ৪০৯০.৯ কোটি ২০২০ সালে ১৪৬ দেশে রপ্তানীর পরিমাণ ছিল ৪১৫৫.৪ কোটি,২০২১ সালে ১৪৮ দেশে রপ্তানীর পরিমাণ ছিল ৬৫৭৫.৮ কোটি, ২০২২ সালে ১৫৭ দেশে রপ্তানীর পরিমাণ ছিল ৬৬৩৭.৭ কোটি টাকা [তথ্যসূত্র : ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন]
ঔষধ রপ্তানি বৃদ্ধির অন্যতম কারণসমূহ হিসেবে আছে প্রথমত, ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক GMP Compliance অনুসরণ করে মানসম্পন্ন ঔষধ তৈরী করা। যার ফলে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানকে উন্নত বিশ্বের Stringent Regulatory Authority যেমন USFDA, UKMHRA, TGA (অস্ট্রেলিয়া) ইত্যাদি স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
দ্বিতীয়ত, সরকার কর্তৃক ঔষধ রপ্তানি বান্ধব নীতি গ্রহন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের জন্য কাঁচামালসহ ওষুধকে ‘প্রোডাক্ট অফ দি ইয়ার’ ঘোষণা করেন।
২০১৯ সাল হতে ঔষধ রপ্তানিতে সরকার কর্তৃক ১০% নগদ প্রণোদনা প্রদান ও সেবা সহজীকরণ ঔষধ রপ্তানিকে আরও গতিশীল করেছে। এছাড়াও সরকার ইতোমধ্যে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর থেকে দেশে উৎপাদিত ঔষধ কাঁচামাল (এ পি আই) রপ্তানিতে ২০% নগদ প্রণোদনা প্রদান করেছে।
তৃতীয়ত, বৈশ্বিক মহামারীতে আমদানীকারক দেশগুলোর ঔষধের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছু ঔষধ যেমন এন্টিকোভিড ঔষধ অধিক পরিমানে রপ্তানি করা হয়েছে। একইসাথে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস এবং বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির সাথে যৌথভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস মেলা, সেমিনার আয়োজন এবং অন্যান্য উদ্যোগ গ্রহণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের ঔষধকে প্রচার করা হচ্ছে।
এছাড়া বাংলাদেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশের ঔষধ রপ্তানি বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
বর্তমান সরকারের উদ্যোগে আধুনিক মেশিনারীজ স্থাপণ ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরোটরীকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। এ আধুনিকায়নের ফলে সকল প্রকার ঔষধের পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের জন্য ল্যাবরেটরীর সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
উক্ত ল্যাবরেটরী কর্তৃক প্রদানকৃত সনদের গ্রহণযোগ্যতা আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের রেগুলেটরী অথরিটির নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। এর ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ঔষধের উপর আস্থা বৃদ্ধি পাবে, রেগুলেটেড মার্কেটে বাংলাদেশের ঔষধের বাজার প্রসারিত হবে এবং ঔষধ রপ্তানি বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
সর্বোপরি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে, ঔষধ রপ্তানি খাত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানিকারক দেশগুলোর ডলার সংকটের মতো সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠেছে।
আশা করা যায়, এ পি আই উৎপাদনে পূর্ণ সক্ষমতা, রেগুলেটেড মার্কেটের উপর মনোযোগ, বায়োলজিকস উৎপাদন এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করলে অচিরেই ঔষধ রপ্তানি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হবে।
লেখক: প্রভাষক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি এন্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।